কোন অদ্ভুত ঘটনায় ছোট হয়ে গেছে বিশাল আকৃতির বাটুল। সঙ্গে থাকা দুই সঙ্গী বাচ্চু আর বিচ্ছু তো বিরাট বিপদে। কী করা যায়? তখনই বের হলো এক বুদ্ধি। সাইকেলের টায়ারের পাম্প মুখে দিয়ে চাপতে শুরু করলো। বড় হয়ে গেলো বাটুল। হয়ে উঠলো সেই আগের মত, বাটুল দি গ্রেট!
হাফপ্যান্ট পরা বয়সে যদি ফিরে যেতে হয় তবে অবশ্যই স্মরণ করতে হয় নারায়ণ দেবনাথকে। ‘বুকের পাটাওয়ালা লোক’ বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কমিক্সের বাটুলের চেহারা। কিন্তু বাটুলকে আঁকার জন্য যিনি তুলি হাতে নিয়েছিলেন, সেই নারায়ণ দেবনাথকে থামাতে হলো তুলি। প্রায় আটানব্বই বছরের জীবনের অধ্যায় ইতি করে পারি জমালেন না ফেরার দেশে। ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি মধ্যহ্নের আগেই চিরতরে থেমে গেলো নারায়ণ দেবনাথের রঙ তুলি।
বাঙালীর কোন সুপারহিরো ছিলো না। বাঙালীরা বিদেশীদের বেষভূষার সুপারহিরো হয়তো দেখে আনন্দ পেতো বটে, কিন্তু মনে মনে চাইতো বঙ্গীয় সজ্জার কোন হিরোর। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাটুল দি গ্রেট ছিলো সেই বঙ্গীয় সুপারহিরোর এক আবহমান মূর্তি। বাঁটুল দি গ্রেটের দুনিয়ায় চোখ রাখলে বোঝা যায়, এর চরিত্ররা এক অলীক নগরের বাসিন্দা। সেই ভুবনে কেমন যেন একটা কাউবয় অধ্যুষিত আমেরিকান গন্ধ। তবে সেখানে মজার ঘটনাগুলোর সৃষ্টি হয় একেবারেই বাঙালি নিয়মে। ভুঁইফোঁড়, লোক-ঠকানো, ফ্যাশন-সর্বস্ব পোশাকের দোকানের নাম ‘অঙ্গবাহার’ আর সাদাসিধে পোশাক বিপণির নাম ‘অঙ্গঢাকা’— এমন রসবোধে মজে যেতে সময় লাগেনি বাঙালি পাঠকদের।
তার অন্য এক দারুণ চরিত্র হাঁদা ভোঁদা। এই বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, তবে ‘হাঁদা-ভোঁদা’র পরিমণ্ডল কিন্তু ষোল আনা বাঙালি। রোগা-পাতলা হাঁদা তার চালাকি নিয়ে নাজেহাল হবেই আর সহজ-সরল মোটাসোটা ভোঁদা জিতবে শেষমেশ— এই কাঠামো বার বার পুনরাবৃত্ত হলেও একটুও একঘেয়ে লাগেনি। কারণ একটাই— এই কমিক স্ট্রিপ খুদে দস্যিদের একাত্ম বোধ করাতে পেরেছিল। তাদের অভিভাবকদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অমল কৈশোরে।
ছবি ক্রেডিটঃ বঙ পিকাসো
তবে তুলনায় ‘নন্টে-ফন্টে’র দুনিয়া একেবারেই আলাদা। ছাত্রাবাসের ঘেরাটোপে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি (নাকি হাতিরাম পাতি?) আর বেয়াদপ সিনিয়র কেল্টুর সঙ্গে নন্টে-ফন্টের অনিঃশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হস্টেল জীবন কাটিয়ে আসা বঙ্গসন্তানকে এখনও স্মৃতিভারাক্রান্ত করে। যাঁরা সেই জীবনের স্বাদ পাননি, বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছেন সেই জীবনের নানা কাহিনি, তাঁদেরও প্রায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে সমর্থ এই চিত্র-কাহিনি। তবে এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কমিক স্ট্রিপ রচনা করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘ডিটেকটিভ কৌশিক রায়’ ইত্যাদি। তবে এ সবের মধ্যে উল্লেখের দাবি রাখে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়’ সিরিজ। দুর্দান্ত অপরাধী ব্ল্যাক ডায়মন্ড আর গোয়েন্দা ইন্দ্রজিতের টক্করে কে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়, তা জানা যায় না কখনওই। ১৯৮০-১৯৯০-র দশকে সেই সব চিত্রকাহিনি গোগ্রাসে গেলেনি, সেই সময়ে কৈশোর পেরোতে থাকা তেমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আঁকাঃ মেহেদী হক
বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মন্ডলীর উৎসাহে। তার প্রথম কমিকস হাঁদা ভোঁদা নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সে সময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ’র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত। শৈশবের দিকে তাকালে দেখা যায়, নারায়ন দেবনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিবপুর, ভারতে। পারিবারিক আদি বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে হলেও তার জন্মের আগেই পরিবার শিবপুরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করে। অল্প বয়স থেকেই শিল্পের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। পারিবারিক পেশা স্বর্ণকার হওয়ায় অলঙ্কার প্রভৃতির নক্সা করার সুযোগ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর্ট কলেজে পাঁচ বছরের ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাননি, শেষ বর্ষে এসে পড়া ছেড়ে দেন। এরপরে কিছু বছর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য কাজ করেন।

কিন্তু থেমে যেতে হয় একসময়। নারায়ণ দেবনাথও থামিয়েছেন তার রঙিন তুলি। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার জেরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় প্রবীন লেখক-চিত্রশিল্পীকে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের এক দিন হুট করেই অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ১৫ই জানুয়ারী রাত থেকেই ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল তাঁকে। বর্ষীয়ান শিল্পীর চিকিৎসায় পাশে দাঁড়িয়েছিল রাজ্য সরকার। তাঁর চিকিৎসার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল। তবে গতকাল থেকেই ৯৭ বছর বয়সী এই প্রবীণ কার্টুনিস্ট সাড়া দিচ্ছিলেন না চিকিৎসায়। চিকিৎসক সমরজিৎ নস্কর জানিয়েছিলেন সেই কথা। এর আগে বাইপ্যাপ সাপোর্টে ছিলেন শিল্পী, কিন্তু তাতেও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমছিল।
ভারতীয় সংবাদপত্র মারফর জানা যায়, ৯৩ বছরে এসেও বাটুলের কমিক্সের ছবি এঁকেছিলেন নারায়ণ বাবু। ভাবা যায়! চিরকালের স্বল্পভাষী ও প্রচারবিমুখ এই শিল্পী বছর নব্বইয়ের ঘর পার করেও সমান দক্ষতায় এঁকে গিয়েছেন ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘নন্টে-ফন্টে’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এর নানা কাণ্ডকারখানা। ‘এই বয়সেও অসুস্থ শরীরে কেন টানা এঁকে যাচ্ছেন?’ প্রশ্নের জবাবে নারায়ণবাবু একবার জবাব দিয়েছিলেন, ‘ছোটদের খুব ভালোবাসি, তাই। তাঁদের জন্য তুলিকলম ছাড়তে পারিনি।’ আর তার জেরেই নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল আর তার দুই সাগরেদ ভজা-গজা-লম্বকর্ণদের কীর্তি ছাড়াও পাঠক পেয়েছে বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, শুঁটকি মুটকি, পটলা দ্য ম্যাজিশিয়ানের মতো মনমাতানো সব কমিক্স।

সেই সব স্মৃতি, তাঁর তৈরি চরিত্রদের হাত ছেড়ে দিয়ে পথচলা থামালেন শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ। আরও বহুবছর যখন শিশু-কিশোররা অথবা আমাদের মত মানুষেরা ফিরে যেতে চাইবে হাফপ্যান্ট পরা বয়সে, তখন পেরেনো যাবে না, নারায়ণ দেবনাথকে সাথে না রেখে। তুলি থেমে গেলেও পুরনো কাগজে ভেসে উঠবে তার আঁকা রঙিন কোন স্ট্রিপ।
কমিক্সের সব চরিত্রের মত উজ্জ্বল!
নারায়ন দেবনাথের সকল কমিকস দেখতে ক্লিক করুন