আমার এক স্কুল বন্ধু এক থেকে একশ’ পর্যন্ত সব শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারতো, শুধু উনিশ ছাড়া। তার রোল নাম্বার ছিল উনিশ। সে বলতো, উনিছ। সেই বাল্য বয়সে সামান্য ভুলচুক হলে, সেটাই হয়ে যেত বিরাট হাসির খোরাক। তারপর সেই ভুলটা নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত। যেমন তার নাম হলো উনিছ। কারও কারও জন্যে এমনই নিষ্ঠুর ছিল আমাদের যুগের বাল্যকাল।
সে বিশ উচ্চারণ সঠিক করে, কিন্তু উনিশ উচ্চারণ সঠিক ভাবে পারে না। এর কারণ কী ? একে বলে অভ্যাস। স্নায়ু সংযোগে সহজ পথ তৈরী হয়। সেই সহজ পথটা ধরেই চিন্তা প্রবাহ গড়াতে থাকে (ইলেক্ট্রিক ইম্পাল্স)। অন্য ভাবে দেখতে গেলে, একটা অসমতল ভূমিতে যদি বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যেতে থাকে, সে নরম মাটির সহজ পথগুলো দিয়ে যায়। পরের বার সেই পথটা পানি গড়ানোর জন্যে আরও সুগম হবে। এভাবে ছোট ছোট আঁকাবাঁকা নালা তৈরী হবে এবং কিছুতেই নালার বাইরের উঁচু শক্ত জমি দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে না। মস্তিষ্কও তাই।
বদলাতে গেলে সামান্য সাধ্য-সাধনা করতে হবে। কিন্তু গড়ানো পানি সেই সাধ্য সাধনা করবে কেন? মানুষ যদি সহজ পথে গড়ানো পানি না হয়, তবে তার সাধ্য সাধনা করা উচিত। ভালো কিছুর জন্যে সাধ্য সাধনা। পড়া লেখা শেখাটাই সাধ্য সাধনা। ক্লাস ওয়ানের হাতের লেখার সঙ্গে ক্লাস এইটের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখুন। তফাৎটা হলো কোত্থেকে? লিখছে কি হাত? নাহ, আসলে তো মস্তিস্ক লিখছে। হাতের পেশির ব্যবহার আছে অবশ্যি, কিন্তু মস্তিষ্ক তাকে পরিচালনা করছে। মস্তিষ্ক আবার “পানির সহজ গড়ানো পথ” সূত্র অনুযায়ী চিন্তাকে এবং শরীরকেও পরিচালনা করে থাকে। তবে তাকেও পরিবর্তন করা যায়। পানির জন্যে যেমন একটু সুন্দর শৈল্পিক পথ তৈরী করা সম্ভব। তা করতে হলে নিপুণ ভাবে নতুন লেক খনন করতে হবে। এর কিছুদিন পরেই পূর্বের আঁকাবাঁকা খাদ গুলো বুজে যাবে। কিন্তু সেই “কিছুদিনের” কষ্ট করে কে? যদি করেও, সব বিষয়ে কি করে?
শেখা নাই, সুর নাই, একজন বেসুরো গলায় গান গাইতে শুরু করলো। নিজের কানে তো ভালোই ঠেকে , এমন কি আইয়ুব বাচ্চুই মন হয় । কই, ভুল তো দেখি না? ভুল ধরতে হলে ওস্তাদের কাছে যেতে হবে। অথবা মানুষকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
আচ্ছা, গান কি মানুষ গলা দিয়ে গায়? সেটাও ঠিক নয়। গানও মানুষ মস্তিষ্ক দিয়ে গায়। গলার স্বরযন্ত্রের পেশীগুলো সামান্য শক্তিশালী করতে হয় বৈকি, কিন্তু সেটা আসল ঘটনা নয়। পানি ঠিক দিকে প্রবাহিত করতে হলে, নিউরনের মধ্যে সেই নদী নিপুণ ভাবে তৈরী করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আজকাল না শিখেই সব কিছু হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে কারণ, নিজের কাছে তো ভালোই লাগে!
কয়েকটি উদাহরণ দেই। আমার এক ভাগ্নেকে বোঝালাম, ” ‘শীট’ শব্দটা খুবই খারাপ। একেবারে দুর্গন্ধ যুক্ত। তুমি হয়তো অভ্যাস বশে বলছো, মানেটা সেভাবে ভাবছো না। কিন্তু আমি প্রতিবার শুনতে পাচ্ছি, তুমি বলছো “গু”। এর বদলে “শুট” বলো। একই ফল। মনের ক্ষোভ কিছুটা প্ৰকাশ হলো, কিন্তু বিষয়টা আর দুর্গন্ধযুক্ত হলো না।” সে ব্যাখ্যাটা পছন্দ করলো, এবং কথা দিল সেও “শুট” বলবে।
কিন্তু সে কিছুতেই “শীট” বলা ছাড়তে পারলো না। কযেকটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম। সে কথার মধ্যে “শীট” বলে ফেলার পরে তাকে মনে করিয়ে দিতাম যে এই শব্দটা সে পাল্টাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিবারই সে অবাক হয়ে বলে, “কই, শীট বলি নি তো?” তারপর এক সময় সে আমাকেই অভিযোগ করে বসলো,, “আপনিও তো বলেন। সবাই এটা বলে।” ছয় মাস বিগত হওয়ার পরে বুঝলাম, সে কোনওভাবেই এটা বাদ দিতে পারবে না। এখন ‘শীট’ শোনার জন্যে প্রস্তুত হয়েই তার সঙ্গে কথা বলি।
এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, নিজের এবং অন্যের। নিজেরটা চোখে পড়ে না। অন্যেরটা ভালো না লাগলে সার্চ লাইটের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে চোখে পড়ে।
এক বন্ধু দাওয়াত দিয়ে ভুলে যায়। “শনিবার সকালে আমাদের সঙ্গে নাস্তা করো।” বললাম “ঠিক আছে।” বন্ধের দিন একটু বেশি করে গড়িয়ে নিয়ে ন’টায় তৈরী হলাম। তার ফোন আসে না। ভাবলাম, সেও একটু বেশি করে ঘুমিয়ে নিক না হয়। এগারটায় পেট চোঁ চোঁ করা শুরু করলো। সাড়ে এগারোটায় ফোন দিলে তার ওদিক থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। সে বললো, “ব্যস্ত, পরিবার সহ আপেল পিকিং এ যাচ্ছি।”
পাঁচ বছর পরে সেই বন্ধু আবার একদিন খুব করে বৈকালিক আড্ডায় ডাকলো। ভাবলাম এতদিনে স্বভাব বদলে গেছে। কোথায় কী! বিকেলে তার বাসায় যাওয়ার আগে একটা কল দিয়ে দেখে নিতে গেলাম। সে তখন শিল্পী ভাবীর বাসায় চটপটি খাচ্ছে। খেতে খেতে অস্পষ্ট স্বরে বললো, “কাল ফোন দিব।”
আমার একটা বড় দোষ আছে, একই প্রশ্ন বার বার করা। একই গল্প একই মানুষকে সবিস্তারে বারবার বলা। আমার আবার গতি চলে এলে বাক্যের মধ্যে দমও ফেলি না যে সামনের মানুষটি “এইটা তো আগে শুনেছি” বলার কোনও অবকাশ পাবে। সহসা মানুষ কথায় বাগড়াও দিতে চায় না। একদিন লক্ষ্য করলাম, কোনও একটি গল্প বা ব্যাখ্যা সোৎসাহে বলা শুরু করতেই মানুষ অন্য কিছু করার ভান করে উঠে যেতে লাগলো। তখন বুঝলাম, এটা আগে কমপক্ষে চারবার ঠিক এভাবেই বলেছি। বিষয়টা নিজে কিছুতেই ধরতে পারি না। কারণ, কাকে বলেছি আর কাকে বলি নি, সেটা এমনকি পরের দিনও কোনোভাবেই মনে রাখতে পারি না। তবে বড় ধরণের আরও কী কী অভ্যাস বা মুদ্রা দোষ আছে, তা সব তো নিজেও জানি না। যা জানি সেগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে নির্দোষ, বাকিগুলো কহতব্য নহে।
অন্য কথায় আসি। প্রায় উনিশ বছর পর একবার দেশে গিয়ে ঢাকার রাস্তায় বাল্য বন্ধু ‘ঊনিছের’ সঙ্গে দেখা। আমার সঙ্গে আরেক বাল্য বন্ধু ছিল। আমরা দুজনেই তার নাম ভুলে বসে আছি। একে অপরকে বললাম, “ওই যে ঊনিছ।” সে কাছে এলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম, তাতেই সে জানালো, সে এখন মালয়েশিয়ায় থাকে, এ মাসের ‘উনিছ’ তারিখে দেশে এসেছে। আর তার রোল নাম্বার এর মতো প্লেনের টিকেটটাও কেন ঊনিশ তারিখেই হতে হবে, সেটাও একটা পরম আশ্চর্য। প্রায় প্রথম বাক্যেই আমরা সেই বাল্যবন্ধুকে অবিকল ফিরে পেলাম।
বহু বছর ধরে ভেবেছি ভাবতাম যে সাউথ ইন্ডিয়ার বিশেষ জায়গার যারা ইংরেজি অক্ষর এইচ কে “হেইচ” বলে, তারা নিশ্চয়ই খুব লজ্জার মধ্যে থাকে। একদিন এক সাউথ ইন্ডিয়ান বন্ধুকে “হেইচ” বিষয়ে বলতেই সে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “না তো? আমি তো হেইচকে হেইচ-ই বলি। ভুল উচ্চারণ করবো কেন?”
সঙ্গে সেই ভাগ্না ছিল, সে পরে বললো, “শীট, ও তো জানেই না যে ভুল উচ্চারণ করছে?”
যাই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের ভুল গুলোকে খুব সযত্নে লালন করতে চাই। আর পানি যেদিকে সুবিধা পায়, সেদিকে দিয়ে গড়িয়ে পড়ার মতো করে, চিন্তাধারা, অভ্যাস, কাজ কারবার, জীবনটাকেও অনেকটাই সেইদিকে গড়াতে দেই। স্কুল কলেজে কিছু শেখা হয়। বাবা মার বকুনিতেও বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে। তবে একজন এইসব পেড়িয়ে সংসার আর চাকুরী জীবনে ঢুকে থিতু হওয়ার পর তাকে আর কে বোঝায়। খুবই নামীদামী কেউ হেড়ে গলায় গান গাওয়া শুরু করলো, গানের মধ্যে যে একটা সুর ও ছন্দ আছে, সেটা নিজে বুঝলে তবে তো? নিজের সবকিছুই তো নিজের কাছে ভালো লাগে, সে গান হোক, নিজের কবিতা হোক, অথবা পছন্দের কোনো খাওয়া-খাদ্য হউক না কেন। যে শুঁটকি পছন্দ করে তার মনে হয়, যে শুঁটকি খায় না তার জীবন অর্ধেক বৃথা। যে অপছন্দ করে সে ভাবে, এতবড় অরুচিকর খাবার আমি খাবো? ইস কি দুর্গন্ধ! দুজনেই অন্যের থেকে নিজেকে উঁচুদরের বলে ভাবছে, এবং আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। বিষয়টা নিছক অভ্যাসের, অথবা অনভ্যাসের।
একটু সময় নিয়ে, কষ্ট করে নালা খনন করলে পানি আমাদের প্রয়োজন মতো পরিমাণে, প্রয়োজন মতো দিকে গড়িয়ে কাজের কাজ করিয়ে নিতে পারি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। চলুক এইসব “শীট”।