বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, বীরাগঙ্গনাদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্তুতি গেয়ে অনেক লেখকই স্মরণ করেছেন আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকে। আশার কথা হলো, এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই সকল বইয়ের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ যে বইগুলো তার মধ্যে একটি হলো ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি’। কেন এই বইটির গায়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তকমা লাগিয়ে দেয়া হলো? চলুন, সেই বিষয়েই তাহলে আলাপ করা যাক।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা গবেষণামূলক, অনুসন্ধানী প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার সহজ, সাবলীল ভাষা এবং নির্মোহ লেখা পাঠকের মনে দ্রুত পৌঁছায়। তার লেখার বর্ণনাভঙ্গী, সূত্রের গ্রহণযোগ্যতা সহজেই পাঠকের আস্থার্জনে সক্ষম। বাংলাদেশী পাঠকদের জন্য তার এমনই একটি বই ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি’।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের গণহত্যা, নির্যাতন এবং ধর্ষণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সীমিত। এই বিষয়গুলো নিয়ে যে একধরনের রাজনীতি বিদ্যমান তা-ও আমাদের অনেকেরই ধারণার বাইরে। ১৯৭১-এর গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। এর একমাত্র এবং অন্যতম কারণ দেশীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান। এ দেশেরই কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষগুলো নিয়ে রাজনীতিতে মেতেছে, যার ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরও গণহত্যা-নির্যাতন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে ঘটনার সত্যতা তুলে ধরতেই এই বইয়ের আগমন। গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের তথ্যভিত্তিক ভয়াবহ সব ঘটনার পরম্পরা উঠে এসেছে ২০১৯ সালে কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মুনতাসীর মামুনের বাংলাদেশ ১৯৭১ : হত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে আরও আছে গণহত্যা-নির্যাতনের কিছু বিরল ও দুর্লভ আলোকচিত্র।
গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট-এর সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন এর মতে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, গণহত্যা এবং মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনটাকেই এত বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল যে এর পেছনের ঘটনাগুলোকে খুব গৌণভাবে দেখেছেন বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা। এর সাথে জড়িত ছিল আন্তর্জাতিক স্বার্থ। এর ফলে আমাদের সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ ঢাকা পড়ে যায়। আড়ালে রয়ে যায় পাকিস্তানী খান সেনাদের বর্বর গণহত্যার ঘটনাগুলো। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্থানীয় দোসর, রাজাকার, আল বদরদের সঙ্গে মিলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে অন্তত ৫০,০০০ বেসামরিক মানুষ শহীদ হয়। লেখক যদিও উল্লেখ করেছেন, “শহীদদের সংখ্যা নিয়েও অনেকেই রাজনীতি করেছে”। অনেকে তো গণহত্যার বিষয়টি নির্লজ্জের মতো অস্বীকারই করে।
পরবর্তী ন’মাসে গোটা বাংলাদেশে তারা কয়েক দফায় গণহত্যা চালিয়েছে। সাধারণ বাঙ্গালীদের কারণে-অকারণে নির্যাতন করেছে। এই ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশের সরকার ২০১৭ সাল থেকে ২৫ মার্চকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু, বিভিন্ন রাজনীতির শিকার শহীদেরা তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ধর্ষণের খবর যা-ও একটু আনুমানিক ধরা হয়েছে, তারচেয়েও অনেকাংশে বেশি হয়েছে। আমরা সংখ্যাটা ২ লক্ষ জানলেও আদতে আরও কয়েক লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানী হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সেই সকল তথ্য সাক্ষ্য-প্রমাণসহ বইতে পাওয়া যাবে।
লেখক মুনতাসির মামুন দুঃখভরা মনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তা আর কোনো একটি দেশে এত ভয়াবহভাবে হয়েছে বলে জানা যায়নি। এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যা আর নারী নির্যাতনের দৃষ্টান্ত একমাত্র বাংলাদেশ। এত নির্যাতন, লুন্ঠন কোথাও চালানো হয়নি। কিন্তু আমাদের মানসজগতে তা ঠিক তেমনভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। আমরা শুধু স্বাধীনতা অর্জন দেখেছি, শহীদদের দেখিনি।
যদি প্রথম থেকেই গণহত্যার মতো বিষয়টিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করা যেত তাহলে ’৭১ এর পরে যে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছিল, এমনকি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যাও হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু দেশীয় এবং বিশ্ব-রাজনীতি এই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটি কখনোই গুরুত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত করতে দেয়নি।
এই গ্রন্থে লেখক বেশ কিছু দুর্লভ ছবি ব্যবহার করেছেন যা সেসব নির্যাতনের সাক্ষ্য বহন করে। কোথায় কোথায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেই সংখ্যাটা কত ছিল, এমন সব তথ্য এবং ছবি দিয়ে বইটি একটি জ্বলজ্বলে সাক্ষী।
গণহত্যা-নির্বিচারের স্বীকৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে লেখক তার গ্রন্থে বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বিশ্বকে বেরিয়ে আসতে হলে একাত্তরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, তার স্বীকৃতি এবং সম্মান প্রয়োজন। আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অর্ধ-শতবর্ষে পদার্পণ করেও যুদ্ধে শহীদ হওয়া মানুষদের যোগ্য সম্মান দিতে অপারগ। বইটি মুক্তিযুদ্ধকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে সাহায্য করবে। জানা-অজানাকে ঝালাই করে নিতে, ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি’ বইটির তুলনা নেই।
লিখেছেন…
–আফরা নাওমি