বিংশ শতাব্দী বাঙালি জাতির ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনাবহুল একটি শতক। এই শতাব্দীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো গড়ে দিয়েছে বাঙালির ভবিষ্যত। পরবর্তী সংগ্রামগুলোতে জুগিয়েছে নিরন্তর অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর তেমনই এক তাৎপর্যময় ঘটনা।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশদের বিদায়ে বাঙালিরা বহু দিন পর দেখেছিল মুক্তির স্বপ্ন। কিন্তু ভারতবর্ষ বিভাজনের ফলে বাঙালির প্রাপ্তির খেরোখাতা খুললে বেরিয়ে আসে একরাশ শূন্যতা। বাস্তবে ব্রিটিশদের বিদায়ে বাঙালির শুধু শাসক পরিবর্তন হয়েছিল। ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা গিয়ে পূঞ্জীভূত হয়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে। শোষণ অব্যাহত ছিল আগের মতোই।
অর্থনীতি ও রাজনীতির পর পশ্চিম পাকিস্তানের নাকউঁচু অভিজাত শাসকেরা বাঙালি সংস্কৃতির উপরেও নাক গলাতে চেয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে তারা।
বাঙালিও ঘরে বসে থাকার পাত্র নয়। দফায় দফায় আন্দোলন তারই প্রমাণ দেয়। পাকিস্তানিরা আন্দোলনরত বাঙালিকে জেলে ঢুকিয়েছে, লাঠিচার্জ করেছে, কিন্তু রাজপথ থেকে সরাতে পারেনি।
অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কারফিউ ভেঙে দুঃসাহসী বাঙালি সন্তানেরা রাস্তায় নেমে এসেছিল দলে দলে। পাকিস্তানিরা সেই ঐতিহাসিক মিছিলে গুলি চালিয়ে জন্ম দেয় পৃথিবীর ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক এক ঘটনার। বাঙালির প্রতিবাদ সংগ্রামের মুখে শেষমেশ পাকিস্তানিরা ঠিকই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বাঙালি যে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত করেছিল তা অগ্নুৎপাতের আকার ধারণ করে ঝরে পড়েছিল ১৯৭১ সালে।
ইতিহাসের শিক্ষা একটি জাতির সবক্ষেত্রেই দরকার হয়। ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে জাতি এগিয়ে যায়। তাই সব জাতিই নিজ নিজ ইতিহাস সংরক্ষণ ও গবেষণায় সচেতন থাকে। গবেষকরা ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে জনগণের সামনে তা সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন। ফলে জনগণ নিজ জাতির আত্মসংগ্রাম সম্পর্কে জানতে পারে।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প, নাটক কিংবা উপন্যাস রচিত হয়েছে বেশ। কিন্তু বলতে খারাপ শোনালেও গবেষণামূলক কাজ হয়েছে খুবই অল্প। প্রকাশকেরা অভিযোগ করে থাকেন, তাদের হাতে সেরকম পান্ডুলিপিই আসে না। তাই ছাপাবারও অবকাশ নেই।
‘ভাষা-আন্দোলন-কোষ‘ একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। বইয়ের নাম থেকে বোঝা যায়, এই বইয়ের মূল উপজীব্য ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নিয়ে যে অল্প কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করার একটি চেষ্টা সবসময়ই ছিল। এর ইতিহাসকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। এই গ্রন্থে লেখক এম আবদুল আলীম ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন সহজ সরল ভাষায়।
- ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কি ছিল– এটা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। লেখক পর্যাপ্ত তথ্য–উপাত্ত হাজির করে সেই অস্পষ্টতা দূর করার চেষ্টা করেছেন।
- ভাষা আন্দোলনের সময় তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি জলঘোলা করা হয়। লেখক এক্ষেত্রে তৎপর। যে রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে ভাষা আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেছিল, সেসব দলের অবদান সশ্রদ্ধায় বর্ণনা করেছেন গ্রন্থটিতে।
- ভাষা আন্দোলন ঢাকা থেকে ক্রমশ বাংলাদেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমাদের সামনে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক ইতিহাসটিই উপস্থাপন করা হয়। লেখক সেই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এই গ্রন্থে দেখানো হয়েছে কীভাবে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
- এছাড়াও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত এমন আরও অনেক বিষয়, ইতিহাস, ঘটনাবলী, ভূমিকার কথা উঠে এসেছে ৬৮০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে, যা নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানী মনের জন্য হতে চলেছে চমৎকার এক খোরাক।
বাঙালি পাঠকেরা যখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণামূলক বইয়ের সংকটে ভুগছিল, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব লেখক ড. এম আবদুল আলীমের। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার গবেষণামূলক গ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক। বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শেষে সিভিল সার্ভিসের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে কলেজে নিয়োগ পান। বর্তমানে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। গবেষণামূলক গ্রন্থের লেখক হিসেবে তার সুখ্যাতি আছে। আহমদ রফিক তার ইতিহাস–চেতনা নিয়ে লেখেছেন, “লেখককে ধন্যবাদ জানাই ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য; যা আবশ্যিক মাত্রায় নির্মোহ, আবেগমুক্ত, তথ্যনিষ্ঠ ও গবেষক–সুলভ।“
এই ব্লগটি লিখেছেন সাদমান সাকিব