আমি ইদানিং এ সময়ের লেখা গল্প খুঁজছি। আমার গল্প . . . আমাদের গল্প। যে গল্পের চরিত্রেরা আমার মতো করে ভাবে, আমার ভাবনার বিপরীতেও ভাবে। কিন্তু আমি তাদের বুঝতে পারি। আমার আশেপাশে তাদের হাঁটতে দেখি, ভাবতে দেখি—আমি এমন গল্প খুঁজছি।
‘জীবন অপেরা’ পড়লাম যখন—একবার, দুইবার . . . মনে হলো, আমি হয়তো এই বইটাই খুঁজছিলাম। মাল্টিভার্সের গল্প হলেও এর চরিত্রগুলো অচেনা নয়।
আলভী আহমেদকে মানুষ চেনে নাটক নির্মাতা হিসেবে, অনুবাদক আর গল্পকার হিসেবে। কিন্তু সব ছাপিয়ে আমি তাকে মনে রাখতে চাই, ‘জীবন অপেরা’-র লেখক হিসেবে।
এই উপন্যাসকে অতিক্রম করে আরো অনেক মৌলিক সাহিত্য নিয়ে তিনি সামনে আসবেন আমার বিশ্বাস। হয়তো কোনো উপন্যাসে আরও মুগ্ধ হবো, হয়তো হবো না। তবু তাকে মনে রাখতে চাই ‘জীবন অপেরা’র লেখক হিসেবে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যেমন জড়িয়ে আছেন ‘লালসালু’-তে ।
“সুখের গল্পগুলো একইরকম হয়। বিপর্যয় ছিল বলেই গল্প তৈরী হয়”—এ কথাটি ‘জীবন অপেরা’-র শারমিন বলে। আর উপন্যাসটাকে বিশ্লেষণ করবার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত লাইন আর কী হতে পারে?
এ উপন্যাস পাঠ করলে সুখ হয়, কিন্তু এটি সুখের গল্প নয়। প্রেমের গল্প। প্রেমের ভাঁজে ভাঁজে আছে বিপর্যয়। আর বিপর্যয় আছে বলেই প্রেম এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
গল্পের মূল চরিত্র রফিক। লেখক উপন্যাসে রফিকের স্বরে গল্প বলেননি। থার্ড পারসন ন্যারেটিভে বলেছেন। তবু পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, লেখকই কি রফিক? যদি তিনি রফিক না হন, তবে তা আরো বিস্ময়কর।
লেখক আলভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষ্ণ, গভীর। মনস্তত্বের অতলে পাকা ডুবুরির মতন সাঁতার কাটতে পারেন তিনি। রফিককে তিনি এতো বাস্তব বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন, মাঝে মাঝে মনে হলো, আলভী কেমন করে জানলেন রফিক এমন?
এতো গভীরে পৌঁছলেন কী করে? আর এই যে কি নিপুণ দক্ষতায় চরিত্রের নির্মাণ, বিস্ময় তৈরী করে পাঠকদের মাঝে, একজন উত্তম গল্পকারের মুন্সিয়ানা তো এখানেই। বই থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি,
“স্কুলে আমেনা ম্যাডাম ছিলেন রফিকদের ক্লাস টিচার। তিনি প্রায়ই ক্লাসের মধ্যে সুমিকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। সুমির নাকি মা নেই। ওর জন্য রফিকের একটুও কষ্ট হয়নি। বরং মনে হতো, মা মরে যাওয়াটা খারাপ কিছু নয়। এতে ম্যাডামের অতিরিক্ত আদর পাওয়া যায়। ক্লাস ফোরে ওঠার পর যখন রফিক জানতে পারল যে তার আসল মা মরে গেছে, তখন বেশ রাগ হয়েছিল ম্যাডামের ওপর। তারও তো মা নেই। অথচ তাকে যেন ম্যাডাম চোখেই দেখেন না”।
এখানে ছোট্ট রফিকের ভেতরের অভিমান, দোলাচল কেমন বিশ্বাস করে ফেলি। আর যৌবনের রফিক যখন প্রেমে টলমল, শারমিনকে চিঠি লেখে,
“রাতে আমি চুপচাপ বাগানে বসে থাকি। বসে বসে ভাবি, আমার অন্য জীবনের কথা। এমন একটা জীবন, যে জীবনটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। সে জীবনে অতিথি হয়ে দুটো দিন কাটিয়ে এসেছি। কিন্তু কাউকে বলা হয়নি। হাওয়ায় ভেসে আসে গন্ধরাজের মিষ্টি সুবাস। আমার অসহ্য ঠেকে। রসুনের বুনো গন্ধ পেতে ইচ্ছা করে।”
এমন সময়ে এসে পাঠক রফিককে ভালোবেসে ফেলে। ফেলতেই হয়, লেখক পাঠকদের হাত ধরে নিয়ে এসে, রফিকের পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। রফিকের ‘জীবন অপেরা’-র সঙ্গী হয়ে ওঠে তারা।
আলভীর নির্মিত চরিত্ররা সহজাত, সাধারণ। কোনো ভান নেই তাদের মধ্যে। শারমিন, দীপা, সুমন কিংবা অঞ্জন কোথাও কোনো অতিরঞ্জন নেই। আমাদের জীবনে তো আমরা এমন চরিত্রই দেখি। তারা এমন করেই কথা বলে। এমন করে শাসন করে, ভালোবাসে। সবচেয়ে আরাম দেয়, এ উপন্যাসের চরিত্রদের কথোপকথন। সাজানো, বানানো কথা নয়। বন্ধু সুমনের সাথে যখন রফিকের ফোনে কথা হয়, তাতে কৃত্রিমতার লেশমাত্র নেই, এমন করেই তো আমরা বন্ধুদের সাথে কথা বলি। বই থেকে তুলে দিচ্ছি খানিকটা:
“হ্যালো, রফিক বলল।
ও প্রান্ত থেকে সুমনের গলা ভেসে এল, কী করিস?
বাতাবি লেবুর চাষ করি দোস্ত।
মানে কী?
মানেটা হলো, বিটিভিতে বাতাবি লেবু চাষের একটা প্রোগ্রাম দেখে আমি মারাত্মক রকম ইন্সপায়ারড। এখন বারান্দায় টবের মধ্যে সেই গাছ লাগানোর চেষ্টা করি।
ঠাট্টা করিস?
রাত সাড়ে তিনটার সময় ফোন দিয়ে যে জিজ্ঞেস করতে পারে, কী করিস – তার সাথে হালকা ঠাট্টা করা যেতে পারে।
হাতে কাজের চাপ কেমন?
কাজ নাই কোনো।”
এমন করেই পুরো গল্প জুড়ে তরতর করে এগিয়ে যায় কথা, তার পিঠে কথা। কোথাও কোনো জড়তা নেই।
বইটি হাতে নিয়ে আমি একটু খচখচ করছিলাম, সন্দিহান ছিলাম লেখক কেমন করে গল্পের বিভিন্ন স্তরে যাবেন? কারণ তিনি শুরু করেছেন এক চিঠি দিয়ে, শারমিনকে চিঠি লিখছেন। সেই চিঠিটিতে শেষ রাতে দেখা এক স্বপ্নের বর্ণনা। স্বপ্ন যেমন হয়, ব্যাখ্যাহীন, অসম্পূর্ণ—ঠিক তেমন। নিখুঁত স্বপ্ন। এবং সেই স্বপ্নে ঢুকতে ঢুকতেই আমি বেশ বুঝতে পারলাম, আমি রফিকের জীবনেও ঢুকে পড়েছি। যে জীবনের নাম রফিক দিয়েছে জীবন অপেরা।
একটি মাত্র জীবনে রফিক দুটো জীবন যাপন করছে। এক জীবন থেকে আরেক জীবনে ঢুকে পড়ছে, যেন দরজার এপার ওপার। দুটো জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। এক জীবনে আছে শারমিনকে কাছে পাবার লোভ। সেই লোভ এক ফাঁদ বৈ আর কিছু নয়। রফিক সে ফাঁদে ধরা দেয়, পিছে ফিরে যাওয়ার পথ তার জানা নেই। রফিকও কি সেই ফাঁদে আটকে যেতে চায়নি?
জীবন অপেরায় সেই প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে। পাঠকরা গল্পের সাথে সাথে এগিয়েছে, উত্তর খুঁজেছে। এসেছে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। কিন্তু এটি কোনো সায়েন্স ফিকশন নয়। অন্তত আমার কাছে নয়।
এটি নিখাদ প্রেমের গল্প। ওই যে বিপর্যয়ের গল্প। কিন্তু বিপর্যয়ের ফাঁকে প্রতিটি কী এবং কেন’র উত্তরও পাঠক পেয়েছে। কোথাও কোনো গাঁজাখুরি ধারণা নেই, আছে বিজ্ঞান ও নিউমারলজির কেস স্টাডি। আছে এমন এক জীবন যা আমরা দেখিনি।
এমন জীবন হয়তো আমরাও পেতে চেয়েছি। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। যা লিখেছেন, জানিয়েছেন এমন করে যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সবটুকু।
জীবন অপেরার মধু হচ্ছে এর ভাষা। টলটলে জলের মতন, তিরতির করে ঝরে, মসৃণ। এতো সহজ ভাষা পড়তে পড়তে আপনি উপলব্ধি করবেন, আপনার ভাবনাগুলো দোল দোল দুলুনির মতো করে দুলছে। খোঁচাচ্ছে। আপনি বই শেষ করবেন, কিন্তু রফিক আর শারমিনকে সাথে নিয়ে ঘুরবেন। তাদের জীবন অপেরার মঞ্চে আপনিও উপস্থিত থাকবেন। কোনো এক ক্লান্ত ভরদুপুরে ‘জীবন অপেরা’ আবারো হাতে নিতে হবে, সেই পরের লাইনটুকু জানবার অপেক্ষায়:
“এতটুকু প্রশ্রয় দিয়ো আমায়,
আমি তোমায় দেব, সারাটা জীবন”।
জীবন অপেরা একবার নয়, অনেকবার পড়বার মতন এক উপন্যাস।
আমাদের উপন্যাস।
— কিযী তাহনিন
(কথা সাহিত্যিক)