শাহাদুজ্জামানের সাহিত্য ও চিন্তার জগতে ঢোকার আগে চলুন একটা দৃশ্যের মধ্যে আপনাদের ঢোকাই। একজন ছাপোষা ভদ্রলোক যার নাম রেজাউল করিম, তিনি প্রতিদিন অফিসে গিয়ে দুপুর নাগাদ নিজের বাসায় ফোন করেন। কারণ সেসময় তার স্ত্রী চাকরি ক্ষেত্রে থাকে। তার স্কুল পড়ুয়া ছেলের ক্লাস থেকে ফিরে একা থাকতে হয়, মা-বাবা দুজনই তখন নিজেদের অফিসে। ছেলের এইরকম একাকীত্বকে নিদারুণ ভাবে অনুভব করেন ভদ্রলোক, তাই ঘরে ফোন দিয়ে রেজাউল করিম ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রেজাউল করিম সাহেব আছেন?’
তখন ছেলে হাসতে হাসতে বলে, ‘বাবা তুমি এত দুষ্টুমি করো!’ ছেলেকে কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব ভোলানোর জন্য তিনি প্রতিদিন এই কাজ করেন। নিজেই ফোন দিয়ে নিজেকে চান। কিন্তু একদিন ঘটনা পাল্টে যায়। রেজাউল করিম নিজের ছেলেকে ফোন দিয়ে বরাবরের মত বলেন, ‘রেজাউল করিম আছেন?’ ছেলে গম্ভীর মুখে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ আছে’। রেজাউল করিম সাহেব ফোন নম্বর মেলান, দেখেন সব ঠিকঠাক। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি রেজাউল করিমের মত কণ্ঠের একজন ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলে ওঠেন। রেজাউল করিম সাহেব নিজের সঙ্গে ফোনে কথা বলার এক অভূতপূর্ব ও আশ্চর্যজনক সময়ে উপনীত হন। এই দৃশ্যের মধ্যে ঢুকলে আপনি কী করতেন?
শাহাদুজ্জমানের লেখা ছোটগল্প ‘মহাশূন্যে সাইকেল’ থেকে উপরের অংশটুকু নেয়া হয়েছে। বাংলা ভাষার ছোটগল্পে নতুন ধরণের নান্দনিকতা যুক্ত করেছেন তিনি। আগাগোড়া একাডেমিক মানুষ হয়েও সৃজনশীল কথাসাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। তার লেখা বেশ কিছু ডকু ফিকশনও পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে নন-ফিকশন এবং ফিকশন দুই বিপরীত ঘরানার লেখায় সমান দক্ষতা থাকা শক্তিমান লেখক খুব একটা দেখা যায় না। মেডিকেল থেকে ডাক্তার হবার পর স্বাস্থ্য-নৃবিজ্ঞানের উপর পিএইচডি করে ডাবল ডক্টর শাহাদুজ্জামানের গল্পে উঠে আসে এমন অদ্ভুত সব টানাপোড়েন, তা পড়ে যে কেউ চমকে যেতে পারেন নিমেষেই।
শাহাদুজ্জামানের লেখায় গল্প ঠিক কীভাবে এগোচ্ছে কিংবা গল্পের ফলাফল কী হবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গল্পের ভাবনা। মানুষ মাত্রই যে নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে শুরু করে দার্শনিক ভাবনাগুলো থাকে, সেগুলো প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে তিনি বেছে নেন গল্পকে। ব্যাপারটাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন গ্রামে মাছ ধরার মত করে। ছোট্ট একটি মুখ দিয়ে মাছ প্রবেশ করে বেশ বড়সড় একটি জালে আটকে যায়। তিনি চেষ্টা করেন গল্পের মধ্যে ছোট্ট একটি দরজা দিয়ে বেশ বড়সড় এক ভাবনার জগতে প্রবেশ করাতে। একদম শুরুতে উল্লেখ করা গল্প, যেখানে রেজাউল করিম সাহেব একদিন আকস্মিক ভাবে ফোনে নিজের মত আরেকজন রেজাউল করিমকে শুনতে পান, এটি মুলত সেই ছোট আকৃতির দরজা যেখান দিয়ে পাঠক প্রবেশ করবে নতুন এক ভাবনার জগতে। ‘মহাশূন্যে সাইকেল’ গল্পে ঠিক তারপরই আমরা যেই জগতে প্রবেশ করি, গল্প শেষে একদম ভীন্ন ধরণের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব নিয়ে আমাদের চিন্তার জগত আন্দোলিত হয়।
কিন্তু এত জটিল ভাবনা চর্চার জন্য গল্পকে বেছে নেয়া হলো কেন? আমার মনে হয়, গল্পের সঙ্গে মানুষের সখ্যের কারণেই। মানুষের মধ্যে গল্পের তৃষ্ণাটা খানিকটা জৈবিক চাহিদার কাছাকাছি। আদিম কাল থেকেই ক্ষুধা কিংবা অন্যান্য প্রবৃত্তির মত মানুষের মধ্যে গল্পের একটি দারুণ আকাঙ্খা আছে। তাই গল্পকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে চিন্তার চর্চা করা বেশ কার্যকরী। শাহাদুজ্জামানের ধারণা, আমাদের এই অঞ্চলে বহুকাল আগে থেকেই গল্পের মধ্যে দর্শনের চর্চা হয়ে আসছে। উদাহরণ হিসেবে আনা যায়, রূপকথাকে। বাচ্চাদের মধ্যে রূপকথার গল্প নিছক গল্প শোনানোর কাজ করে না; বরং এটি ভাবনার জগতকে খুলে দিতে শুরু করে। রূপকথার মধ্যকার এক অচীনপুরের রাজকুমার যে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে গিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করছে এবং সেখানে আসন্ন বিপদগুলোর মোকাবেলা করা হচ্ছে পুরোটাই একটি ভাবনার প্রক্রিয়া। রূপকথা শিশু বয়সী মানুষদের জানান দেয়, জীবনটাও একই রকম। এখানেও বিপদ আসবে, হয়তো জঙ্গল নয়; বরং অন্য কোন রূপে। তোমাকেও রাজকুমারের মত শক্ত ও আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে। অর্থাৎ শত শত বছর ধরে গল্পের মাধ্যমে দার্শনিক চর্চার এই রীতি সব বয়সী মানুষের জন্যই কার্যকরী।
শাহাদুজ্জামান তাঁর লেখা গল্পগুলোতে ভাবনার চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেগুলোকে বহু স্তরে নির্মাণ করেন। ভাষাকে শুধুমাত্র গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন না তিনি। নান্দনিকতার দিক থেকে বহুমাত্রিকভাবে গল্পকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেন। সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ যেই প্রক্রিয়া, মানুষের চিন্তাকে বহুমুখী ভাবে নাড়া দেয়া, সেগুলোও গল্পে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার শহীদুল জহিরের লেখা ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পকে সামনে এনে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। গল্পটি পাওয়া যায় ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ বই থেকে।

এই গল্পে শহীদুল জহির যেই মহল্লার বর্ণনা দিচ্ছেন, সেই মহল্লার গলির মোড়ে তরমুজ স্তুপ করে রাখতে দেখা যায়। ঢিবির মত দৈর্ঘ্যের তরমুজের কারণে পুলিশের গাড়িও ঢুকতে পারে না। সেখানে ঘটতে থাকে নানা কিছু। বাচ্চারা খেলে, সেই মহল্লার কবিকে দেখা যায়। আবার একজন মেয়েকে চলচ্চিত্রে কাজ করার একটি পটভূমিও দেখা যায়। গল্প এগোতে এগোতে আমরা পাশ থেকে খেয়াল করি যে, তরমুজ কমে যাচ্ছে। ঢিবি হয়ে থাকা তরমুজের স্তুপ কমতে কমতে একসময় মাত্র তিনটে তরমুজ দেখতে পাওয়া যায়। তরমুজ হঠাৎ কমে গেলো কেন? এই উত্তর খুঁজতে গেলে আপনি গল্পের বিভিন্ন অলি-গলিতে দেখতে পাবেন তরমুজের সরবারহ কমে যাচ্ছে কারণ যেসব ট্রাকে করে তরমুজ আসতো সেসব ট্রাকের বিভিন্ন যন্ত্রাপাতি ইত্যাদির দামের উপর ভ্যাট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে করে ট্রাক মালিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ফলে সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে তরমুজ আর আসছে না। এই যে একটি গলির মুখে তরমুজের সংখ্যা কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা দেখানোর মাধ্যম, তা সম্পূর্ণই গল্পের বহুমাত্রিক স্তরের কারণে সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ আমরা গল্পটা পড়ছি তরমুজের, তবে এই তরমুজের কারণে পুরো দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সামগ্রিক একটি দৃশ্য আমি দেখতে পাচ্ছি।
শাহাদুজ্জামান তেমনি ভাবে গল্পের একেকটা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে পাঠককে নানা জায়গায় প্রবেশ করান; নিছক গল্প শোনানোর জন্য গল্প লেখেন না। একটি গল্পের মধ্যে আরও একটি গল্প, খানিকটা রাশিয়ান মাত্রুস্কা পুতুলের মত যেখানে একটি পুতুলের মধ্যে ভরে রাখা যায় আরেকটি পুতুল, সেই পুতুলের মধ্যে আরও একটা।
আবার ফিরে যাই কেশের আড়ে পাহাড় নামক বই থেকে নেয়া ‘মহাশূন্যে সাইকেল’ গল্পে। এখানে বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের মত দুটো দার্শনিক ভাবনাকে বলা হচ্ছে গল্পের পন্থায়। কারও সঙ্গে হয়তো আপনার দূরত্ব একদমই নয়; একই ঘরে বসবাস করেও দু’জনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা থাকতে পারে। আবার বহু দূরত্বের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতাহীন সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এইরকম জটিল চিন্তা যে গল্পে আনা হচ্ছে, তার শুরুটা হচ্ছে থ্রিলার উপায়ে। নিজের সঙ্গে নিজেই ফোনে কথা বলছেন একজন। এই যে থ্রিল উপায়ে গল্পের মধ্যে ছোট্ট দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া এটা শাহাদুজ্জামান আরও করেছেন ‘একজন কমলালেবু’ নামের ডকু ফিকশন ঘরানার বইতে। যেখানে তিনি বইয়ের শুরুতেই প্রশ্ন করে বসেছেন, গত একশো বছরে ট্রামে কোনো দূর্ঘটনা না হওয়ার স্থানে জীবনানন্দ দাশ কিভাবে দূর্ঘটনার শিকার হলেন? এটা কি নিছক দূর্ঘটনা? নাকি আত্মহত্যা? নাকি খুন?

শাহাদুজ্জামানের লেখা আরেকটি ডকু ফিকশন ‘ক্রাচের কর্ণেল’ বেশ জনপ্রিয় একটি বই। ৩৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে একজন কর্নেল তাহেরের জীবন মানচিত্র অঙ্কন ছাড়াও লেখক পাক-ভারত দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তার পরবর্তী সময়ের জানা-অজানা অনেক পরিপ্রেক্ষিত এবং নায়ক-খলনায়কের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে উপজীব্য করে রচিত এ উপন্যাসটির কারণে শাহাদুজ্জামান ভূষিত হয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারে।
এছাড়াও শাহাদুজ্জামানের লেখা ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’, ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’, ‘অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প’, ‘মামলার স্বাক্ষী ময়না পাখি’ সহ ছোটগল্পের বইগুলো মননশীল সাহিত্যপাঠের তালিকায় আবশ্যিক হয়ে আছে। নিছক গল্প পড়ার বাইরেও এসব গল্পগুলো আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে, ফেলে দেবে এমন এক টানাপোড়েনের মাঝে, যেখানটা হয়তো আপনি এড়িয়ে গেছেন বহুবার।
আরও পড়ুন- ঢাকার মূর্খতা ও জড়তার কারণে হুমায়ূন এখনো অপঠিত
শাহাদুজ্জামানের সব বই দেখতে ক্লিক করুন