একজন সাহিত্যিক তার জীবনকালে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত তাকে প্রকৃতি, বন্ধু স্বজন, বইপত্র একটু একটু করে সমৃদ্ধ করে। এসব নিয়ে তৈরি হয় নানা মত-অভিমত। কোনো বিষয়ের সাথে হয় ঐক্য আবার কোনো বিষয়ের সাথে হয় দ্বিমত। কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখায় কবি সাহিত্যিকদের কর্ম নানা কারণে ইতিহাস হয়ে যায়।
“আমার প্রথম দিককার লেখালেখির কথায় মনে পড়ে ১৯৬২-’৬৩ সালের কথা। তখন ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হয়েছি কলেজে। পড়ার নেশা আর লেখার নেশা দুটোই তখন তুঙ্গে। লিখি খাতায়, তারপর রুল টানা কাগজে গোটা-গোটা অক্ষরে কপি করি, শেষে খামে ভরে ডাকযোগে পাঠাই সম্পাদকের দপ্তরে। আশা করি, ভাল লিখেছি তাই ছাপা হবেই। আবার আশঙ্কা করি, অখ্যাত মফস্বল টাঙ্গাইল শহরের জলজঙ্গলে ভরা আকুরটাকুর পাড়া থেকে ১৪-১৫ বছরের এক সদ্যকিশোরের লেখা কি রাজধানী ঢাকার দামি পত্রিকার নামী সম্পাদক খুলে দেখবেন? কষ্ট করে পড়বেন? আমার দুরু-দুরু বুকের ভীরু আশঙ্কা মিথ্যা হয়েছে সবসময়েই। দেড়-দুমাসের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি কখনও। আমার লেখা কবিতা ও গল্প ছাপা হয়েছে সওগাত, মোহাম্মদী, আজাদ, জনতা, চিত্রালী, রমনা, ছায়াপথ, পাকিস্তানী খবর ও আরও অনেক পত্র-পত্রিকায়।”

নিজের লেখালেখির প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন লেখক সাযযাদ কাদির। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ-গবেষণাসহ সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন দুহাতে। আলোচ্য এ বইিটর নাম ‘সহচিন্তন’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় একুশে বইমেলা ২০১৪ সালে। এ বইটিতে তিনি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে নানামুখি আলোচনা করেছেন। কখনো সে আলোচনা পক্ষে আবার কখনো সে আলোচনা বিপক্ষে।
“১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘বিচিত্রা’ প্রকাশিত হয় প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানের রম্য মাসিক হিসেবে। কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের আমন্ত্রণে ও কবি হাসান হাফিজুর রহমানের আনুকূল্যে ওই পত্রিকায় যোগ দেই সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ‘আনুকূল্য’ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমার যোগ দেয়ার ব্যাপারে নাকি ভেটো দিয়েছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। তাঁর আপত্তির কারণ, আমি নাকি রাগি ছোকরা! বেয়াদব! এ অবস্থায় হাসান হাফিজুর রহমান আমার অনুকূলে ভূমিকা রাখায় ‘বিচিত্রা’য় যোগ দেয়া সম্ভব হয় শেষ পর্যন্ত। তবে ‘রাগি ছোকরা’ পরিচয়টি অনেক ভুগিয়েছে আমাকে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রেস ট্রাস্ট ভবন অগ্নিদগ্ধ হলে হাসান হাফিজুর রহমান আমাকে যোগ দিতে বলেন লেখক সংঘের সাহিত্য মাসিক ‘পরিক্রম’-এ। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহোদয়ও আপত্তি তোলেন ওই কথা বলে, এই অ্যাংরি ইয়ং ম্যান কেন? হাসান হাফিজুর রহমান গ্রাহ্য করেন নি আপত্তি। মুখের ওপর কথা বলা ছাড়া আর কোনও ‘অভব্যতা’ তিনি দেখেন নি আমার মধ্যে। তাই বলতেন, ও তো যা বলার সামনেই বলে। আড়ালে কিছু বলে না। এটা তো ভাল। এতে ওর দুশমন হবে হয়তো তিনজন, কিন্তু বন্ধু হবে সাতজন।”
নিজের সম্পর্কে এভাবেই তুলে ধনের সাযযাদ কাদির। এরকম গুণাবলী থাকার ফলে সাহিত্যিক হিসেবে একটা র্নিমোহ, স্বতন্ত্র মতামত তিনি দিতে পেরেছিলেন। সাযযাদ কাদির ষাটের দশকের অন্যতম একজন কবি। তার দশক নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন- “কেবল পঞ্চাশ দশকের নয় তিরিশ-চল্লিশ দশকের অনেক কবির প্রথম বা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ষাটের দশকে। অন্যদিকে ষাটের দশকের কবি হিসেবে পরিচিত অনেকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সত্তর-আশি দশকে। ষাটের কবিতা ও কবিদের নিয়ে আলোচনা তাই বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। সে আলোচনা ছাড়া যাবতীয় ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বিচার হবে ব্যর্থ। এতে পতিভক্তি, ভ্রাতৃভক্তি, গুরুভক্তি, গোষ্ঠীপ্রীতি, ব্যক্তিপ্রীতি দেখা যাবে, ‘লাঠি খাওয়া সাপে’র কুক্রিয়াও দেখা যাবে সেই সঙ্গে। ভক্তি-প্রীতিতে গদগদ এই কুক্রিয়াশীলরা আবার কটু কথায় পটু। তাঁদের ‘সমালোচনা’ পড়লে মনে হয় তাঁরাই সবার উপরে। কিন্তু যেখানে সমালোচনার ভাষা যত তীব্র সেখানে যুক্তির যোগান ততো কম। এছাড়া আমাদের এখানে আর সমালোচক কোথায়?
ষাটের দশকে আধিপত্য ছিল পঞ্চাশের কবিদের। শামসুর রাহমান পুরো দশকই ছিলেন পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। শেষ দিকে পাঠকপ্রিয়তা পান সৈয়দ শামসুল হক ও আল মাহমুদ। এছাড়া বিশেষ আলোচিত ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ষাটের কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ পাঠকপ্রিয় হয়েছিলেন শেষ দিকে। পুরো দশকে আলোচিত ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। শহীদ কাদরী ও রফিক আজাদ প্রথম দিকে, ফরহাদ মজহার, হুমায়ুন কবির ও আবুল হাসান শেষ দিকে ছিলেন আলোচিত।
এ তো গেল পাঠকের বিচার। তবে সমালোচকীয় বিচার কি ষাটের কবি ও কবিতা সম্পর্কে? সে জন্য চাই বিস্তৃত পরিসর। কেউ পুরস্কারের জন্য কবিতা লেখেন না, তবে কবিতা লিখে পুরস্কার পান অনেকে। কখনও পুরস্কার খুঁজে নেয় কবিদের, কখনও-কখনও ‘কবি’রা খুঁজে-খুঁজে যোগাড় করেন পুরস্কারকে। কারণ কোনও-কোনও কবি লব্ধযশ থাকলেও অনেক ‘কবি’ থাকেন লুব্ধযশ।
আসলে কবিও তো তার জীবনপ্রযুক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেন এক-একটি কবিতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে সভ্যতা দিয়েছে তা আমাদের জন্যই, তার সৃষ্টি আমাদের দ্বারাই,- এই সভ্যতা আমাদের পক্ষে। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতা আখ্যা দিয়ে এর মধ্যে জীবনহীন যান্ত্রিকতা অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়া যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে কোনটি প্রতিক্রিয়া এবং কোনটি মহৎ উপলব্ধি তা অনেক সময়েই বুঝতে পারি না আমরা। কারণ, অনেক সময়েই আমাদের মুখোমুখি হতে হয় অপ্রত্যাশিত ব্যাখ্যার।
কবিতা ও গণআন্দোলন প্রবন্ধে লেখক বলেন- গণতন্ত্রের নামে গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে আমাদের। আমাদের সংবিধান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলোর একটি, আমাদের সংসদ ভবন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সংসদ ভবনগুলোর মধ্যে সেরা। তবে আমাদের এই এত ভাল সংবিধান প্রায়ই অকার্যকর থাকে, আমাদের এই এত সুন্দর সংসদ ভবনে প্রায় সারা বছরই অচল থাকে সংসদ। একই ভাবে মহাতোড়জোড় করে নির্বাচন করি আমরা, কিন্তু ভোট গ্রহণ হয় এক রকম আর ভোট গণনা হয় আরেক রকম।
আমাদের রাজনৈতিক দল আছে অনেক, রাজনীতিক আছেন অনেক; তবে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে পড়ে পরোপকারের নামে নিজের উপকার। আমাদের প্রশাসন সামন্ত ও ঔপনিবেশিক যুগের চলন বলন পছন্দ করে না, কিন্তু তাঁরা প্রায় সবাই মনমেজাজে শাসক – কেউই সেবক নন।
বাংলা সাহিত্যের জীবনধারা ও শিল্পধারার অনেক অজানা তথ্য তিনি অনায়াসে প্রকাশ করেছেন বইটিতে। তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, সাহিত্যিক বন্ধু, কর্মজীবনে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস ও সেখানকার অভিজ্ঞতাসহ নানা স্মৃতি থেকে লেখা এ বইটি। একজন সাযযাদ কাদিরকে অতিক্রম করে বাঙালি ও বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশের চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয় আশির দশকের মধ্যভাগে। ডেস্কটপ পাবলিকেশন (ডিটিপি) রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে প্রকাশনা জগতে। তবে শহীদলিপি, মইনুললিপি থেকে আজকের ‘বিজয়’ পর্যন্ত যে উত্তরণ এর প্রাণপুরুষ অবশ্যই মোস্তাফা জব্বার, তবে এই উত্তরণের সূচনালগ্নে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেছে রতনলিপি, উদয়নলিপি ও পাক্ষিক তারকালোক। ডিটিপি’র অবদান হিসেবে মোস্তাফা জব্বারের ‘আনন্দপত্র’ পথিকৃৎ হলেও এর প্রথম সার্থক ব্যবহার ঘটে ‘তারকালোক’-এ (১লা অকটোবর, ১৯৮৭)।
যথোচিত পৃষ্ঠাসজ্জার মাধ্যমে সেই প্রকাশনা রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে ডিটিপিকে। ‘আনন্দপত্রে’র এক সম্পাদকীয়তে এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, এই সাফল্য ছাড়া সম্ভব ছিল না ডিটিপি’র দ্রুত উত্থান। পরে অবশ্য সবাই বেমালুম চেপে যান বিষয়টি। তাহলেও ‘তারকালোক’ পরিবারের প্রধান আরেফিন বাদলের উদ্যোগ ও আয়োজন, সম্পাদক হিসেবে আমার এবং আমার দুই সহকারী মবিন খান ও নূরজাহান বেগমের শ্রম ও নিষ্ঠা একেবারে অস্বীকৃত থাকবে – তা আমি মনে করি না।
এছাড়া বিভিন্ন কবি যেমন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রহমান, ফররুখ আহমদকে নিয়ে তার স্মৃতি ও তাদের লেখা সম্পর্কে তার খোলামেলা অভিমত আছে বইটিতে। ২১৪ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ বইটি পাঠ করলে পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অনেক ইতিহাস জানা যাবে। সাহিত্যের পাঠক ও সাহিত্যের ছাত্রদের জন্য বইটি সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।
সাযযাদ কাদিরের অন্যান্য বই দেখতে ক্লিক করুন
সাহিত্যদেশ প্রকাশনীর বইগুলো দেখুন