মলিন মুখে সুমনকে বাসায় ফিরতে দেখেই সুমনা যা বোঝার বুঝে ফেললো, শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো- আবার?
– হু
– সব নিয়ে গেছে?
– না, টাকা পয়সা আন্ডারওয়্যারের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম।
– শুধু তোমারই এরকম হয় কেন বলো তো! এত মানুষ চলাফেরা করে, তাদের তো এত ছিনতাই হয় না!
– শুধু আমারই নিশ্চয়ই হয় না! আরো অনেকেরই হয়, কিন্তু যাদের হয় তারা তো আর তোমাকে
বলতে আসে না!
– তাই বলে বারবার এরকম হবে? ওরা তোমাকে চিনে রেখেছে নাকি?
বুঝতেই পারছেন এই কথোপকথন ছিনতাই পরবর্তী কোন দম্পতির। কিন্তু এই সাধারণ কথপোকথনেও উঠে এসেছে সময়কে ধরতে পারার শক্তি। উপরের অংশটুকু এই সময়ের গল্পকার আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা ‘ছিনতাই’ নামক ছোটগল্প থেকে নেয়া। আমরা আহমাদ মোস্তফা কামালের বাইরেও গল্পকার হিসেবে তার পছন্দের কিছু লেখকের ব্যাপারে তুলে ধরবো।
আহমাদ মোস্তফা কামাল মূলত লেখালেখি শুরু করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। সত্যি বলতে সেটা ছিলো নিয়মিত লেখালেখির শুরু। তার বহু আগে স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই তিনি লিখেছিলেন কবিতা। তবে তিনি মনে করেছিলেন কবি হিসেবে তিনি ব্যর্থ। যদিও সেখানে একজন স্কুল শিক্ষকেরও উপস্থিতি ছিলো। আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখালেখি শুরুর এই গল্পটা অনেকেরই অজানা। তার ভাষায় বললে-
‘আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, খুবই প্রতিভাবান এবং অসম্ভব জ্ঞানী, যাঁর কথা আমি বহুবার নানা জায়গায় বলেছি এবং আমি আমার একটা বইও উৎসর্গ করেছি তাঁর নামে- হরিপদ সূত্রধর। তিনি আমার বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন এবং স্কুল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। আমার গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ সবই তিনি পড়লেন এবং গল্প ও প্রবন্ধ দুটোই রাখলেন, কবিতাটা রাখলেন না। বললেন- কবিতার ব্যাপারটা ঠিক বলা যায় না, তবে তুই যদি গল্প নিয়ে লেগে থাকিস, তোর হবে। আর হ্যাঁ, প্রবন্ধটাও ভালো লিখেছিস। তিনি তাঁর ভাষায় বলতেন- লেগে থাকলে হবে রে, তোর হবে। খুবই অল্প বয়সের একটা ছেলেকে তাঁর শিক্ষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- তোর হবে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তিনি তো আর অশিক্ষিত মানুষ নন, সমগ্র বাংলা সাহিত্যই তাঁর পড়া ছিলো, সেই পারস্পেক্টিভ থেকে দাঁড়িয়ে তিনি হওয়ার কথা বলেছেন একজন ছাত্রের প্রথম লেখা পড়ে! সেটা আমার জন্য ছিলো অনেক বড় অনুপ্রেরণা। তিনি যেহেতু আমার কবিতার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন না, আমি তাই কবিতাটা আস্তে আস্তে ছেড়েই দিলাম, লিখলাম না। আমার কাছে কেন যেন মনে হলো, ওটা হচ্ছেই না। এরপর থেকে পরবর্তী টানা ৪/৫ বছর আমি গল্প লিখে গেছি। প্রকাশ করার কোনো ব্যাপার নেই, শুধু খাতার পাতা ভরিয়ে তোলা। তবে কোনোটাই ছোটদের লেখা নয়, সবই বড়দের গল্প। আমি কোনোদিনই ছোটদের জন্য গল্প লিখতে পারিনি, এ আমার এক বিরাট ব্যর্থতা’।
স্বাভাবিক ভাবেই তিনি শুরু থেকে গল্পের দিকে মনযোগ দিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো তাঁর স্কুল শিক্ষকের অনুপ্রেরণা। কারিগরিভাবেই খুব ছোট থেকেই তিনি গল্প নির্মাণের বহুমাত্রিক দিকগুলোর সঙ্গে বেশ ভালোভাবে পরিচিত হতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভণিতাবিহীন গল্প নির্মাণেও তিনি সফলতার সঙ্গে লিখতে পেরেছিলেন। যার উদাহরণ পাই একদম শুরুতে উল্লেখ করা ‘ছিনতাই’ নামক ছোট গল্পের প্রথমাংশেই। খেয়াল করলে দেখা যায়, তিনি শুরুই করছেন একটি ঘটনার ঠিক পরেই। অর্থাৎ ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে ঠিক, তবে ঘটনার রেশ এখনও বিদ্যামান। এমন সময়ে দম্পতির কথাবার্তার মধ্য দিয়ে কোন রকম পেছনে না গিয়েই ঘটনাটি বর্ণনা করছেন সহজ ও সাবলীল ভাষায়। ভণিতা ছাড়াই গল্প শুরু করার এই প্রবণতা আহমাদ মোস্তফা কামালের প্রত্যেক গল্পেই দেখতে পাওয়া যায়।
তবে এক্ষেত্রে গল্পকে নির্দিষ্ট নকশার মধ্যে ফেলে লেখার প্রবণতা দেখা যায় বেশিরভাগ গল্পকারের মধ্যে। আরও সহজভাবে বললে, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গার বাইরে গল্পকাররা লিখতে চান না; কারণ এতে পরিশ্রম ঢের বেশি। এক্ষেত্রে আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্পকার হিসেবে একদমই আলাদা। নিজের পছন্দের বিষয়বস্তু বলে কিছু স্বীকার করতেও নারাজ তিনি। আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু বা ফর্ম নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন বা দুর্বলতা আছে? এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন,
‘না, কোনো “নির্দিষ্ট” বিষয়বস্তুর প্রতি দুর্বলতা নেই। মানুষকে তার ব্যক্তিগত জগতের ভেতরে রেখে, তার পারিবারিক সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে, তার আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে, তার দার্শনিক সংকটের নিরিখে দেখাতে চেয়েছি বিভিন্ন গল্পে। আর এসব দেখাতে গিয়ে বার বার আমাকে ফর্ম পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগে ফর্মের কথা ভেবে গল্প লিখতে বসিনি, বরং গল্পের বিষয়বস্তুই দেখিয়ে দিয়েছে কোন ফর্মে লিখতে হবে’।
তার লেখালেখির শুরু ১৯৯০ দশকের শুরুতে। প্রথম গল্পগ্রন্থ দ্বিতীয় মানুষ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর আরো ৯ টি গল্পগ্রন্থ, আটটি উপন্যাস, একটি নভেলা, চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং দুটি মুক্তগদ্যের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন আরো ১১টি গ্রন্থ। পেয়েছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার এবং সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার। আহমাদ মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলায়। মানিকগঞ্জের পাটগ্রাম অনাথ বন্ধু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি এবং ১৯৮৮ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৯২ সালে স্নাতক ও ১৯৯৩ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে এম ফিল এবং ২০১০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
২০০৭ সালে আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য নামের বইটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বই হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের নানা বৈকল্য ও বিকার, অসুখ ও স্খলনের গল্প। মানুষের মনের নিভৃতে আলো ফেলে ছেঁকে এনেছেন প্রেম, স্বপ্ন ও ভালো লাগার নিকষিত অনুভূতিগুলো। তাঁর গল্পে বাস্তব জটিল, বাস্তবের প্রকাশ জটিলতর। মানুষের স্বপ্ন বাস্তবের আঘাতে হারিয়ে যায়, প্রেম দিগভ্রান্ত হয়, প্রাপ্তির মুহূর্ত ঢুকে পড়ে অপ্রাপ্তির অঞ্চলে। যাত্রাদলের এক সদস্য অতীত স্মরণ করে কাঁদেন আশ্চর্য কান্না। এক ঘোর লাগা মানুষ প্রকাশ্যে স্ত্রীর কাছে প্রেমানুভূতি জানাতে গিয়ে ডেকে আনে সর্বনাশ। এক শহরে অচেনা এক লোক এসে তার স্ফিংক্স- সদৃশ প্রশ্নে মানুষের সব হিসাব নিকাশ এলোমেলো করে দেয়।

এছাড়াও আহমাদ মোস্তফা কামালের দ্বিতীয় উপন্যাস অন্ধ জাদুকর বইয়ের জন্য ২০০৯ সালে তিনি জেতেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার। এই বইটির গদ্য একদমই ভিন্ন রকম লাগে। গল্প বলার ভঙ্গিমা এতটাই নিখুঁত যে, মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ একজন শিয়রে বসে শুনিয়ে যাচ্ছে আটপৌরে কোনো গল্পের আগাগোড়া–
“কোনো এক জোছনাপ্লাবিত বৃষ্টিমুখর শীতের রাতে উদাসপুরের ওই মায়াময় বাড়িতে জন্ম হয়েছিল আমার। মায়ের মুখে সেই জন্ম-বর্ণনা, আহা, কী যে মধুর লাগে শুনতে-
‘তোর জন্ম তো শীতের রাতে। বাইরে ফুটফুটে জোছনা, এমনকি জোছনার দাপটে কুয়াশাও পালিয়েছে’- দারিদ্রপীড়িত সংসারে মধ্যবিত্ত রূপটি ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় রত আমার আটপৌরে মায়ের কণ্ঠে যেন কবিতা ঝরে পড়ে- ‘ঘরে তখন দুদুর মা (আমার দাই মা) ছাড়া আর কেউ ছিল না। আঁতুর ঘরে তখন আর কারো থাকার নিয়মও ছিল না। হঠাৎ, কী কাণ্ড, শুনি, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ! আমি বললাম, ও দুদুর মা, বাইরের সবকিছু মনে হয় ভিজে গ্যালো, দ্যাখো তো! বুঝিস না, মাটির চুলায় রান্না হতো, খড়ি-লাকড়ি সব বাইরেই রাখা। শীতের দিনে কেউ বৃষ্টির কথা চিন্তা করে ওসব ঘরে তুলে রাখে নাকি! এখন যদি সব ভিজে যায়, কালকে রান্না করতে অসুবিধা হবে। দুদুর মা বাইরে গ্যালো, কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে-টুছিয়ে ফেরার আগেই তোর জন্ম হলো। বুঝলি, তোর জন্মের সময় ঘরে আর কেউ ছিল না। যেই এই কাণ্ডটি ঘটানোর জন্যই শীতের রাতেই অমন খা খা জোছনার মধ্যেও বৃষ্টি এসেছিল’।”

আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা গল্পের গদ্যের বাইরেও গল্প বিনির্মানে বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য লেখকদের মতই করেছেন নীরিক্ষা। তাঁর পছন্দের গল্পকারের অনেকেই উপমহাদেশে নীরিক্ষাধর্মী কাজের জন্য বিখ্যাত। আপনার কাছে আদর্শ গল্পকার কারা? এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেছিলেন- ‘অনেকেই। ছোট্ট একটা গল্পে যারা একটা জীবনের পূর্ণাঙ্গ ছবি উপহার দিতে পারেন, তাদেরকে মান্যকরতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ এবং মানিক তো আছেনই, বাংলাদেশে ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, সৈয়দ হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, মঈনুল আহসান সাবের, শহীদুল জহির, শাহাদুজ্জামান, খোকন কায়সার- এঁদের গল্প পড়ে আমি গভীর আনন্দ পাই। এর বাইরেও অনেক লেখক আছেন যাদের একটি-দুটো গল্পকে মনে হয়েছে পূর্ণাঙ্গ। দেশের বাইরে, কাফকা আমার অসম্ভব প্রিয় গল্পকার। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আরো সহজ হয়ে উঠবার সাধ জাগছে, তখন ক্রমশ বোর্হেস প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়ে উঠছেন।
আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখা গল্প সাবলীল ভাবেই জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনের গতিতে, লিখে যাচ্ছেন বহুদিন ধরে। কিন্তু তারপরেও মনে হয়, কোন এক রাতে মধ্যবিত্ত পরিবারের কারও নিয়মিত ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীর মত বেদনা ও দুঃখের গল্প আরও বহুদিন বলে যাবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল।
আরও পড়ুন- শাহাদুজ্জামানের লেখা অল্প নয়, নিছক কোনো গল্প নয়
আহমাদ মোস্তফা কামালের সকল বই দেখুন