আমার বিবেচনায় হুমায়ূন যে প্রধান কারণে গুরুতর বিষয়ের লেখালেখির ক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই সেটা হলো এই যাকে আমরা ‘ওয়েস্টারনাইজেশন’ কিংবা ‘মডার্নাইজেশন’ প্রসেস বলি এই প্রসেস নিয়ে হুমায়ূন কখনোই মাথা ঘামাননি। আমি এই বক্তৃতার শেষ দিকে বলবো যে, হুমায়ূন যে একজন বড় লেখক তার কারণই হলো এটা যে হুমায়ূনকে ওয়েস্টারনাইজেশন বা মডার্নাইজেশনের দুইশো বছর ধরে ডমিনেন্ট ক্যাটাগরি নিয়ে কাজ করতে হয়নি। ক্যাটাগরি তার নিজের জন্য নিজেই তৈরি করেছেন। আর স্থানীয় জনসমাজ থেকেই তিনি তার ক্যাটাগরি তৈরি করেছেন। ঠিক এই কারণে হুমায়ূন সিরিয়াস পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নাই। কারণ কলোনাইজড বাঙালি মধ্যবিত্ত সিরিয়াস বিষয়-আশয় তার নিজের মধ্যে হতে পারে তার কল্পনাও করে না, ভাবেও না, বিচড়েও দেখে না। সে সবসময় মনে করে যে, তার সিরিয়াসনেস হবে অনুবাদমূলক এবং সমুদ্রের ওপার থেকে আসা। হুমায়ূন এই ক্যাটাগরি নিয়ে কাজ করেন নাই। হুমায়ূনকে পড়ার জন্য মার্ক্সের নাম নিতে হবে না। আপনার ফ্রয়েডের নাম নিতে হবে না। যারা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জানেন তারা মার্ক্স ও ফ্রয়েড এ দুটো বাংলা সাহিত্যের পঁচাত্তর ভাগ কাভার করে। মানে এই দুই নামে পড়া হয়। সুতরাং এই যে সিরিয়াস ক্যাটাগরিগুলো বহিরাগত যে গুলো সমাজের ডমিনেন্ট আকারে বিদ্যমান, যেগুলো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শেখে এবং যেগুলো শেখাকে অপেক্ষাকৃত বেটার ও উচ্চতর ব্যাপার মনে করে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ না করাই আসলে হুমায়ূনের সাহিত্যের প্রতি লোকের মনোযোগ ঠিকমতো নিবদ্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ বলে আমার ধারণা।
তৃতীয় কারণটি আমি লিখেছিলাম এরকম যে, যাকে আমরা সাহিত্যে নিরীক্ষা বলি, যাকে আমরা সাহিত্যে নির্বুদ্ধতা বলি, হুমায়ূন এটা একেবারেই করেননি। হুমায়ুনের লেখায় নিরীক্ষা বিস্তর আছে। হুমায়ূন গল্প বলতেন, লিখতেন না। হুমায়ূন যে গল্প বলতেন, হুমায়ূন যে জনপ্রিয়, হুমায়ূন যে আলাদা তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হুমায়ূন গল্প বলতেন। গল্প লিখতেন না। হুমায়ূন উপস্থাপন করতেন, হুমায়ুন জানাতেন না এবং এই পুরো ব্যাপারটা হুমায়ুন এতো মসৃণ কায়দায় করতে পারতেন যে, এর মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক নিরীক্ষা থাকতে পারে এই ব্যাপারটা পাঠকের সহসা মনে হয় না।
ফ্লবেয়ার সম্পর্কে একটা কথা পড়েছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায়। ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারিকে অনেকেই নিখুঁততম উপন্যাসের একটা নজির হিসেবে দেখে থাকেন। ওই ফ্লবেয়ার সম্পর্কে মুজতবা আলী বলছেন যে, ফ্লবেয়ারের লেখা যে নিখুঁত তার কারণ ফ্লবেয়ার আসলে অন্য লেখকদের চেয়ে দুইবার পরিশ্রম করতেন। অন্য লেখকরা আর্ট করতেন, ফ্লবেয়ারও আর্ট করতেন। কিন্তু ফ্লবেয়ার দ্বিতীয়বার লিখতেন যেন ওই আর্টটা লুকিয়ে ফেলা যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ফ্লবেয়ার সম্পর্কে এই কথা ঠিক কি বেঠিক সেটা বলার সাধ্য আমার নেই। তবে কথাটি খুবই গভীরভাবে মূল্যবান। হুমায়ূনের কোনো কোনো লেখা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে, হুমায়ূন অনায়াসে এক সহজাত শৈল্পিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, যিনি প্রথম লিখনেই আর্টিস্টিক লুকিয়ে ফেলতে পারতেন। অথচ পাঠক হিসেবে বিশেষভাবে তিরিশের নন্দনত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত পাঠক হিসেবে বাঙালি পাঠক সাহিত্যে নিরীক্ষা চায়, জটিলতা চায়, দুরূহতা চায়। হুমায়ূনের লেখা, নিরীক্ষা প্রকাশ্য বাহ্যত ধরা পড়ে না। এই লেখা দুরূহ নয়, এই লেখা পড়া খুবই সরল। ফলে এধরণের কায়দায় কোনো গুরুতর দার্শনিক জীবন, জটিলতা নিয়ে নিরীক্ষা করা যায় এই কথা আসলে ওই ধরণের সাহিত্যভোক্তাদের কল্পনা করা কঠিন। এ সমস্ত কারণে হুমায়ূনের সিরিয়াস লেখা আমাদের সিরিয়াস পাঠকদের চোখে ধরা পড়ে নাই, সেই ব্যাপারে আমি এখানে তিনটা যুক্তি বললাম। তার মানে এই নয় যে, হুমায়ুনের লেখায় কোনো ত্রুটি নেই।

আমি আগেই বলেছি হুমায়ূন একজন বিশুদ্ধ বাজারি লেখক। পার ব্যবসায়ী লোক। এবং হুমায়ূনের লেখাই নানান সীমাবদ্ধতা আছেই। যেমন আমি বলেছি হুমায়ূন আসলে পৃথিবীর ক্লাসিক উপন্যাসগুলো যে ধরণের বড় প্লট নিয়ে কাজকারবার করেছে, হুমায়ূন সেই ধরণের বড় প্লট নিয়ে কারবার করতে পারতেন না। নি:সন্দেহে পারতেন না। হুমায়ূনের লেখার বিশিষ্ট ধরণ ছিলো। হুমায়ূনের লেখায় যখনই তিনি এই প্যাটার্নের বাইরে গেছেন, ধরা যাকা জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প; ধরা যাক মধ্যাহ্ন। দুটাই অন্যান্য কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রচনা। কিন্তু আর্টিস্টিক দিক থেকে হুমায়ূন আসলে বড় উপন্যাসগুলো বড় লেখকরা যেভাবে সামলাই, সেভাবে এ দুটো লেখা সামলাতে পারেননি। তার কারণ আমি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি। হুমায়ূনের সর্বোত্তম প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিলো আসলে ছোট উপন্যাসে। নভেলা-তে। তার কারণ তিনি অত্যন্ত সংক্ষেপে বাস্তবের পটভূমি তৈরি করতেন, এবং যেভাবে একটা কাহিনীর রেখা নিয়ে প্রায় তীর বেগে লক্ষ্যের দিকে ছুটে যেতেন। এই ব্যাপারটা আসলে নভেলার আর্টিস্টিক, ফুল ফ্লেজে উপন্যাসের নয়। যদি আমরা এটা মাথায় রাখি তাহলে আমরা দেখবো যে, বাকি অংশে হুমায়ূন একজন দারুণ গদ্যলেখক, দারুণ ফিকশন লেখক। যিনি ফিকশন লেখার জন্য যে নৈর্ব্যক্তিক ভাষার প্রয়োজন হয় সেই ভাষা রপ্ত করেছেন সম্ভবত বাংলাদেশের অন্য যে কোনো লেখকের চেয়ে ভালোভাবে … আবার বলছি… এটা একটা বড় ক্লেইম। আমি বলছি এই যে, যদি আমরা উপন্যাস লেখক হিসেবে বড় প্লট নিয়ে কারবার করার ক্ষেত্রে হুমায়ূনের ব্যর্থতা স্বীকার করে ছোট উপন্যাসে হুমায়ূনের মুন্সিয়ানার একটা জরিপ করি তাহলে প্রথমেই বলতে হবে যে ধরণের নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তির মধ্যে ভাষার যে ধরণের কার্যকরতা এবং নিরাসক্তির মধ্যে হাস্যরসের মধ্যে একটা বাস্তবকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে গ্রেফতার করে ফেলা যায় তার ক্র্যাফটম্যানশীপের ক্ষেত্রে হুমায়ূন সম্ভবত বাংলাদেশের যে কোনো লেখকের চেয়ে অধিকতর সফল। হুমায়ুনের চেয়ে মডার্ন অ্যাসথেটিকসের দিক থেকে একশোটা বিচারে আমরা ইলিয়াসকে এবং ওয়ালীউল্লাহকে অবশ্যই এগিয়ে রাখবো। সেটা অন্য আলোচনা। কিন্তু ইলিয়াসের লেখায় গদ্যে এক্সট্রাঅর্ডিনারি, যেটা অদ্বিতীয়। আপনারা খেয়াল করবেন এই নিরাসক্তিটা অনুপস্থিত। অন্য একশোটা গুণ আছে। লেখা একরকম নয়। লেখা একশো রকম হয়।
পৃথিবীতে একশো রকমের বড় লেখক আছে। সেটা মাথায় রাখতে হবে। হুমায়ূন আহমেদ ছোটো লেখার ক্র্যাফটম্যানশীপের ক্ষেত্রে, মানে উপন্যাসের ভাষার ক্ষেত্রে, চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে, একটা দারুণ কনেটেক্সটের মধ্যে স্থাপনের ক্ষেত্রে, এবং একটা লাইন টেনে বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ শৈল্পিক সংযম এবং সাফল্যের অধিকারী ছিলেন। আমরা যদি এসমস্ত বিষয় ধরে হুমায়ূনের এই লেখাগুলি পড়ি, নভেলাগুলো পড়ি, তাহলে সম্ভবত আমরা হুমায়ূনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারবো। হুমায়ূন লেখক হিসেবে নতুন ক্যাটাগরি আবিষ্কার করতেন, এবং উপন্যাসের উপস্থাপক হিসেবে তিনি নানান বিচিত্র দিকে গেছেন। ঢাকার গড় পড়তা প্রথমসারির লেখকদের তুলনায় তিনি এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আমি সবাইকে অনুরোধ করবো।
ড. মোহাম্মদ আজম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্লেষক
————————————————————————————
ড. মোহাম্মদ আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্লেষকদের মধ্যে তিনি একালের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন তাত্ত্বিক। গভীর ও শাণিত যুক্তির মধ্যদিয়ে কোনো বিষয়কে ব্যবচ্ছেদ করার জন্য সুধীমহলে তার খ্যাতি রয়েছে। ঢাকার মতো অস্থির বিদ্বৎসমাজের মধ্যে তার নিবিষ্ট জ্ঞানচর্চা বিশ্ববিদ্যালয় ও যে কোনো তরুণ পাঠকের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বইয়ের ফেরিওয়ালা ’র সাহিত্য আড্ডায় ‘হুমায়ূন আহমেদ : পাঠ পদ্ধতি ও তাৎপর্য’ শীর্ষক একটি গণবক্তৃতা প্রদান করেছেন। তারই অনুমতি সাপেক্ষে উক্ত বক্তৃতার ট্রান্সক্রাইব করে প্রতিলিপি তৈরি করা হলো। লেখাটি পাঁচ কিস্তিতে ছাপানো হবে। বর্তমান লেখার চতুর্থ কিস্তি।
comments (0)