অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বহুদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে ‘আলোর ইশকুল’, ‘আলোর পাঠশালা’ ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা সত্বেও তিনি শিক্ষক হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়। জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলাদেশে মানুষের কাছে ‘স্যার’ নামে খ্যাত। জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানরত এই শিক্ষক এখনও অতিথি বক্তা হিসেবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গিয়ে দেশ ও মানবতার সপক্ষে যুবসমাজকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, মেধা, চিন্তা ও ভাবপ্রকাশের ভিন্নতার কারণে তিনি অগণিত শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছেন। গুণী এই লেখকের কিছু জানা-অজানা তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রথম গল্পের মজার গল্প
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন গল্প লিখতে শুরু করেন, তখন তাঁর প্রথম গল্পই হয়ে গেল ৩৫ পৃষ্ঠা! এ সময় অনেকে তাঁকে বলল, এটা তো উপন্যাস হয়ে গেছে। তিনি বললেন- না, এটা উপন্যাস নয়। এটার যে প্রবণতা, সেটা গল্পের এবং শেষে এক বিজ্ঞ সম্পাদক এটাকে উপন্যাস হিসেবেই ছেপে দিল! তাতে অবশ্য লেখক একটু বেশি টাকা পেয়েছিলেন। পরে ওরকম আরও চার-পাঁচটা গল্প তিনি লিখেছিলেন। এর অনেক পরে তিনি টের পেলেন, ওগুলো ছোট গল্প নয়, ওগুলো বড় গল্প।
মুনীর চৌধুরীর প্রভাব
মুনীর চৌধুরীর সাথে আবু সায়ীদের যখন পরিচয় হয় তখন তিনি একজন ভালো শিক্ষক এবং সেকালের প্রগতিশীল কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে দেশব্যাপী পরিচিত। বাগেরহাট ও পাবনায় থাকা অবস্থাতেই মুনীর চৌধুরীর আপোষহীন রাজনৈতিক ভূমিকা এবং তাঁর বোন নাদেরা চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। অবশ্য প্রথম দিনের দর্শনে মুনির চৌধুরীর নীরব নির্বিকার চেহারা দেখে তিনি কিছুটা যেন হতাশই হয়েছিলেন। এর কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, রাজনীতি থেকে সরে আসার পর সংঘাতহীন নিস্তরঙ্গ জীবন বেছে নেওয়ায় তাঁর চৈতন্য ও বোধের জগৎ থেকে আগের সেই দীপ্তি ও সজীবতা ঝরে পড়েছিল। মুনির চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মুনীর স্যারের পড়ানো ছিল অনবদ্য। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়িয়েছিলেন। পড়ানোর প্রাণবন্ত সরস উচ্ছলতার ভেতর দিয়ে ছোটগল্পের যে নিগূঢ় রস তিনি আমার ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা আজও আমার মনের ভেতরকার শিল্পভাবনাকে অনেকখানি প্রভাবিত করে রেখেছে।
কিন্তু যে জায়গায় তিনি তাঁর যুগের সবাইকে অতিক্রম করেছিলেন সেটা হচ্ছে বক্তৃতা। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাফল্য এসেছিল এখানেই। তরুণ বয়সে ‘কবর‘ বা ‘মানুষ’ এর মতো নাটক বা রাজনীতির জ্বলজ্বলে সাফল্যের পর আর একবার তাঁর সাফল্য ঝিকিয়ে উঠেছিল এই জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ থেকে শুরু করে অন্তত দুই বছর পর্যন্ত তাঁর বাচনভঙ্গী আমার নিজের কথা বলার ধরন ধারণকেও প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল।’ নানা বিষয় নিয়ে মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর উষ্ণ ও আন্তরঙ্গ আলোচনা হত। তাঁর শ্রদ্ধেয় মুনীর স্যারের যে গুণ আজও তাঁকে প্রভাবিত করে রেখেছে তা হচ্ছে তাঁর অপরিসীম উদারতা ও সহৃদয়তা। তিনি আরো বলেন, ‘অসামান্য প্রতিভার অধিকারী মুনীর স্যারের কাছ থেকে আমরা যতটা পেতে পারতাম তাঁর অনেক কিছুই হয়ত আমরা পাইনি আর সেই দুঃখ আজও আমি ভুলতে পারিনা। কিন্তু তাঁর অনবদ্য শিক্ষকতা, বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, অসাধারণ বক্তৃতা প্রতিভা, সুবিপুল মমত্ব, মানবিক দুর্বলতা, ক্ষমা করার অসীম ক্ষমতা, অপরিমেয় গুণগ্রাহিতা ও নাট্যামোদী সদা আনন্দিত হৃদয় এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়ে প্রজ্জ্বলিত নিদ্রাহীন উত্সাহ আমার মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি আমাকে যতটা প্রভাবিত করেছিলেন, আর কেউ হয়ত ততটা করেননি।’
ব্যাকরণের শিক্ষক
কলেজে যোগ দেয়ার পর আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে পড়াতে দেয়া হয়েছিল ব্যাকরণ কিন্তু ব্যাকরণ ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বিরক্তির বিষয়। রুটিন দেখে তিনি একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু ব্যাকরণ পড়াতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি এক আশ্চর্য আনন্দ জগতের সন্ধান পান। তাঁর ভাষায়, ‘শতাব্দী শতাব্দী ধরে হাজার কোটি মানুষের সজীব চিত্তের দীপ্তি আর আলো দিয়ে তৈরি আমাদের যে ভাষা, ব্যাকরণতো সেই ভাষারই বর্ণনা। জীবনের প্রতিমুহূর্তের আবেগ, প্রেম, যন্ত্রণা, বিস্ময় উৎসাহ আর খুশিতে প্রাণ পেয়ে জনমানুষের মুখে মুখে রচিত উচ্চারিত বিচ্ছুরিত আমাদের অনিন্দ্যসুন্দর যে ভাষা, হীরের টুকরোর মত দীপ্ত অজস্র শব্দের প্রতিমুহূর্তের উত্প্রাণতায় যা উজ্জ্বল আর নৃত্যশীল, ব্যাকরণ তো সেই বৈভবেরই সজীব বিবরণ। ভাষার প্রাণোজ্জ্বলতার এই দীপ্র রহস্য যতই অনুভব করতে লাগলাম ততই অবাক হতে লাগলাম। আমার হৃদয়ের সেই জেগে ওঠা বিস্ময় এবং জীবনের প্রথম ছাত্রছাত্রীদের চোখের সামনে সেই অপার ঐশ্বর্য মেলে ধরার আনন্দেই আমার মুন্সীগঞ্জ কলেজের দিনগুলো একধরণের অলীক খুশির ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেছে।’
ছাত্রদের মন্ত্রমুগ্ধতা
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ক্লাসে সকল ছাত্র তাঁর কথা শুনতে চাইত। যদি কেউ কখনো বাঁদরামি করতে চাইত তাহলে অন্যেরা তাকে দমন করত। ক্লাসে ছাত্ররা কখনো তাঁকে প্রশ্ন করত না। কেউ করতে চাইলেও অন্যরা করতে দিত না। থাম, বসে পড়… মাতব্বর হয়ে গেছে… এইসব বলে থামিয়ে দিত। এবং তাঁকে ক্লাসে সারাক্ষণ কথা বলতে হতো।
বাড়াবাড়ি
একবার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ক্লাসে একজন রবীন্দ্রনাথের “গোরা” নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিল, গোরার কাজকর্ম তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। স্যার তো তাকে ধুয়ে দিলেন একেবারে। বললেন, ‘শক্তিমান মানুষের পরিচয় হচ্ছে বাড়াবাড়িতে। এই যে তোমার আশেপাশে এত সমস্যা, এত কিছু হচ্ছে। কই তোমার তো কোন বাড়াবাড়ি দেখি না।’
আলোকিত মানুষ
আলোকিত হওয়া নিয়ে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন মজা করে বলছিলেন, কেন্দ্রের একটা কাজে একবার ঘুষ দিতে হয়েছিল। কাজটি যে করেছিল সে একসময় কেন্দ্রের সদস্য ছিল, তাই সে অন্যদের কাছ থেকে যা নিত তা থেকে ২৫% ডিসকাউন্ট দিল। সেটা স্মরণ করে স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘কে বলল আমরা আলোকিত করতে পারিনি, এই যে দেখ অন্তত ২৫% তো আলোকিত করতে পেরেছি!!!’
দালান তোলা
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ যেস্থানে কেন্দ্র খুলে বসে আছেন (বাংলামটরে) সেখানে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে কিন্তু আশেপাশে থেকে মানুষ উঁকি দিয়েও দেখেনি এখানে কী হয়। স্যারের এক খালার বান্ধবী থাকেন বাংলামটরে। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের নিজস্ব বহুতল ভবন উঠতে দেখে একদিন সেই বান্ধবী স্যারের খালাকে ফোনে স্যারের সম্পর্কে বললেন, ‘নারে ভাল কাজই তো করত মনে হয়, আমরাই বুঝতে পারিনি। দালান তুলে ফেলেছে!’
গুগলি
প্রাক্তন ছাত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর সাথে দেখা করতে এলো। বললো, ‘স্যার, আমি মুনশি ফয়েজ, ঢাকা কলেজের ৬৯ ব্যাচের ছাত্র। শুনলাম আপনি এখান দিয়ে যাবেন। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ স্যার বললেন, ‘ও তাই নাকি? তুমি কেমন আছো?’ স্যারের সহাস্য উত্তর। চিনুন বা না চিনুন হঠাৎ দেখা অচেনা ছাত্রদের এভাবেই হাসিমুখে সম্ভাষণ করেন তিনি। প্রাক্তন ছাত্র বলল, ‘স্যার খেয়াল আছে, আপনি আমাদের ‘হৈমন্তী’ পড়িয়েছিলেন। কিন্তু সারা বছরে শেষ করেন নাই।’ স্যার এবার একটু সময় নিলেন। তার অব্যর্থ গুগলিটা ছাড়লেন। ‘আরে বাবা শেষ করি নাই বলেই তো এখনো মনে রেখেছো। এই মাঝরাতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো।’