রবীন্দ্রোত্তর সময়ের সেরা কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর বেশ কিছু উপাধি আছে। ‘নির্জনতম কবি’ তাঁর ভিতরে একটি। উপাধিটি দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশকে তাঁর মতো করে আর ক’জন মানুষই চিনত! জীবনানন্দ দাশ নিজে কোনো আত্মজীবনী লিখে যাননি। জীবনের এক পর্যায়ে লেখার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু যার জীবন কাটে অস্তিত্বের লড়াইয়ে, তাঁর পক্ষে আত্মজীবনী লেখা কোনো সহজ কাজ নয়।
তাঁর কাছের কিছু মানুষের স্মৃতিচারণ আছে। তাঁর স্ত্রী লাবন্য দাশের স্মৃতিচারণগুলো ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় এসেছে। তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশেরও বেশ কিছু লেখা আছে। বিভিন্ন লেখায় তাঁকে স্মরণ করেছেন তাঁর বন্ধু, ভক্ত, ছাত্র, প্রতিবেশী বা সহকর্মী। এই তালিকায় কবি শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আছেন প্রতিবেশী সুবোধ রায়। তাঁর মৃত্যুর পর উদ্ধার হওয়া লিটারেরি নোটসেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
এগুলো একত্রিত করে বেশ কিছু সংকলিত বই আছে। গবেষণামূলক বই আছে অনেক, তাতে মানুষ জীবনানন্দ অনেকটাই অনুপস্থিত। কোনো বইতে সবগুলো স্মৃতিচারণ আর তথ্য মিলিয়ে একটি প্রবন্ধে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষ জীবনানন্দ দাশকে জানার জন্য এতদিন এগুলোই ছিল প্রধান ভরসা।
তবে কিছু সমস্যা থেকেই গেছে। স্মৃতিচারণগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন। কালের ধারাবাহিকতা ও স্থান অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য। আর ইংরেজি ভাষায় লিখে যাওয়া লিটারেরি নোটস অনেকাংশেই সাংকেতিক।
জীবনানন্দ দাশ মানুষ হিশেবেও ছিলেন অনেক লাজুক। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। মানুষের সাথে সহজে মিশতেন না। সে সময়ে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বা সাহিত্য পাড়ার আড্ডাগুলো ছিল প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল খুবই নগন্য।কল্লোলে তাঁর কবিতা ছাপা হতো। কলকাতায় নিজের মেসের কাছেই ছিল কল্লোলের অফিস। কিন্তু সেখানেও তিনি যেতেন না।তাঁর ভিতর ছিল অনতিক্রম্য দূরত্ব, সবার কাছে তাঁর জীবনের সামান্য অংশই উম্মুক্ত ছিল।
১৯৯২-৯৮ আমি ক্যাডেট কলেজে কাটিয়েছি। খুব সম্ভবত ১৯৯৪ সালের কথা। কলেজের লাইব্রেরি থেকে জীবনানন্দ দাশের একটা বই এনেছিলাম। পাঠ্যবইয়ে ‘আবার আসিব ফিরে’ পড়ে খুব যে মুগ্ধ হয়েছিলাম তা নিশ্চয় নয়। পাঠ্যবইয়ের কোনো কবিতা পড়ে আমি কোনো দিন মুগ্ধ হইনি। তাতে কবিতার কোনো দোষ নেই। প্রথম দশ লাইন মুখস্থ করো। ভুল হলে চেয়ার মাথায় নিয়ে ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকো। এত সব বাধ্যবাধকতা নিয়ে আর যাই হোক, কবিতার আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।
সেই বইয়ে প্রথম ‘বনলতা সেন’ পড়ি। আমি বেশ মুগ্ধ হলাম। এত বেশি মুগ্ধ হলাম যে সারা জীবন অন্য কোনো কবির কবিতা আমাকে তেমনভাবে টানেনি। তাঁর কবিতায় এক ধরনের মোহাচ্ছন্ন করার ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতার কাছে আমি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলাম।
দিনের পর দিন কারও কবিতা পড়লে কবির প্রতিও আগ্রহ জন্মে। আমার ভিতরেও জন্মাল। আমি ধীরে ধীরে মানুষ জীবনানন্দ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। তক্ষুণি অনুধাবন করলাম, বেঁচে থাকতে তিনি যেমন বিচ্ছিন্ন ছিলেন, মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি বিচ্ছিন্নই রয়ে গেছেন। জীবনানন্দ দাশের পুরো জীবনকে সহজ ভাষায় একসাথে আমার আর পাওয়া হলো না। তাঁর পুরো জীবনের ধারবাহিকতা আমার কাছে দীর্ঘ সময় দুর্বোধ্য হয়েই রইল।
বুদ্ধদেবের কবিতা আমি তেমন পড়িনি। যদিও তিনি রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আধুনিক কবিতার প্রসারে তাঁর ‘প্রগতি’ আর ‘কবিতা’ পত্রিকার অবদান ছিল অপরিসীম। জীবনানন্দ দাশকে তিনিই প্রথম এবং একটা সময় পর্যন্ত অনেকটা একাই পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন।
এত কিছুর পরেও বুদ্ধদেব-এর কবিতা নিয়ে আমার মনে তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু আমি তাঁর আত্মজীবনী পড়েছি খুব আগ্রহ নিয়ে। শুধু একটি কারণে। তাঁর জীবনী মানেই সেখানে জীবনানন্দ নিয়ে কিছু না কিছু থাকা।
লাবন্য দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্জ বা ভূমেন্দ্র গুহের মতো অনেক লেখকের বই ঠিক একই কারণে পড়েছি। যার ফলে কবিতার পাশাপাশি মানুষ জীবনানন্দও আমার উপর কঠিনভাবে ভর করলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের ভাড়া বাড়ির সামনের নিমগাছটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই।
এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই কি এই বই লেখার ইচ্ছে হলো? নাকি যন্ত্রণা আরও বাড়ালাম? জীবনানন্দ দাশের পুরো জীবনকে একসাথে সহজ ভাষায় আমি পাইনি। সেই কাজটা নিজেই করে যন্ত্রণা কি কমানো সম্ভব?
এভাবেই লেখা শুরু জীবনানন্দ দাশের জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস – ‘একজন নির্জনতম’ এর।
এটা কোনো জীবনী বা ইতিহাসগ্রন্থ না। নিছকই একটা উপন্যাস। মূল চরিত্র জীবনানন্দ দাশ। এছাড়া কাহিনীর প্রয়োজনে অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্র রয়েছে। মূল ইতিহাসকে ঠিক রেখেই তা লেখার চেষ্টা করেছি। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, এটা যেহেতু উপন্যাস, এর কতখানি বাস্তব আর কতখানি কল্পনা?
এটা ঠিক যে, কথোপকথনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি। যেমন জীবনানন্দ দাশ ‘র বিয়ের পর লাবন্য আর কুসুমকুমারীর সাথে কথোপকথনগুলো কাল্পনিক। প্রেমিকা শোভনার সাথে কথোপকথনের বেশ কিছু অংশ কাল্পনিক। কিন্তু এই কাল্পনিক অংশ না দিলে জীবনানন্দ দাশের দাম্পত্য জীবন বা শোভনার সাথে তাঁর সম্পর্কটা বোঝানো কঠিন হতো।
অন্যদিকে গোপালচন্দ্র রায়, নীরেদ্রনাথ চক্রবর্তী বা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সাথে কথোপকথনগুলো রেফারেন্স ঘেঁটেই নেয়া। কিন্তু হুবহু না নিয়ে যতটুকু দরকার ততটুকুই নেয়া হয়েছে।
মূল ইতিহাসের সাথে মিল রাখার জন্য যেসব গ্রন্থের সাহায্য নেয়া হয়েছে তা বইয়ের শেষে উল্লেখ করেছি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে মূল ইতিহাসের যেন কোনো পরিবর্তন না হয়। তারপরেও কোনো ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
‘একজন নির্জনতম’ উপন্যাসটি অর্ডার করতে ক্লিক করুন
রিয়াজ ফাহমীর অন্যান্য বই
জীবনানন্দ দাশের সকল বই
1 thought on “‘একজন নির্জনতম’র জীবনানন্দ দাশ- কতখানি কল্পনা?”
He was a writer who never wanted publicity and never wrote to be famous. He wrote from inner inspiration.