‘নাগরিক কবি’ খ্যাত শামসুর রাহমান এদেশের কবিমহলের এক উজ্জ্বল নাম। প্রতিবাদী শহুরে এই কবির প্রাণ ছিল ঢাকা শহর। পৈতৃক বাড়ি ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলায় হলেও জন্ম কিন্তু নানাবাড়ী- পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে। শৈশব-কৈশোর পুরান ঢাকার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কেটেছে বলেই হয়তো ঢাকার প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করতেন কবি।
জীবদ্দশায় শামসুর রাহমান একাধিক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং দিয়েছেন। নিয়েছেন, কারণ তিনি পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। শুধু সাংবাদিক বললে কম হয় কি না একাধিক সম্মাননাপ্রাপ্ত সাংবাদিক। তার আরও পরিচয় হলো তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং কবি। এমন বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার না নিলেই না!
তার নানা সময়ে নানা জনের নেওয়া নানা রকম সাক্ষাৎকার একত্রে সম্পাদিত করার গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী লেখক আহমদ মাযহার এবং বহু পুরষ্কারপ্রাপ্ত তরুণ লেখক পিয়াস মজিদ। তাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় গ্রন্থ ‘কবিকথন- শামসুর রাহমানের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’। সেখানে তার একাধিক সাক্ষাৎকার স্থান পেয়েছে। এই বইয়ে পাঠক একেক রকম স্বাদ খুঁজে পাবেন তার ৭৭ বছরের জীবনের। কারণ, কোথাও আছে দাঙ্গা, যুদ্ধ এবং নিম্নশ্রেণীর মানুষের আবেগের আলাপ, কোথাও আছে তার পেশার অস্থিরতার কথা, কোথাও পাঠক খুঁজে পাবেন পুরান ঢাকার আদিম রূপের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনার স্মৃতিচারণ আবার কোথাও তার কবিতা নিয়ে বিষদ আলোচনা।
শামসুর রাহমান সব ধরনের কবিতাই লিখে গেছেন। প্রেমের কবিতা, দেশের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা এবং অন্যান্য। তবে তার যে বৈশিষ্ট্য চিরভাস্বর তা হলো ‘প্রতিবাদী কবি’ হিসেবে। সাক্ষাৎকারদাতার প্রশ্নে সেই দিকও কম প্রাধান্য পায়নি। একজন তৃতীয় বিশ্বের কবি হয়ে চোখের সামনে অবিচার-অনাচার-স্বৈরশাসন-উৎপীড়নকে যেহেতু খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং স্বয়ং নিপীড়িত হয়েছেন, তাই ধীরে ধীরে তার কবিতায় প্রাধান্য পেতে শুরু করলো এই বিষয়গুলোই ।
সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষদের কথা যেভাবে অতীতের ঔপ্যনাসিকরা ব্যক্ত করে গেছেন, সেভাবে তিনি যে সাহিত্যে অতটা তুলে ধরতে পারেননি, সেই ব্যর্থতা নিয়ে আফসোসও করেছেন।
১৯৫৮ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে তাকে বিদ্রুপ করে ‘হাতির শুঁড়’ কবিতা লিখেছেন। ১৯৬৬- ৬৭ সালে বন্দী শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন ‘টেলেমেকাস’ নামে এক অসাধারণ কবিতা। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্য তার অনন্য কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে একের পর এক প্রতিবাদী কবিতার পর, তার পতনের পর লিখেছেন ‘গণতন্ত্রের কবিতা’। সাক্ষাতকারে বলছিলেন, কখনোই কোনো অবস্থাতে তিনি পালিয়ে যাননি। ঠায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন লেখনী দিয়ে। সেই সময়গুলোতে দেশের কী অবস্থা ছিল, মানুষ কীভাবে প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করেছে এই সময়টিতে, মানসিক অবস্থা শুধু কবিতা ছাড়াও তার অনুভূতি ব্যাক্ত করেছেন সাক্ষাৎকারে। তার মুখ থেকে শোনা এই ইতিহাসের ধারাভাষ্য যেন সাক্ষাৎ গল্প।
লেখালেখির পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতা। এমন নির্ভীক সাংবাদিকতার যুগ এখন আর নেই বললেই চলে। তখনও বলবৎ ছিল গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার ধারা, কিন্তু মানুষ বড় সৎ ও সাহসী ছিল। মানুষের মধ্যে ছিল সম্প্রীতি এবং একতা। সেই সময়ে সাংবাদিকতা করে কীভাবে টিকে ছিলেন সেই গল্পও পাঠক জানতে পারবেন তার সাক্ষাৎকার থেকে। যুদ্ধের সময় থেকে এরশাদের পতনের সময় পর্যন্ত তিনি চরম দৃঢতার সাথে কলম চালিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মত একেকটা ঘটনা তিনি শোনান নিজ মুখে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের পথে। কিন্তু একজন ঢাকাইয়ার কাছ থেকে একমাত্র এর কিছুটা রূপ সরাসরি জানা যাবে। সেই আমলের পথ-ঘাট ঘর-বাড়ি মানুষের জীবনের দিনলিপি শামসুর রাহমানের বর্ণনায় শুনলে পুরো ছবি ভেসে ওঠে! পুরান ঢাকার ধুলোবালি-জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা শামসুর রাহমান, ঢাকার কথা বলতেই বিজলীর মতো জ্বলে ওঠেন। তার ঘর, উঠান, বিদ্যাপীঠ, আড্ডার মধুর ক্যান্টিন কিংবা বিউটি বোর্ডিংয়ের এবং তখনকার সময়ে তার লেখক বন্ধুদের কথা তিনি স্মরণ করেন।
সেই সময়গুলো ছিল সোনালী দিন। তাই প্রিয় ঢাকাকে কেন্দ্র করে একাধিক কবিতা-উপন্যাস-গল্প লিখে গেছেন। ঢাকাইয়া ভাষায় কথা না বললেও ঢাকাইয়া ভাষায় লেখা তার অনন্য জনপ্রিয় কবিতা ‘এই মাতোয়ালা রাইত’। লিখে গেছেন আশোক লেনের বাড়ি, পুরনো শহর, দুঃসময়ের মুখোমুখি, দুপুরের বেগমবাজারে, শ্যামলীর গালিবসহ নানা কবিতা। অকপটে কথা বলে গেছেন সেসব স্মৃতি নিয়ে।
শুধু দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়, পরিবার-পরিজন-আপনজনদের যা কিছু তাকে স্পর্শ করেছে, সেই অনুভূতি অনায়াসে ঢেলে দিয়েছেন কবিতার খাতায়। কখনো ভন্ডামি করেননি, না করেছেন বাহাদুরি। অহংকার তাকে ছুঁতে পারেনি কোনোদিন। শুধু অকৃত্রিম ভাবাবেগ, বেদনাবোধ, দরদ, আনন্দ, সুখ এবং বিশুদ্ধ স্পর্শেন্দ্রীয় সঞ্চারিত করেছেন তার রচনা দিয়ে। শামসুর রাহমানকে জানার জন্য এই গ্রন্থটিই যথেষ্ট। তার সম্পর্কে এত তথ্য একত্রে আর কোথাও পাওয়া কঠিন হবে। সাথে পাঠক লাভবানও হবেন কয়েক দশকের অজানা ইতিহাস জেনে!
এই ব্লগটি লিখেছেন আফরা নাওমী