১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই। তখন মধ্যরাত। উত্তর ফ্রান্সের অভঁর গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে একা একা হাঁটছিলেন ভ্যানগখ। হাঁটতে হাঁটতে একটি গম ক্ষেতের সামনে এসে দাঁড়ান। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ছবিও আঁকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ জমলো না। এক ধরণের অস্থিরতা।
ঘরে ফিরে রাতের খাবারটুকুও খেলেন না, সোজা বিছানায় শুয়ে পরলেন। পূবের আকাশে সূর্য তখনও উঁকি দেয় নি। এমন সময় ভূতুড়ে এক কাজ করে বসলেন এই চিত্রকর, বলা নেই কওয়া নেই সোজা নিজের বুকে গুলি চালিয়ে দিলেন। এখানেই শেষ নয়, বুকে গুলি করে সারা রাত ধুমপান করলেন ভ্যানগখ! এমন কান্ড শুনে পরদিন ছোটভাই থিও ছুটে এলেন । কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না ভাইকে। গুলি করার প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা পর ভ্যানগখ মারা গেলেন! অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন। ভাবছেন, এতটা পাগল হয় নাকি কেউ? সত্যিই, একটু তো পাগলাটে ছিলেনই, তবে তিনি যতটা না পাগল ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী ছিলেন। তাই তীব্র হতাশায় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে মারা যান এই গুণী চিত্রশিল্পী। চলুন, রহস্যময়ী এই শিল্পের পুরো গল্পটা জেনে আসা যাক।

১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ বেলজিয়াম সীমান্তবর্তী নেদারল্যান্ডের ছোট এক গ্রামে তাঁর জন্ম। পুরো নাম ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যানগখ। তাঁর নাম নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। ভ্যানগখ নাকি ভ্যানগঘ? কেউ কেউ তো ভ্যানগগও বলে থাকেন। তবে মজার ব্যাপার হলো ডাচরা তাঁকে এগুলোর একটাও ডাকতেন না। নেদারল্যান্ডে তাঁকে ভ্যানগখ বলে ডাকা হতো। তবে ব্রিটিশ উচ্চারণ ‘ভ্যানগখ’ নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন।
ভ্যান গখ
ছোটবেলা থেকেই ভ্যানগখ একা থাকতে পছন্দ করতেন৷ তাঁর বন্ধুরা যখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত, তিনি তখন একা একা ঘুড়ে বেড়াতেন, কখনও নদীর তীরে বসে থাকতেন, কখনও বা একা একা পাখি দেখতেন।
ভ্যানগখের জীবনের পুরোটুকু জুড়েই ছিল কেবল দুঃখ আর দুঃখ। আর্থিকভাবে পরিবার অতোটা স্বচ্ছল না থাকায়, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই চাকরি জীবন বেছে নেন এই শিল্পী।

১৮৬৯ সালে চাচার তদবিরে হেগ শহরে একটা চাকরি পান ভ্যানগখ। চাকরিটা ছিল আর্ট ডিলারের। সেখানে টানা চার বছর চাকরি করেন তিনি। এরপর ১৮৭৪ সালে লন্ডনে বদলি হয়ে আসেন। লন্ডনে দু’বছর কাজ করার পর ১৮৭৬ সালে চাকরি ছেড়ে ইংল্যান্ডেই এক স্কুলে চাকরি নেন তিনি।
ভ্যানগখ তখন তিন ধরণের ভাষা জানতেন। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, আর ইংরেজি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেখানে তিনি এসব কিছু না পড়িয়ে অংক পড়াতে শুরু করলেন। জীবনের এই সময়টাই যা একটু সুখী ছিলেন ভ্যানগখ। কিন্তু সেই সুখও বেশিদিন জুটলো না। চাকরি চলে যাওয়ায় উপায় না দেখে আবারও নেদারল্যান্ডে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। এরপর কিছুদিন বাবার মতো রোজ বাইবেল পড়তেন, সেসময় ধর্মযাজক হবারও চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক জমলো না। কি করবেন কিছুই যেন বুঝে পাচ্ছিলেন না তিনি।
বয়স তখন ২৮, কিন্তু তখনও হিসেব কষে বের করতে পারলেন না, তিনি আসলে কি হতে চান! ভ্যানগখ অনেক ভাবলেন। একটা সময় মনে হলো, তিনি এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন, এখন সেগুলো মানুষকে দেখানো উচিত। সেই থেকেই তাঁর আঁকাআঁকির শুরু।

সেই ভাবনা থেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন বেলজিয়ামে। সেখানে তিনি এন্টর্প একাডেমিতে ভর্তি হন। তার ইচ্ছে ছিলো, পদ্ধতিগতভাবে ছবি আঁকার নিয়ম-কানুনগুলো শিখে নেয়ার। কিন্তু নিয়মে বেঁধে থাকার মতো শিল্পী তো তিনি ছিলেন না। এক বছর যেতে না যেতেই আর্ট একাডেমি ছাড়লেন ভ্যানগখ। এরপর সোজা প্যারিসে চলে যান। প্যারিসে এসে ভাই থিও’র মোল্টমার্টের ছোট্ট কুড়েঘরে আশ্রয় নেন।
সেখানে তখনকার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পল গগ্যাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ভ্যানগখের৷ তাঁর সঙ্গে চিত্রকর্মের অনেক কিছু নিয়ে আলাপ হয়। দুজনের বন্ধুত্বটা এতটাই গাঢ় হয়ে গিয়েছিল যে ভ্যানগখ আর পল গগ্যাঁ একসঙ্গে আঁকার জন্য দক্ষিণ ফ্র্রান্সের মার্সেল প্রদেশের নিকটবর্তী শহর আর্লেসে একটি দোতালা বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য ছিল বাড়িটির পুরো দেয়াল জুড়ে ছিল হলুদ রঙ। বলে রাখা ভালো, এই বাড়িতেই তিনি বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম করেছিলেন!
কিন্তু আর্লেসে বিরক্ত ছিলেন গঁগ্যা। আর্লেস শহর তো পছন্দ ছিলই না সেইসঙ্গে ভ্যানগখের ‘হলুদ বাড়ি’ও ছিল বড্ড অপছন্দের৷ সেই সময় এক নারীকে পছন্দ হয় ভ্যানগখের। একটা সময় পর সেই নারীর প্রতি গঁগ্যারও নজর পড়লো। আস্তে আস্তে ভ্যানগখ ও গঁগ্যার বন্ধুত্ব তিক্ততায় পরিণত হল।

দুজনের সম্পর্ক এতোটাই তেঁতো হয়েছিল যে, এক রাতে ভ্যান গখ একটা মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন গঁগ্যার দিকে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন গঁগ্যা। কিন্তু ভ্যান গখ থামলেন না। ক্ষুর হাতে নিয়ে বন্ধুকে তাড়া করলেন। গঁগ্যা সে রাতে একটা হোটেলে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু ভ্যান গখ শান্ত হলেন না। হাতের ক্ষুরটি দিয়ে নিজেই নিজের ডান কানটি কেটে ফেললেন! তারপর কাটা কানটি সেই নারীকে ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। কান কাটার কারণটি ছিল খুবই অদ্ভুত। একবার নাকি পছন্দের সেই নারীটি ভ্যানগখকে উপহাস করে তার কানদুটো সুন্দর বলেছিলো!
এ ঘটনার পর গঁগ্যা আর্লেস ছেড়ে প্যারিসে চলে যান। এদিকে কাটা কান নিয়ে ভ্যানগখ অসুস্থ হয়ে পড়ে। রক্তাল্পতা এবং হ্যালুসিনেসনে ভূগতে থাকেন তিনি। আর্লেসের হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে দু’সপ্তাহ চিকিৎসা চলে তার। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফিরেই আবার কাজে মগ্ন হয়ে যান তিনি। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে উন্মাদের মতো ছবি আঁকতে শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ক্লান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ভ্যানগখকে।
হাসপাতালে থাকাকালীন সময় অসম্ভব আনন্দের এক সংবাদ পান তিনি। ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসের এক প্রদর্শনীতে ভ্যানগখের আঁকা ‘আর্লেসের আঙুরক্ষেত’ ছবিটি বিক্রি হয় ৪০০ ফ্রাঁতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার জীবদ্দশায় এই একটি মাত্র ছবিই বিক্রি হয়েছিলো।

একটু সুস্থ হয়ে ভ্যানগখ তার ভাই থিও’র কাছে চলে যান। কিছুদিন ভাইয়ের কাছে থাকার পর উত্তর ফ্রান্সের অঁভর গ্রামে উঠেন তিনি। সেখানে স্থানীয় এক ক্যাঁফেতে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে থাকছিলেন। কিন্তু সেখানে কিছুদিন আঁকার পর হতাশ হয়ে পরলেন ভ্যানগখ। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভূগছিলেন তখন। এর আগে বেশ কয়েকবার ভাই থিও টাকা দিয়ে সাহায্য করলেও তখন থিও’র অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না। দুঃশ্চিন্তা ও হতাশার মেঘ গ্রাস করলো ভ্যানগখকে। একদিন সেই হতাশা থেকেই নিজেকে গুলি করে বসলেন। আর এতেই ফুরিয়ে গেল পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী এক চিত্রশিল্পীর গল্প।
জীবদ্দশায় মাত্র পাঁচ বছর মন দিয়ে এঁকেছিলেন ভ্যানগখ। আর এতেই সৃষ্টি হয়েছে ‘সানফ্লাওয়ার’, ‘দ্যা পটেটো ইটার্স’, দ্যা স্ট্যায়ারি নাইট’ এর মতো অসাধারণ সব সৃষ্টি৷ মৃত্যুর পরই মূলত বিখ্যাত চিত্রকরের তকমা পান ভ্যানগখ। বর্তমানে বিশ্বের দামি পঞ্চাশটি ‘ছবি’র মধ্যে চারটিই তার! অথচ জীবদ্দশায় কি অর্থকষ্টেই না ভূগতে হয়েছিল ভ্যানগখকে।
ভ্যান গখ কে জানতে যে ৩ টি বই পড়তে পারেন….
প্রেমিক ভ্যান গঘ ভিনসেন্টের বেদনা-বিলাস ও শিল্পসত্তার গল্প
comments (0)