একটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে আসা হবে শিশু-কিশোরদের উপযোগী আল্পনায়। একটি পূর্ণাঙ্গ দেশ স্বাধীন হবার পেছনের বছরের পর বছর চলতে থাকা ঘামঝড়া কুটনৈতিক কৌশল ও পথের আন্দোলনকে নিয়ে আসতে হবে কমিক্সের পাতায়। বাদ দিতে হবে শিশু-কিশোরদের অনুপযোগী সংলাপ কিংবা জটিল বিষয়গুলো। ইতিহাসকে বিকৃত না করে; বরং সহজ ও সাবলীল ভাষায় নতুন করে নির্মান করতে হবে এক মহানায়কের জীবনের আড়ালে থাকা ইতিহাসকে। এই অনবদ্য পরিকল্পনা গ্রাফিক নভেল মুজিব নভেল মুজিব হয়ে ওঠার আদ্যোপান্ত জানবো আজ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কীর্তি কে না জানে! কিন্তু শেষ দশকে তাঁর লেখা আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হবার পর শুধু তাঁর জীবন নয়; বরং উপনিবেশিক শাষণের পর পাকিস্তানের জন্ম থেকে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক যাত্রার বিভিন্ন অজানা দিক উঠে এসেছে এসব বইগুলোতে। এসব বইগুলোর মধ্যে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামের বইটিকে নির্বাচন করা হয়েছিলো গ্রাফিক নভেল মুজিবের জন্য।
কীভাবে পাওয়া গেল অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি?
বিশ্ব জ্ঞানের মুক্তকোষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের অনেক সময়ই কেটেছে জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। ১৯৬৬-৬৯ সালে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন। এ নিরিবিলি নিরানন্দ সময়গুলোতে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সহধর্মিণীর অনুপ্রেরণায় তিনি জীবনী লেখা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি পাক হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল। এই বাড়িতেই একটি ড্রেসিংরুমের আলমারির উপরে অন্যান্য খাতাপত্রের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা এই আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ডায়েরি, ভ্রমণ কাহিনীও ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী সমগ্র বাড়িটি লুটপাট ও ভাঙচুর করলেও এই কাগজপত্রগুলোকে মূল্যহীন ভেবে অক্ষত রেখে যায়।

পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িটি জিয়া সরকার কর্তৃক সিলগালা করে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বাড়িটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এ সময় ঐ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো খুঁজে পাওয়া গেলেও তাঁর আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া যায় নি; শুধু কয়েকটি ছেঁড়া-উইপোকায় কাটা টাইপ করা ফুলস্কেপ কাগজ পাওয়া যায়।
দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ভাগ্নে অতি পুরানো-জীর্ণপ্রায় এবং প্রায়ই অস্পষ্ট লেখার চারটি খাতা শেখ হাসিনাকে এনে দেন। তিনি এই খাতা চারটি শেখ মুজিবের আরেক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি’র অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সংগ্রহ করেন। এই লেখাগুলোকে বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যাওয়া পূর্বোক্ত আত্মজীবনী হিসেবে সুনিশ্চিত করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে শেখ মণিকে টাইপ করার জন্য এগুলো দেওয়া হয়েছিল। পরে এগুলো বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায় গ্রন্থাকারে অসমাপ্ত আত্মজীবনী নামে ২০১২ সালের জুনে প্রকাশ করা হয়।
এ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, উর্দু, জাপানি, চিনা, আরবি, ফরাসি, হিন্দি, তুর্কি, নেপালি, স্পেনীয়, অসমীয়া ও রুশ ভাষার মত ১৪টি ভিন্ন ভাষায় বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রাফিক নভেল মুজিব তৈরি কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
বইটিতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। আছে লেখকের কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসার কথা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে অবিচল পাশে ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।
কিন্তু এরকম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়গুলো কমিক্সের পাতায় তুলে আনাটা বেশ কঠিন ছিলো। তাছাড়া আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই এসব ইতিহাসের ঘটনাগুলো মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে একাডেমিক শিক্ষায় জানতে পারে। কিন্তু গ্রাফিক নভেলটি এমনভাবে তৈরি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো, যেন যে কোন শিশু-কিশোর কোন পূর্ব ধারণা ছাড়াই গ্রাফিক নভেলটি পড়তে পারে। এটা ছিলো বেশ চ্যালেঞ্জের একটি কাজ।
যদিও এই কাজের বাইরে আরও চ্যালেঞ্জ ছিলো। বিশেষ করে আঁকার ক্ষেত্রে। এখানে এমন বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের তরুণ বয়সের চিত্র দেখাতে হবে, আদতে যাদের তরুণ বয়সের কোন ছবিই নেই। শুধু তাই নয়; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের শেষ দিকের ছবিগুলো দেখে আমরা অভ্যস্ত হওয়ায়, তার তারুণ্যের ছবি আঁকাটা এবং সেটিকে স্বার্বজনীন করাটাও ছিলো বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে দারুণ ভাবে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলে করেছে কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়।
গ্রাফিক নভেলের আঁকিবুঁকি
একটি গ্রাফিক্স নভেলে আঁকাআঁকি শুরু করার আগে, তার জন্য তৈরি করতে হয় স্ক্রিপ্ট। যেহেতু এখানে বেশ বড় একটি আত্মজীবনী থেকে গ্রাফিক্স নভেল তৈরি করা হবে, সেজন্য প্রথমে দরকার ছিল কোন কোন ঘটনাগুলো থেকে নিয়ে কাজ করা হবে সেগুলোকে আলাদা করা। শুধু তাই নয়, সেখান থেকে সবার উপযোগী করে সংলাপ ও বাক্যগঠন করাটাও প্রয়োজন ছিলো। যেটি দেখে ধারণা নিয়েই সেই দৃশ্যটি আঁকবেন কার্টুনিস্ট। আর এই কাজের জন্য ছিলেন লেখক ও নির্মাতা সিদ্দিক আহমেদ। তিনি জানালেন আরও বিস্তারিত।
‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকলেও আমাদের সব ঘটনা নেবার সুযোগ ছিলো না। সেক্ষেত্রে বাছাই করতে হতো এমন সব ঘটনা যেগুলো পরবর্তী জীবনে কোন না কোন প্রভাব ফেলেছে। তাই ধারাবাহিকতার খাতিরে সেসব ঘটনাকে আলাদা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হতো। এটা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং বটে’।
কিন্তু সেসবের পরও থাকতো বেশ বড়সড় একটা পর্ব। সে ব্যাপারে আরও বিস্তারিত ভাবে বললেন সিদ্দিক আহমেদ নিজেই। ‘মুলত স্ক্রিপ্ট কার্টুনিস্টের কাছে দিলেও কাজ শেষ হয়ে যেত না। কারণ হুট করে দেখা যেত, এমন কোন ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে যেটার প্রেক্ষাপট আগে বলা হয়নি। তখন ঘটনাটিকে আরও স্পষ্ট করতে প্রেক্ষাপটের ঘটনাতিকে জুড়ে দেয়া হতো। কার্টুনিস্ট তন্ময় ভাই (সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়) মাঝে মাঝে ফিডব্যাক দিতেন। সেভাবে আবার একটু রি-এডিট করতাম’।
গ্রাফিক নভেল মুজিব আঁকার বিষয়ে রকমারির মুখোমুখি হয়েছিলেন কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়। ‘আঁকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে চাপের বিষয় ছিলো বঙ্গবন্ধুর তরুন ছবিটা ফুটিয়ে তোলা। তরুণ বয়সী সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ঐতিহাসিক চরিত্রদের তরুণ বয়সের ছবি আঁকাটা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিলো’।
প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন
পুরো পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্ত ছিলেন। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়; বরং যেই চরিত্রগুলো গ্রাফিক নভেলে ফুটে উঠেছে, তার বেশিরভাগই খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তাদের আসল ছবি সবচেয়ে বেশি কল্পনা করতে পারতেন তিনিই। শিশু মুজিবের সঙ্গে তরুণ পিতা লুৎফর রহমানের নানা ঘটনার বর্ণনা আছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। ‘মুজিব গ্রাফিক নভেল’ মূলত এই বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। এই বইয়ের জন্য লুৎফর রহমানের ছবি আঁকা হলো তাঁর পরিণত বয়সের ছবি দেখে। তবে এটি পছন্দ করলেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর আপত্তি দাদার দাড়ির দৈর্ঘ্যে। এত বড় দাড়ি তো দাদার ছিল না, কমাতে হবে। নয়তো বাস্তবতার কাছাকাছি যাবে না। এরকম অনেক রকমের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে।
‘দুর্ভিক্ষ আঁকার পর মনে হলো ঠিকঠাক কি আঁকতে পেরেছি? কারণ যতই ভালোভাবে আঁকার চেষ্টা করি না কেন, আমি তো নিজ চোখে দুর্ভিক্ষ দেখিনি। ঠিকই প্রধানমন্ত্রী থেকে ফিডব্যাক আসলো দুর্ভিক্ষের দৃশ্যে কিছু পরিবর্তন আনা লাগবে। অনেক সময়েই এরকম ফিডব্যাক আসতো। তবে মুল আঁকার কখনই হস্তক্ষেপ করা হয়নি। আমরা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যমত কাজ করতে পেরেছি’। রকমারির সঙ্গে আলাপের সময় বলছিলেন সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়।
এ পর্যন্ত মুজিব গ্রাফিক নভেলের বাংলা ভাষায় আটটি, ইংরেজিতে তিনটি এবং জাপানি ভাষায় দুটি সংখ্যা বেরিয়েছে। জাপানের অনুবাদ করেছেন মাসাকি ওহাসি। সিআরআই সূত্র জানায়, বাংলায় নবম সংখ্যার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে সংখ্যা হবে ১০টি। আর ইংরেজিতে তিনটি পর্ব বের হয়েছে। আগামী ঢাকা লিট ফেস্টে বের হবে চতুর্থ সংখ্যা। ইংরেজিটি সাধারণত ঢাকা লিট ফেস্টে বের হয়। গ্রাফিক নভেলের প্রকাশক দুজন। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে বের হয় প্রথম সংখ্যা।