কয়দিন ধরে রাকা বুঝতে পারছে বাসায় কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু কেউ তাকে কিছু বুঝতে দিতে চাইছে না। তার আড়ালে বাবা মা নিচু গলায় কথা বলছে, সে সামনে এসে পড়লে সাথে সাথে হয় চুপ করে যাচ্ছে, নয়ত অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে।
বাবা মায়ের এ লুকোচুরি রাকার মনে একটা চাপা টেনশানের জন্ম দিচ্ছে। সময়টাই যে এমন। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে দৈনন্দিন জীবনে কিছু আর নর্মাল নাই। সবকিছু এখন ওলট পালট, সবাই যেন নিশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। অজানা শঙ্কা নিয়ে প্রতিটা দিন কাটাচ্ছে।
রাকা ঢাকা শহরের এক নামকরা স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। বয়স দশ বছর। তার বাবা রিয়াজ হক একজন ডাক্তার, মা নোরা চৌধুরী ব্যাংকার। ছিমছাম ছোটো পরিবার তাদের। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলত তাদের প্রতিদিনকার জীবন। রাকাও ভালো ছাত্রী। স্কুলে সব পরীক্ষাতে সে প্লাস রাখে। কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ। মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পেতে স্কুল কলেজ সব বন্ধ রাখা হয়েছে। বাড়ির কাজের খালা, ড্রাইভার সবাইকে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। বাবা মাকে অবশ্য অফিস করতে হচ্ছে। যেহেতু তারা একজন ডাক্তার আর অন্যজন ব্যাংকে কাজ করে। যার জন্য রাকাকে নিয়ে তারা যে ভাবনায় পড়ে গেছে, সেটা রাকা খুব ভালোমত বুঝতে পারছে। সারাদিন রাকাকে একা বাড়িতে রাখা কারোরই মনঃপুত হচ্ছে না। কিন্তু না রেখেই বা যাবে কোথায়? ঢাকা শহরে তাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নাই। বাবার এমনিতেই কোনো ভাইবোন নাই, দাদা-দাদুও মারা গেছে। এদিকে মা’র এক বড়ো বোন রয়েছে কিন্তু সে থাকে ঢাকা শহর থেকে কিছুটা দূরে এক ছোট্ট শহরে। বিয়ে করেনি, রাকার নানার বিশাল বাড়িতে একাই থাকে। প্রতি বছর রাকারা ছুটি কাটাতে কক্সবাজার বাসা জেকবানী লগিরিতে যায়। যাবার আগে ডোরা খালার বাসায় দুদিন কাটিয়ে যায়। সেই ছোটো বেলা থেকে। দুদিনের বেশি অবশ্য কখনো থাকেনা। বাবার জন্যই খুব সম্ভবত। বাবা কেন জানি ওবাড়িতে থাকতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা। কিন্তু মা’র মুখ চেয়ে দুটো দিন কোনোমতে কাটিয়ে দেয়। কারণ মা এ ব্যাপারে কোনো আপোষ করেনা। তার কথা আমার একটা মাত্র বোন, তার জন্য যদি বছরের দুইটা দিন বরাদ্দ না রাখিতো কেমন করে চলবে, রিয়াজ?
কাজেই বাবাকে চোখ কান বুজে দুটো দিন ও বাড়িতে কাটাতেই হয়।
কিন্তু কেন ওবাড়িতে যেতে বাবার এত অনীহা, সেটা বলা যাবে না। বাড়িটাই বা ঠিক কোন শহরে রয়েছে, সে কথাও না হয় গোপন থাকুক। কারণ বলে দিলে তোমরা সব পিলপিল করে ছুটবে ও বাড়ির খোঁজে। আর সেটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবেনা। কারণ ডোরা খালা খুব প্রাইভেট একটা মানুষ। সে একা থাকে। তার নিজস্ব একটা জীবনযাত্রা আছে, রুটিন আছে। সেখানে তোমরা যদি তার বাড়িতে ভিড় জমাও, ফটোগ্রাফাররা খচাখচ ছবি তুলতে আরম্ভ করে, সাংবাদিকরাও রনাকের নিচে মাইক্রোফোন ধরে টিভি ক্যামেরা বা গিয়ে “এ বাড়িতে থাকতে আপনার কেমন লাগছে, বলুন তো?” বলে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে, তাহলে ডোরা খালা ভীষণ বিরক্ত হবে। তার প্রাইভেসির ও দফারফা হবে। কাজেই তোমরা সবাই ধরে নাও যে ঢাকা শহর থেকে একটু দূ ‚রে এক ছোট্ট শহর রয়েছে, যেখানে ডোরা খালার বাড়ি। মানে ঠিকভাবে বলতে গেলে এটা ডোরা নোরা দুই বোনেরই বাড়ি। ওকে?
আচ্ছা, এবার আগের কথায় ফিরে আসি। তো রাকাকে নিয়ে ওর বাবা মা চিন্তায় পড়ে গেছে। কারণ রাকার শরীর ছোটোবেলা থেকে একটু দুর্বল। কথায় কথায় খুচ খাচ সর্দি জ্বর লেগেই থাকে। একটু এ্যাজমাও আছে। সে সাথে ডাস্ট এলার্জি। ওকে সাবধানে থাকতে হয়। রাকার মা সেজন্য রাকাকে একটু বেশি আগলে রাখে মনে হয়। বাইরে কোথাও গেলে সাথে থাকে। এমনিতেও বাইরে যাবার তেমন সময়ই বা কোথায়? স্কুল, পড়াশুনা, কোচিং, হোম ওয়ার্কের বেড়াজালে তার জীবন একেবারে ঠাসা।
কিন্তু এখন খানিকটা বিপদে পড়ে গেছে স্কুল বন্ধ হয়ে। আর বিপদ যখন আসে, তখন এক সাথেই আসে। আশে পাশের দুই একটা বাড়িতে এ মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ এসে গেছে খবর পেয়ে মা নোরা চৌধুরী মনে মনে অস্থিার হয়ে গেল। তারা দুজনে এমনিতেই প্রতিদিন ব্যাংকে আর হাসপাতালে যাচ্ছে। কত রকম জীবাণুর সংস্পর্শে আসছে, সেগুলি বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসছে কিনা সে চিন্তায় সবসময় কাঁটা হয়ে থাকছে। তার মাঝে রোগটার ভীষণ থাবা যে ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে আসছে! বিপদের উপর বিপদ, সামনের যে বিল্ডিং-এ একজন এ ছোঁয়াচে রোগে মারা গেছে, সে ফ্ল্যাটে রাকা নিয়মিত যায় কোচিং করবার জন্য। দুশ্চিন্তায় রাকার মা অস্থিার হয়ে পড়ল। বাবাও কিছুটা চিন্তিত হল। রাকার ইমিউন সিস্টেমতো ভালো না। কী হতে কী হয়ে যায়!
সেদিন বাবা মা’কে আবার নিচুস্বরে কথা বলতে শুনল রাকা। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য নিচু স্বর আর নিচু রইল না, রাকা সবই শুনতে পেলো তারা বলছে।
শুনল মা বাবাকে বলছেন আমার একটুও ভালো লাগছে না রাকাকে এমন খালি বাড়িতে এতটা সময় ধরে একলা রেখে দিতে।বাবার দিক থেকে কোনো সাড়া এলো না।
– চারিদিকে খালি খারাপ খবর শুনছি। সামনের ফ্ল্যাটের আজম সাহেবের বাবা মারা গেলেন। ঐ ফ্ল্যাটে তো রাকা যায় কোচিং করতে। এখন অবশ্য বন্ধ করে দিয়েছি।
বাবা তাও চুপ করে রইল।
– তুমি শুনছ আমার কথা? এত নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকো কী করে?কিছু একটা বল!
-কী বলব নোরা? চিন্তা তো আমারও হচ্ছে। কিন্তু কোনো সুরাহা দেখতে পাচ্ছি না।
-রাকা একটু দুর্বল, অল্পতেই অসুখ করে। ভয়ে আমার রাতে ঘুম হয় না। একটা কাশি দিলেও রক্ত হিম হয়ে যায়।
– সবই বুঝি, নোরা। কিন্তু কিছু করার নাই।
– করার আছে, রিয়াজ। রাকাকে যদি এখান থেকে সরিয়ে দেই? অন্য কোনোখানে যদি পাঠিয়ে দেই?
– কোথায়, নোরা?সব জায়গায় এক অবস্থাা। কম আর বেশি।
– কেন, আপার ওখানে। আপা একা থাকে। কারো সাথে মেশে না, তেমন কেউ বাড়িতেও আসে না। সেখানে কিছুদিন থাক নাহয় রাকা। স্কুল খুললে ফিরে আসবে।
– অসম্ভব, নোরা। ওখানে দুইদিন থাকলে আমারই কেমন জানি দম বন্ধ লাগে। কিছু একটা আছে ওবাড়িতে। আর তুমি রাকাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ও বাড়িতে পাঠাতে চাইছ? রাকা ও রাজি হবে না দেখো।
– তাহলে কী করবে বলো, রিয়াজ? তোমারতো কোনো ভাইবোন নাই যে তাদের বাড়িতে পাঠাবার চিন্তা করব।
– এত ভেবনাতো। কিছু হবে না রাকার।
– কিছু নাহোক, খালি বাড়িতে থাকে, কতরকম ভয় আছে। ধরো যদি ডাকাত পড়ে !
– নোরা! দিনে দুপুরে এত ঘন বসতি এরিয়ায় ডাকাত পড়বে?
মা তখনকার মত চুপ করে গেলেও দুদিন পরে বাবার খুব কাছের একজন বন্ধু যখন ছোটো ছোটো দুইটা বাচ্চা রেখে মারা গেল, তখন বাবাও অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ল। আর মা’কে তো বোঝানোই গেল না। সে আর একটা দিনও রাকাকে এখানে রাখবেনা, আপার ওখানে পাঠিয়ে দিবে। স্কুল খুলুক, তারপর নিয়ে আসবে। স্কুল নিশ্চয় বেশি দিন বন্ধ থাকবে না।
এবার বাবাও খুব জোরালো ভাবে আপত্তি করতে পারল না। ঠিক হল, ডোরা খালার ওখানেই রাকা কিছু দিনের জন্য গিয়ে থাকবে। পুরা ব্যাপারটাতে রাকার এতটুকু সম্মতি ছিলনা। ডোরা খালাকে সে মনেমনে ভয় করে। মার থেকে বড়ো, একটু গম্ভীর মানুষ। যে দুদিন ওবাড়িতে থাকে, একটা সালাম দিয়ে সে বাকিটা সময় ডোরা খালাকে এড়িয়েই চলে। আর এখন দিনের পর দিন ডোরা খালার বাড়িতে তার সাথে? ওরে বাপরে! সে করবেটা কী সেখানে?
ওহ! আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। ডোরা খালা আধুনিক প্রযুক্তিতে তেমন বিশ্বাস করেনা। পুরানো দিনের ঢিমেতালে জীবন তার বেশি ভালো লাগে। সেজন্য তার বাড়িতে ফোন নাই, ইন্টার্নেট নাই, ল্যাপটপ নাই। আর এসব ছাড়া রাকা দুদিনেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। সে তীব্র প্রতিবাদ জানালো বাবা মার সিদ্ধান্তে। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মত বাবা মা তার প্রতিবাদে কোনো কান দিলো না। এক সকালে রাকা ও রাকার জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে নিয়ে তাকে ডোরা খালার বাসায় নামিয়ে দিয়ে এল।
আসল ঘটনা অবশ্য এতটা ড্রামাটিক ছিলো না। রাকার সাথে তার বাবা মাও এসে দুইদিন ছিল। যাতে রাকা এমন আচমকা সিদ্ধান্তে খানিকটা মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু রাকা বাবা-মার এবদান্যতায় কিছুমাত্র খুশি হলো না। মুখটাকে সবসময় বাংলার পাঁচের মত করে রেখে সে নীরবে প্রতিবাদ জানাতে লাগল।
comments (0)