স্কুল ছুটির সময় মা ঘরের উঠোনে এসে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রতিদিন একটা অঘটন ঘটার অপেক্ষা করেন। একদিন দেখেন ছেলের হাতের খাতা নেই। আরেকদিন দেখেন নিজের ছাতা অন্য কাউকে দিয়ে এসেছে। একদিন তো দেখেন তার ছেলে স্কুল থেকে ফিরছে গায়ে চাদর জড়িয়ে, পরনের পাঞ্জাবি-পায়জামা কিছুই নেই। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন না। তিনি জানেন, এতক্ষণে হয়তো কোন সুবিধাবঞ্চিত ছেলের ভাগ্যে জুটে গেছে জামা-পাজামা।
ছেলেটা যেই স্কুলে পড়েন তার নাম গিমাডাঙা। শুধুই প্রাথমিক পর্যায় পড়াশোনা করা যায়। বাড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় সোয়া কিলোমিটার। হেঁটে যাওয়া এই বিশাল পথে দেখা হয় সারি সারি গাছ এবং বিভিন্ন পাখির সঙ্গে। বুকের সঙ্গে জাপটে রাখা বই মাঝেমধ্যে ভিজে উঠে ঘামে। তবে বর্ষাকাল যখন আসে, তখন দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ক্ষেতের আল পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। অস্বচ্ছ পানিতে টইটম্বুর থাকা হালকা স্রোতে তখন নৌকায় করে স্কুলে যেতে হয়। তেমনই এক বর্ষার দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে নৌকা উল্টে গেলো। ছেলেটা গিয়ে পরলো পানিতে। পারে উঠিয়ে যখন মাঝি জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কোন বাড়ির? তোমার নাম কী? ছেলেটা উত্তর দেয়, আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়ার পথটা তেমন একটা সহজ ছিলো না। এই যাত্রায় মহানুভবতা ছিলো, সাহসিকতা ছিলো, ছিলো পথে পথে ষড়যন্ত্রের ইশারা। একদম কিশোর বয়সী একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখাতেই।
‘আমি মাঠ থেকে খেলে বাড়িতে এসেছি; আমাকে খন্দকার শামসুল হক সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি) ডেকে বললেন, “মালেক (বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী একজন) কে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস”। আমি আর দেরি না করে কয়েকজন ছাত্র ডেকে নিয়ে ওদের ওখানে যাই এবং অনুরোধ করি ওকে ছেড়ে দিতে’। মুলত তখন হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিলো। তাছাড়া গোপালগঞ্জ শহরের আশেপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিলো। দু’একজন মুসলমানের উপর তখন অত্যাচারও হয়েছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মহকুমা, আবদুল মালেক নামের শেখ মুজিবুর রহমানের এক সহপাঠীকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনা বহু দূর গড়িয়ে যায়।
‘রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব’। এদিকে তিনি তার মামা (শেখ সিরাজুল ইসলাম) কে খবর দেন, দলবল নিয়ে আসার জন্য। কোনভাবেই তিনি সহপাঠী আবদুল মালেককে এখান থেকে না নিয়ে যাবেন না। ‘এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।
শহরে খুব উত্তেজনা। আমাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না….। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। হিন্দু নেতারা থানায় বসে এজাহার ঠিক করে দিলেন। তাতে খন্দকার শামসুল মোক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি (বঙ্গবন্ধু) খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি…..। (এজাহারে) কোনো গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের বাকি রাখে নাই। সকাল ন’টায় খবর পেলাম আমার মামা ও আরও অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে…..। আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন- মারামারি করেছ? আমি চুপ করে থাকলাম, যার অর্থ “করেছি”।
কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, মুজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিলো রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না। আমি বললাম, “বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না”। যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, দেখ ছেলের সাহস!…. পরে শুনলাম, আমার নামে এজাহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছোরা দিয়ে রমাপদকে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি’।
প্রকৃত পক্ষে এরকম কোন ঘটনাই সেদিন ঘটেনি। কিন্তু তাও এই ষড়যন্ত্রের জেরে কিশোর মুজিবকে জেলে পাঠানো হয়। এটিই ছিলো তার জীবনের প্রথম জেল। কিন্তু তিনি তখনও জানতেন না, পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তার জেলে যেতে হবে বারবার।
মহানায়কের উত্থানের পেছনে শক্তিশালী প্রভাবক হয়ে কাজ করেছেন তাঁর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা। বঙ্গবন্ধু তাকে ডাকতেন রেণু নামে। ৭ই মার্চের ভাষণ নির্মানেও আমরা শেখ ফজিলাতুন্নেসার মনতস্তাত্বিক প্রভাব দেখতে পাই। মজার ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধুর বিয়ে হয়েছিলো মাত্র বারো বছর বয়সে। পিতাহারা বেগম ফজিলাতুন্নেসার দাদা বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলের সঙ্গে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব’। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিষ্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না’।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন অলিগলি ঘাটলে উঠে আসে বেদনার নিদারুণ সব চিত্র। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। তার গ্রেফতার হয়েছিলো আরও তিন বছর আগে ১৯৪৯ সালে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। মিছিল করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেছিল শত সহস্র ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে বেলতলায় জমা হয়েছে সবাই পরবর্তী ঘোষণার জন্য। শামসুল হক চৌধুরী আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে সংবাদ পাঠিয়েছেন শেখ মুজিব-খবর পাঠিয়েছেন তিনি, সমর্থন জানিয়েছেন একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। একটি বাড়তি উপদেশ-মিছিল করে সেদিন আইনসভা ঘেরাও করতে হবে, বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। আরও একটি খবর পাঠিয়েছেন যে, তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। এই অনশন বঙ্গবন্ধুকে প্রচন্ড অসুস্থ্য করে দেয়। এতটাই অসুস্থ্য হয়েছিলেন যে, তাকে যখন মুক্তি দেয়া হয় তখন স্ট্রেচারে করে জেলগেটের বাইরে রেখে দেয়া হয়, যেন যদি কিছু হয় তা জেলের বাইরে হয়। এতদিনের কারাবাস এবং অনশন, প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পর তাঁর সহধর্মিনী আবেগাপ্লুত হয়ে পরে। সেই দৃশ্য উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে।
‘রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল, “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়..। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম…। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা (শেখ হাসিনা এবং শেখ কামাল) নিয়ে কি করে বাঁচতাম..? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়…?” রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, উপায় ছিলো না’।
ঠিক সেসময় ঘটা আরেকটি গল্প যে কোন মানুষকে তাড়িত করবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা, পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর “আব্বা” “আব্বা” বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি”। আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা”। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয় স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়’।
একই ঘটনা উঠে এসেছে শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ নামের প্রবন্ধে। ‘কামাল তখন্ন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে…। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি”। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না! আজ ও নেই, আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই।

যেদিন কামাল আব্বাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকার অনুমতি চেয়েছিল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই..। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন। আজ আর তারা কেউই বেঁচে নেই- আজ যে বার বার আমার মন আব্বাকে ডাকার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মায়ের স্নেহ, ভাইদের সান্নিধ্য পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি, কিন্তু শত চিৎকার করলেও তো কাউকে আমি পাব না। কেউ তো আর সাড়া দিতে পারবে না। তাদের জীবন নৃশংসভাবে বুলেট দিয়ে চিরদিনের মতো যে ঘাতকেরা স্তব্ধ করে দিল, তাদের কি বিচার হবে না?’ (১৯৯১ সালে লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেয়া। তখনও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য শুরু হয়নি। এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাবা হত্যার বিচারের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন)।
আজ এত বছর পর পেছনে ফিরলে আমরা দেখি, এক মহানায়কের উত্থানের পেছনে যেসব শক্ত ভীত ছিলো, তাতে মিশে ছিলো অসংখ্য বেদনা ও আত্মত্যাগ। ১৯৭৫ সালে বিপথগামী সেনাসদস্যরা যখন কাঁপা হাতে গুলি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বুকে তখন যদি তারা খেয়াল করতেন তবে দেখতে পেতেন, সেখানে এক অখন্ড হাহাকার।