ডিসেম্বরের ছুটিতে যখন সব বন্ধুরা চুটিয়ে সিনেমা দেখছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে সেরকম এক দুপুরে বাবার সামনে পরে গিয়েছিলো ছেলেটা। স্কুল মাস্টার বাবা তো এক কাঠি সরেশ। বাবা তাকে ছুটির দিনগুলোতে ধরিয়ে দিলেন আরো কঠিন পড়াশোনা। প্রতিদিন টেনিসনের ‘কালেকটেড ওয়ার্কস’ বইটা থেকে অন্তত দু’টো করে ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করতে দিলেন স্কুল পড়ুয়া বালককে। অনুবাদের কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট বছর শেষের এই ছুটিতে ঘরে বসে থাকা। কিন্তু একদিন অনুবাদের বদলে একটা কবিতা নিজেই লিখে ফেললো নিজের বান্ধবীকে ভেবে। তবে বান্ধবীর ঠিকানায় না পাঠিয়ে কবিতাটি পাঠিয়ে দিলেন বাংলা ভাষার বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায়। যেদিন কবিতাটি ছাপা হলো সেদিনের তারিখটা ৩১শে মার্চ ১৯৫১। নামের পাশে ছাপা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
চোখ বন্ধ করলে বুঝি কোলকাতার লেখক সুনীল যেন দিনে দিনে আমাদের হয়ে উঠেছিলেন। সুনীল-সমরেশরাও আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে পুরোপুরি ভাবে মিশেছিলেন বাংলাদেশি পাঠকদের সাথে। বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের আগে তৎকালীন লেখকরা যতটা না জনপ্রিয় ছিলেন, তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন ওপার বাংলার সুনীল-সমরেশরা। কিন্তু কীভাবে এই মিশে যাওয়া?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের সেই সময়কে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এখানে যেমন রয়েছে আত্মিকতার টান, তেমনি রয়েছে ঢাকার সাহিত্যের সেসময়কার দুর্বলতা ও বইয়ের বাজারের দৌড়াত্মের প্রশ্নও। আমরা যদি খুব নিবিড় ভাবে সেই সময়টাকে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখবো বাংলাদেশের বই কোলকাতায় যাওয়াটা ছিলো প্রায় অসম্ভব। অপরদিকে কোলকাতার বই বাংলাদেশে ঢুকতো নির্দ্বিধায়। মজার ব্যাপার হলো, সেই সময়ে বইমেলায় কোলকাতার বই থাকা না থাকা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলেছিলো। সেই বিতর্কের ইতি অবশ্য টেনেছে বহু আগেই। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদার দিনে দিনে বাংলাদেশের পাঠকের কাছে খুব বেশিই পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। তখন বই পাওয়াটা এতটা সহজ না থাকলেও প্রচুর মানুষ তাদের বই কিনতো। বলা হয়, আশি থেকে নব্বই দশকের মধ্যে বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে সুনীল-সমরেশদের বই পড়াটা ছিলো রেওয়াজের মত।

আদতে দামের হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদার এর লিখিত বইগুলো ওতটা সহজলভ্য ছিলো না। মধ্যবিত্ত পরিবারের পাঠকদের জন্য বইগুলো কেনা বেশ কষ্টকরই হবার কথা। তবে ঠিক সেসময় কিছু অসাধু লোক এই সময়টার সুযোগ নেয়। তারা পাইরেসি করার একটা দারুণ সুযোগ লুফে নেয়। কোলকাতার অরজিনাল বইগুলোর চেয়ে খারাপ মানের কিছু বই বাজারে প্রচলিত হতে শুরু করলো। কিন্তু এগুলোর মান ছিলো খুবই বাজে। তবে প্রায় অধিকাংশ পাঠকই দামের দিকে ভেবে অরজিনাল প্রিন্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। শুধু যে এটিই কারণ তা কিন্তু নয়। ঢাকায় অবস্থান করা বেশির ভাগ তরুন তরুনীরা বই কিনতো নিউ মার্কেটের সামনে নীলক্ষেত থেকে। সেখানে একটা সময় অরজিনাল কপি পাওয়াটাই দুস্কর হয়ে পরলো। সেসময়কার পাঠকদের সাথে কথা বললে বোঝা যায় সময়টা কিরকম ছিলো। হুট করেই নিউজ প্রিন্ট কাগজে বাজে কালি দিয়ে লেখা সুনীল কিংবা সমরেশের বই ছাপা হতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম মনে হতো এ যেন সুনীল-সমরেশের লেখাই নয়!
তবে তারচেয়ে বড় একটা কারণ ছিলো সেসময় বাংলাদেশে লেখকদের খুব একটি সক্রিয় না পাওয়া। সত্যি বলতে সেই সময়তে যারা লিখেওছেন তাদের লেখা সেভাবে পাঠ হতো না। অনেকে আবার কম লিখতেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নব্বই দশকে লিখেছেন। তিনি মাত্র দুটো উপন্যাস আর বত্রিশটি গল্প লিখেছেন। অথচ এক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই লিখেছেন চারশোর মত বই। তাই প্রতি বছর কিংবা যে কোন উৎসবে সুনীল-সমরেশদের সরব উপস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশী লেখকদের সেভাবে দেখা মিলতো না। আর আগেই বলেছি, পাইরেসির কারণে বেশ সহজেই বই পাওয়া যেত। অরজিনাল প্রিন্ট না পেয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে সেগুলোই কিনতো। কিন্তু বাংলাদেশী তৎকালীন লেখকরা সেসময় বিশেষ করে সেভাবে তরুন-তরুনীদের মনে সুনীল-সমরেশদের মত ছাপ ফেলতে পারেননি।
আরেকটা ব্যাপার হলো, সেসময় সুনীল-সমরেশরা সব বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য লিখতেন। কিছুটা বাজারী ব্যাপার ছিলো তো বটেই; কিন্তু সব কিশোর থেকে তরুনদের উপযোগী বই একই লেখকের হওয়ায় সেগুলো স্বার্বজনীন হয়ে যেত সহজেই। সুনীল সেসময় নিয়মিত লিখে গেছেন ‘সন্তু ও কাকাবাবু’ সিরিজ। প্রথম যেবার কাকাবাবু বের হলো তখন কিশোরদের মধ্যে সাড়া পরে গেলো বলা চলে। অন্যদিকে সমরেশ মজুমদার লিখে চলেছেন কালপুরুষ কিংবা কালবেলা’র মত বিখ্যাত সব উপন্যাস। পশ্চিম বঙ্গ তো বটেই, পুরো বাংলা ভাষাভাষী মানুষই সেসব দেদারসে গিলছে। অপরদিকে যেহেতু শিশু কিশোররা পাচ্ছে নতুন সব এডভেঞ্চার সেহেতু সুনীল কিংবা সমরেশদের আপন করে নিতে আমাদের খুব বেশিদিন লাগেনি। সেসময় একজন ক্ষুব্ধ কিশোর বয়সী পাঠক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, তিনি যেন কাকাবাবু ছাড়া অন্য কিছু লিখে সময় ব্যয় না করেন।
এভাবে ধীরে ধীরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমরেশ মজুমদার কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়’ রা আমাদের সাথে মিশে গেছেন অকপটে। কিন্তু আসলে কি শুধু এসব কারণেই এতদিন ধরে আমাদের মাঝে টিকে আছেন তারা? নাকি তাদের লেখার উপাদেয় বেড়েছে দিনকে দিন? সুনীল-সমরেশদের যাত্রায় তাদের লেখালেখির গভীরতা আসলে কতটুকু ছিলো? চলুন এক নজর ডুব মারা যাক।
সমরেশ মজুমদার দিয়েই শুরু করা যাক। তার বিখ্যাত ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ বইগুলো আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। সেগুলোর গল্পগুলো কেন আমাদের ছুঁয়ে গেছে? গল্পগুলো তো আমাদেরই। ট্রিলজির প্রথম বেরিয়েছিলো উত্তরাধিকার। এই উপন্যাসের কাহিনী চা বাগান থেকে শুরু, যেখানে অনিমেষের শৈশব কাটে। এ যেন আমাদের দেশেরই সিলেটের কোন চা বাগানের পাশে বেড়ে ওঠা অনিমেষের গল্প। সেই অনিমেষের নাম হয়তোবা ভিন্ন। সমরেশ মজুমদার এজন্যই বলেছিলেন, ‘সিলেটের চা বাগান আমাকে খুব করে টানে। এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠলে কোলকাতা আর বাংলাদেশের চা বাগানের কোন পার্থক্য পাই না।‘ সমরেশের বিখ্যাত ট্রিলজির প্রথম উপন্যাসই যেন বাংলাদেশের গল্প বলে। অখন্ড ভারতে চলা একটি সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থান পতনের গল্প বলেছে উত্তরাধিকার বইটি। জাতি হিসেবে যা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিংবা সাতকাহন বইটির দীপাবলি নামের মেয়েটার গল্প আমাদের স্পর্শ করে। কেন দীপাবলীর মতো এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এলো এ প্রশ্নের উত্তরে সমরেশ বলেছিলেন, “আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি।”
সমরেশ বাংলাদেশকে কাছের মনে করেছেন বাস্তবিকভাবেই। তিনি বরাবরই স্পষ্ট ভাষার মানুষ। কিছুদিন আগেও সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের রাজধানী বাংলাদেশ। সমরেশকে আমরা আরো পেয়েছি সিনেমায়। গৌতম ঘোষের পরিচালনায় কালবেলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলা ভাষার সিনেমা কখনই আমরা দু’ভাগ করতে পারেনি। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা বইটি আশির দশকে বের হলেও তারপরেও প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেটি ছিলো বেশ জনপ্রিয়। অবশ্য এখন যে আর জনপ্রিয় নেই সেটা বললে বড় ধরণের ভুল বলা হবে।
কিংবা সমরেশের কথাই ধরুন। এ যেন প্রতিবেশী দেশের নাগরিক কিন্তু আমাদেরই মানুষ। নিজেরা নিজেরা বের করতেন কৃত্তিবাস নামের একটি পত্রিকা। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা ছাপা হয়ে পড়ে আছে প্রেসে। পয়সার অভাবে ছাড়াতে পারছেন না। মাসিক ‘জলসা’ পত্রিকা উপন্যাস চাইল সুনীলের কাছে। ওই প্রেসে বসেই টানা লিখে ফেললেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। সত্যজিৎ রায় সিনেমা করে আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে দিলেন। সুনীলদার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসটি নিয়েও সিনেমা করলেন সত্যজিৎ রায়। উপন্যাসের নায়কের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে এসেছে কোলকাতা শহর। এভাবে সিনেমার গল্প হয়ে আমাদের চোখের সামনে বারংবার আপন হয়েছেন সুনীল-সমরেশরা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের সাথে মিশেছেন কবিতা দিয়ে। এ যেন বোহেমিয়ান জীবনের এক অনন্য আখ্যান। সেই ষাটের দশকে বের হওয়া ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি যেন প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে আমাদের আপন হয়ে আছে। কী নিদারুন জীবনের গান! ‘যদি নির্বাসন দাও’ কবিতার সেই দুটি লাইন—
‘বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ,
এ আমারই সাড়ে তিনহাত ভূমি’
এ লাইন আমাদের রক্তে কাঁপিয়েছে বারংবার। কপোত-কপোতিদের মুখে মুখে ফিরেছে ‘ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে’।
এভাবে অসংখ্য রঙ্গে আমাদের সামনে সমরেশ-সুনীলরা বারবার এসেছে। নব্বই দশকের যুগে যখন আমাদের দেশের কিশোর থেকে যুবক বয়সী পাঠকেরা বই দেদারসে গেলার জন্য ভীড় করতো, ঠিক তখন যেন আমাদের গল্পগুলোই ফেরি করে বেড়ানোর ফাঁদ পেতেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদাররা। এত্ত বছর পর যখন সুনীল কিংবা সমরেশের কোন বই খুলি, তখন মনে হয় সুনীলের কবিতার মত ‘বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ, এ আমারই সাড়ে তিনহাত ভূমি’। গল্পটা যেন আমাদের খুব কাছের কারো। অথবা গল্পগুলো আদতে আমাদেরই। দিনে দিনে এভাবেই সময় কাটলেও সুনীল-সমরেশরা আমাদের আপন হয়ে উঠেছেন ক্রমেই। দু’বাংলার এই বোহেমিয়ান জীবন দর্শনের দিকমাত্র মিলে গেছে সুনীল-সমরেশদের হাত ধরেই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত) এর বই সমূহ
সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ
comments (0)