সৃজনশীলতার বিস্তার এবং দেশের নবীন-প্রবীণ লেখকদের রচনা তুলে ধরতে কথাপ্রকাশ-এর যাত্রা শুরু ২০০২ সাল থেকে। অগণিত পাঠকের চাহিদাকে সামনে রেখে নিয়মিত বিচিত্র বিষয়ক বই প্রকাশ করে চলেছে কথাপ্রকাশ। দেশের নবীন-প্রবীণ প্রতিভার সম্মিলন ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে গ্রহণ করেছে নানামুখী উদ্যোগ। ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমির ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় অংশগ্রহণ করে আসছে। এছাড়া পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযােগ স্থাপনের জন্য প্রতি বছর রাজধানীর কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, শিশু একাডেমিসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় আয়ােজন করে চলেছে ‘কথাপ্রকাশ বই উৎসব’ । কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা। ২০১৩ সাল থেকে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি লাভ করেছে কথাপ্রকাশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বহির্বিশ্বে বাংলাভাষীদের কাছে বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। নিচে কথাপ্রকাশের সেরা ৫টি বই নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১। বিদ্রোহী বাঙালী
শিশু-কিশোরদের জন্য লিখে মুনতাসীর মামুন প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। শিশু-কিশোরদের নিয়ে তার সব লেখা ছয় খণ্ডে কিশোর সমগ্র হিসেবে প্রকাশ হয়েছে। আরও দুই খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। এখন খুব একটা তিনি লেখেন না শিশু-কিশোরদের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের ৫০ বছর উপলক্ষে লিখলেন একটি ইতিহাস গ্রন্থ- বিদ্রোহী বাঙালি। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সময় বাঙালিদের বিভিন্ন বিদ্রোহের কথা আলোচনা করা হয়েছে। বাঙালিদের অধিকাংশ ছিলেন কৃষক। কেন বার বার বাঙালিরা বিদ্রোহ করেছেন, এ ইতিহাস নিয়েই এই বইয়ে লিখেছেন তিনি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানতে এই বই অবশ্যই পড়তে হবে।

২। চলচ্চিত্রযাত্রা
তারেক মাসুদ বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল চলচ্চিত্রকার। চলচ্চিত্রচর্চা ও চিন্তার আন্দোলনে অগ্রগামী তারেক মাসুদ কেবলমাত্র একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না। তারেক মাসুদের বহুমুখী চিন্তাশীল তৎপরতার নিদর্শন ও আভাস ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’য় অন্তর্ভুক্ত ৩৮টি প্রবন্ধে আমরা পাই। আমরা বিশ্বাস করি ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বাংলাদেশের ইতিহাস সমাজ, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র সংস্কৃতিসহ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের আত্মানুসন্ধানে তারেক মাসুদের চিন্তা ও দর্শন উপলব্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বইটিতে আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, আলোচনা আছে চলচ্চিত্রের গল্পসৃষ্টি ও এর পেছনের গল্প নিয়ে। এছাড়াও চলচ্চিত্রের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ও অন্যান্য খন্ড ভাবনা তুলে আনা হয়েছে। আলোচনা আছে রবীন্দ্র সাহিত্যরে চলচ্চিত্রায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ টপিকেও।

৩। বীজগণিতের আদিপুস্তক : কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা
মধ্যযুগের মনীষী মুসলিম গণিতবিদ মুসা আল খাওয়ারিজমির সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’। বাগদাদের খলিফা আল মামুনকে উৎসর্গিত এই গ্রন্থটিকে বীজগণিতের আদি পুস্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ- এখান থেকেই পরবর্তীতে গণিতের উল্লেখযোগ্য শাখা বীজগণিত জন্মলাভ করে। আল খাওয়ারিজমির মাধ্যমেই বীজগণিতের ধারণা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বীজগণিতের ইংরেজি নাম ‘এলজেব্রা’ শব্দটিও এসেছে তাঁর দেওয়া ‘আল জাবর’ শব্দবন্ধ থেকেই। ধারণা করা হয়, কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা-র রচনাকাল ৮১৩ সাল থেকে ৮৩৩ সালের মধ্যে। বইখানা মোট তিনভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশটি মৌলিক বীজগণিত সম্পর্কিত, দ্বিতীয় অংশে রয়েছে জ্যামিতি ও জ্যামিতিক পরিমাপের প্রসঙ্গ এবং তৃতীয় অংশে আলোচিত হয়েছে ইসলামি আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারদের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টনবিষয়ক গাণিতিক আলোচনা। এ বইয়ের আগে গাণিতিক সমীকরণ সমাধানের এত সহজ ও সরল পদ্ধতি পৃথিবীর আর কারো রচনায় পাওয়া যায়নি। তার ওপর, আল খাওয়ারিজমিই প্রথম বীজগণিতের জ্যামিতিক ব্যাখ্যাও প্রদান করেন। বিশ্বজুড়ে গণিতচর্চার প্রচলিত ধারাকে আমূল পাল্টে দেওয়া এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি প্রথমবারের মতো বাংলায় অনূদিত হলো গণিত-বিশারদ লেখক সফিক ইসলামের হাতে। প্রাসঙ্গিক পাঠ হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে আল খাওয়ারিজমির বিস্তৃত জীবনকথা, বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা ও প্রয়োজনীয় টীকাভাষ্য। পরিশ্রমসাধ্য অনুবাদকর্মটির মাধ্যমে পাঠকেরা একটি প্রাচীন গণিত পুস্তকের স্বাদ পেতে যেমন সক্ষম হবেন, তেমনি বুঝতে পারবেন কীভাবে মধ্যযুগের একজন মুসলিম গণিতবিদ মাত্র একটি বইয়ের মাধ্যমে গণিতশাস্ত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। গণিতে আগ্রহীদের জন্য তো বটেই, যেকোনো জ্ঞানপিপাসু পাঠকেরও বইটি অবশ্যপাঠ্য।

৪। আপনার শিশু সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত
শিক্ষার অর্থ স্রেফ জ্ঞানসঞ্চার আদ্যিকালের সেই ধারণাটি যদি সর্বদাই পোষণ করা হয়, তা হলে মানুষের ভবিষ্যৎ উন্নতির তেমন কোনো আশা নেই। কারণ- জ্ঞানসঞ্চারে কী লাভ যদি ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশ পিছিয়ে পড়তে থাকে? এর পরিবর্তে আমাদের একটি আত্মিক সত্তা, একটি সামাজিক ব্যক্তিত্ব, একটি নতুন বিশ্বশক্তির কথা বিবেচনা করতে হবে, যা বর্তমানে আচ্ছন্ন ও উপেক্ষিত। সাহায্য ও পরিত্রাণ যদি আসতে হয়, তা হলে তা আসতে পারে কেবল শিশুদের কাছ থেকে, কারণ- শিশুরাই মানুষের নির্মাতা। শিশুদের মনস্তত্ব বোঝার ক্ষেত্রে এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বইটি অনূদিত হয়েছে ডক্টর মারিয়া মন্টেসরির ভাষণ ও রচনা থেকে। ডক্টর মন্টেসরি কি শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও অন্তর্নিহিত ক্রিয়াবলীর মৌলিক সত্যগুলোর নাগাল পেয়েছেন? তার প্রবর্তিত পদ্ধতি কি ভবিষ্যতের দক্ষ, সেবাপরায়ণ ও সুখী মানুষ গঠনের জন্য অনুকূল? এ ধরনের স্বাধীনতা, এমন আত্মনির্ভরতা, কাজে এবং সেবায় এমন শৃঙ্খলা, গতিশীল্পতার এমন আনন্দ- এগুলোই হলো মন্টেসরি পদ্ধতির সারকথা। বইটি শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করছেন এবং অভিভাবকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

৫। ১৯৭১ : বিজয়ের গৌরবগাথা
সম্প্রতি যে কজন গুণী মানুষ একক প্রচেষ্টায় গবেষকের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গ্রন্থ রচনার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সালেক খোকন উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে এ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন যাঁরা, এমন বিশজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাথা ও যুদ্ধদিনের নানামাত্রিক অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে সালেক খোকনের ‘১৯৭১: বিজয়ের গৌরবগাথা’ গ্রন্থটি।
এ গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধস্মৃতি, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম, শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয় ও অন্যান্য ভাবনা সুচারুভাবে বর্ণিত হয়েছে। সন্নিবেশিত করা হয়েছে একাত্তরের বিভিন্ন দলিল ও দুর্লভ আলোকচিত্র। এসব তথ্য গ্রন্থটিকে অভিনবত্ব দিয়েছে। এই গ্রন্থে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় লেখক তুলে এনেছেন দেশের ও মানুষের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, যুদ্ধে তাঁদের ক্ষতি ও ক্ষত, বীরত্ব, পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাঁদের আশাবাদ এসব অনুষঙ্গ।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই গ্রন্থে আরও জানা যাবে ক্যামেরা ছিল কার একাত্তরের হাতিয়ার, কর্নেল তাহের আহত হন কীভাবে, ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর কেন এবং কীভাবে রক্ত ঝরেছিল ভারতীয় হাইকমিশনে, একাত্তরে গেরিলাদের গ্রিন রোড অ্যাটাক ও অপারেশন জ্যাকপট কীভাবে পরিচালিত হয়, বঙ্গবন্ধু কাকে বলেছিলেন আলালের ঘরের দুলাল, হনুমান কোম্পানি কতটা দুর্ধর্ষ ছিল-এমন অজানা ইতিহাস। ১৯৭১ সালে এ দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন যাঁরা, এমন বিশজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাথা ও যুদ্ধদিনের নানামাত্রিক অভিজ্ঞতাও জানা যাবে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস বিনির্মাণে লেখকের যে অঙ্গীকার ও প্রয়াস অব্যাহত আছে, সেদিক থেকে এ গ্রন্থ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ১৯৭১: বিজয়ের গৌরবগাথা গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের নতুন জানালা উন্মোচনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি এ গ্রন্থ যে কোনো বয়সী পাঠকের মনে উন্মেষ ঘটাবে দেশ ও মানুষের প্রতি প্রদীপ্ত অঙ্গীকার।
আরও পড়ুন- একজন হাসান আজিজুল হক এবং তাঁর সাহিত্য
কথাপ্রকাশের সকল বই দেখতে ক্লিক করুন