সেরা গল্পকারের নাম বলতে বললে অনেকের নামই মনে আসবে, যেমন- জেমস জয়েস, ও হেনরি, আন্তন চেখভ, এডগার এলান পো, উইলিয়াম ফকনার, রুডইয়ার্ড কিপলিং, জন স্টেইনবেক, টনি মরিসন, নাদিন গর্ডিমার, ম্যাক্সিম গোর্কি, টলস্টয়; এমনকি আমাদের রবীন্দ্রনাথও বাংলা ছোটগল্পের জগতে এখনো এক অপরাজিত নাম। হালের সর্বোচ্চারিত নাম মুরাকামি কিংবা কুন্দেরাও থাকবেন উৎকৃষ্ট গল্পকারের খাতায়। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিপলিং, মরিসন, গর্ডিমার, ফকনার, স্টেইনবেক, এঁরা সবাই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তা আপনারা জানেন। অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি তাঁরা ভালো গল্প লিখেছেন, কিন্তু কেউই এককভাবে ছোটগল্প বা শুধু গল্পের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেননি। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীদের তালিকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিন, কারো নামের পাশে গল্পকার শব্দটি নেই, কেবল মানরোর নাম ব্যতীত। হ্যাঁ, এলিস মানরো একজন গল্পকার। ছোটগল্পের জন্য নোবেল বিজয়ী একমাত্র গল্পকার! সমকালীন কথাসাহিত্যের এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম আমাদের এই লেখার কুশীলব এলিস মানরো, যিনি ৬০টি বছর ধরে নিবিষ্টচিত্তে গল্প লিখে চলেছেন, এতটাই যে, নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত শুনেও বলেছেন, ‘আমি আশা করিনি, আর অত কিছু মনেও আসেনি পুরস্কার নিয়ে। কারণ- পরিবারকেন্দ্রিক অনেক কাজ আমার।’
তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির আশেপাশের বছরগুলোতে অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে প্রাইজ মোটিভেশন হিসেবে নোবেল কমিটি ব্যবহার করেছে- ‘ hallucinatory realism’, ‘condensed style’, ‘translucent images’, ‘sensual ecstasy’র মতো শব্দাবলী। কিন্তু মানরোর ক্ষেত্রে কমিটির বক্তব্য ছিল একদম সোজাসাপ্টা- “master of the contemporary short story.”

২০০৯ সালে ম্যানবুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও ২০১৩ সালে নােবেল বিজয়ী এই ছােটগল্পকারের গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছােটগল্পে উপন্যাসের স্বাদ উপলব্ধি। তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে গল্পে এমনভাবে চিত্রের পর চিত্র এঁকে যান, পাঠক একমুহূর্তের জন্য ভাবনায় পড়েন, এসব আবার গল্পহীনতার গল্প কিনা। কিন্তু আধুনিক ছােটগল্পের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তার গল্পে থাকে জমাট গল্প, শুধু শব্দব্যায়াম নয়। আর সে গল্পের উপস্থাপন কৌশলে এত মাধুর্য ও মুন্সিয়ানার মিশেল থাকে যে প্রতি গল্পপাঠে পাঠক আলােড়িত ও আন্দোলিত হন। হৃদয় ভালােবাসা বা বেদনার মন্ত্রে ভারী হয়ে উঠে চোখে জল এনে দেয়। তবে সে জল কোনােভাবেই আশাহীনতা বা দুঃখের নয়, জীবনকে খোঁজার, জীবনের মানে খোঁজার এই শৈল্পিক ভঙ্গিই পাঠককে তৃপ্তি দেয়। তাঁর প্রতি গল্প আলাদা বিষয় আর পটভূমিতে লেখা। এত বেশি লিখেও তিনি কখনাে পুনরাবৃত্তি করেননি। কানাডার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে টরেন্টো বা মন্ট্রিয়েল কিছুই বাদ নেই পটভূমি হিসেবে। তাঁর গল্পে সুদূর কানাডার পরিবারও বিশ্বের যে-কোনাে পারিবারিক বন্ধনের দায়িত্বশীলতা ও মায়ের ভালােবাসার প্রতিভূ হয়ে ওঠেন, মা ও শিশুদের গল্প বলতে বলতে তিনি হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী লেখক। যেখানে একজন সব হারানাে নারীও অচেনা কোনাে কিশােরকে মুখে কৃত্রিম শ্বাস দিয়ে হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে দিতে দিতে ফিরে পান নিজের জীবনের মানে, প্রাণ ফিরিয়ে দেন অবক্ষয় আর অসুস্থতা কবলিত সমাজের মর্মে।
মানরোর প্রতিটি গল্পে তাঁর ভিন্ন ভিন্ন সফল নিরীক্ষার পরিচয় স্পষ্ট। কানাডার অন্টারিওর উইংহ্যামে মানরাে ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তাঁর প্রকাশিত গল্প সংকলনগুলাের মধ্যে ডান্স অব দ্যা হ্যাপি শেডস; সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু টেল ইউ, দ্যা বেগার মেইড, দ্যা মুনস অব জুপিটার, দ্যা প্রােগেস অব লাভ, ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ােথ, ওপেন সিক্রেকসট, সিলেকটেড স্টোরিজ, দ্য লাভ অব এ গুড ওম্যান, হেটসশিপ কোটশিপ লাভসশিপ ম্যরিজ উল্লেখযােগ্য। প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য উপন্যাস ‘লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড ওম্যান’।

মানরাের গল্পে জীবনের এত নিবিড়তা পরিলক্ষিত হয় যে তা অনেক সময় পাঠককে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় আসলে কি মানুষ এতটাই সংবেদনশীল? কিন্তু পাঠের গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে যখন চরিত্রগুলাের মনােজগতের উন্মােচন ঘটে তখন দেখা যায় আসলে অবচেতনে মানুষ কতটা সংলগ্ন। আমরা অনেক কাজই করি, ভেবেচিন্তে, হিসেব করে করি। কই তারপরও তাে আমাদের শত গন্ডা ভুল থাকে, ঠিকমতাে ভালাে কাজের ভালাে ফল বা খারাপ কাজের খারাপ ফল পাই না। অঙ্কের হিসেবের মতাে জীবনের হিসেব মেলে না। কারণটা কি কখনাে ভেবে দেখি? দেখি না, আর এই ভাবনা আর ভাবনার ফলাফল মানরাে তার গল্পে যখন পরতে পরতে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, তখন আশ্চর্য হয়ে যাই, দেখি যে আমাদের মনের গভীরেই কোথাও এর উত্তর লুকিয়ে ছিল। মানরাের গল্প আমাদের এই অন্তঃচোখ খুলে দেয়। এক্ষেত্রে তিনি কখনাে মনস্তত্ব, কখনাে পারিপার্শ্বিকতা বা কখনাে নিয়তির সাহায্য নিয়েছেন। আমরা যাকে দৈবিক বা অলৌকিক বলে ভাবি, তা আসলে আমাদেরই অচেতন মনের ক্রিয়া। এই কঠিন ও পরীক্ষাসাধ্য মনস্তত্ব ও যুক্তিকে মানরাে এমন অবলীলায় গল্পের আবেগের মধ্যে গল্পের বুনটের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন যে গল্প পড়ার পরে আর কোনাে কিছু অলৌকিক মনে হয় না, চরম মন্দকেও নতুন চোখে দেখার, তার পারিপার্শ্বিকতা পরিপ্রেক্ষিতসহ দেখার একটা সহানুভূতিপ্রবণ মন গড়ে ওঠে পাঠকের মধ্যে।

পাঠকের মধ্যে সহনশীলতা ও সংবেদনা তৈরির এই ক্ষমতাই মানরােকে অন্য গল্পকারদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। কেন যেন মানরাের গল্পে আলবেয়ার ক্যামু বা জাঁ পল সাত্রের মতাে মনােদেশ তলিয়ে দেখার ও তাদের নির্লিপ্ত মনােভঙ্গী থেকে কয়েক কদম এগিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছানাের প্রচেষ্টা আছে। সচেতন চেষ্টা আছে প্রান্তবর্তী মানুষের সমস্যা ও সমস্যার মধ্যেই খুঁজে খুঁজে নেয়া সুখগুলােকে চিত্রায়নের। এভাবে এলিস মানরাে ব্যাপক হয়ে ওঠেন, বিস্তৃত হয়ে ওঠেন, সামগ্রিক হয়ে ওঠেন, ছােট পারিবারিক পরিবেশে গল্পের সূচনা করে সারা বিশ্বকে ধরে ফেলেন মুঠোর মধ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে একটা পরকীয়া পুরােপুরি শারীরিক আকর্ষণে তৈরি প্রেমের মধ্যে ভিয়েতনামের যুদ্ধ এসে পড়ে। জন্মদাগসহ জন্ম নেওয়া এক শিশুর তিতিক্ষার গল্পে এসে পড়ে হিটলার নাৎসি বাহিনী। অথবা নিরেট অপত্য স্নেহের গল্পে কোথা থেকে ঢুকে পড়ে মানুষের অপরাধ প্রবণতার বিশাল জগতের সামগ্রিক চিত্র।

যতই চেষ্টা করা হােক না কেন মানুষ যে কখনাে শেকড় বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, উন্মুল মানুষকে বাঁধতে চায় নিজের ছকে, আর ঘটতে থাকে সব অঘটন ও আত্মােপলব্ধি, আবেগের তীব্র অনুভূতির দাস মানুষ যে কখনােই ছকেবদ্ধ জীবনের দাসত্ব করতে পারে না, সব সম্ভাবনা সুখের প্রতিশ্রুতি থাকলেও যে পরিবেশ-প্রতিবেশে সে বেড়ে ওঠে, সেই পরিবেশ থেকে তাকে পৃথক করা যায় না, বরং অনেক বেশি জ্ঞান ও পরিচর্যা পেলে ঐ শেকড়ে যাবার আবেগই মানুষের মনকে টানে, সে গল্প মানরাে আমাদের শুনিয়েছেন আর আমরাও দমবন্ধ করা অনুভূতি নিয়ে সে গল্প শুনতে থাকি, আবিষ্কার করতে থাকি ভেতরের আমিকে। মানরাে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়ে দেখতে সাহায্য করতে থাকেন আমাদের ভেতরের আমিকে, আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া সব বিষয়ের গ্রহনযােগ্য কার্যকারণকে।
শুধু গল্প বলে আত্মােপলব্ধির জাগরণ ঘটানাে, তাও আবার সুখপাঠ্য গল্প বলে, সহজ কথা নয়। মানরাে এই কঠিন কাজটিই সহজভাবে করেন। তাঁর শিল্পকৌশল এক্ষেত্রে সহায়তা করে তাঁকে। প্রতিটি খুটিনাটি তিনি উল্লেখ করেন সাবলীলভাবে, যা থেকে পাঠক পেয়ে যান তৃপ্তি, কিন্তু এর মধ্যেই মানরো তীব্র আলাে ফেলেন মনােজগতে। আর এজন্যই মানরো অন্যদের চেয়ে আলাদা।
আরও পড়ুন- জুল ভার্নের রচনা মানেই স্বপ্নের এক জগৎ
মানরোর সকল বই দেখুন