ফেব্রুয়ারি মাসটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বেশ প্রতীক্ষিত মাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির সংগ্রাম সারাবিশ্বে মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর এক বিশেষ মাস এই ফেব্রুয়ারি। আর এই একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে আয়োজন করা হয় একুশে বইমেলা।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় বইমেলা। ফেব্রুয়ারি তাই একই সাথে বইপ্রেমীদেরও বহু প্রতিক্ষীত একটি সময় বলা চলে। এই বইপ্রেমীদের জন্য লেখক, কবি, সাহিত্যিকরাও নিত্যনতুন সংযোজনে ভরিয়ে রাখেন এই বইয়ের বিশাল সংগ্রহ।
বইমেলায় প্রতি বছর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন বিষয়ের সাহিত্যকর্ম। পাঠকের মন জয়ের লক্ষ্যে সাহিত্যিকরা চেষ্টা করেন তাদের কাছে হৃদয়গ্রাহী ও ভিন্নধর্মী নতুন আঙ্গিকের লেখা পৌঁছে দিতে। তবে কিছু কিছু বিষয় সবসময়ই সব বয়সের পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে, তাদের হৃদয়ে বই পড়ার স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে পারে। এমন একটি বিষয় হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্ম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে উপন্যাস, কবিতা এবং প্রবন্ধ– সবই নতুন প্রজন্মের কাছে না দেখা সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জানার, সেই সময়কে কিছুটা হলেও অনুধাবন করার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তাই বইমেলায় প্রতি বছরই লেখক-সাহিত্যিকগণ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বই প্রকাশ করেন। পাঠকেরা মেলায় ঘুরে-ফিরে শত স্টল থেকে উল্টে-পাল্টে বেছে নেন নিজের পছন্দের বইটি; এভাবেই জনপ্রিয়তা পায় বইটি এবং পরিচিতি পান লেখক।
২০২০ সালের বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় পাঠক সাড়ার দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পায় বরাবরের মতই। এসব বইয়ের কাতারে পাঠকনন্দিত বেশ কিছু বই সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়ে রাখা যাক তবে।

১. বাংলাদেশ ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতনের রাজনীতি – মুনতাসীর মামুন
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামের সাথে ছিল জটিল রাজনৈতিক কৌশলের প্রয়োগও। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর নীলনকশায় গণহত্যা ও নির্যাতনের যে ভয়াবহ রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল, সাধারণ জনগণের কাছে তা ছিল অনেকটাই অজানা। মুনতাসীর মামুনের বইটিতে সেই অজানাকেই জানানোর প্রয়াস দেখা যায়। বইটির আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু কৌতূহলী পাঠকের মনে স্থান করে নিয়েছে এবং বেশ সাড়া ফেলেছে এবারের বইমেলায়।

২. বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে – মেজর রফিকুল ইসলাম (পিএসসি)
১৯৭১ সাল, ডিসেম্বর মাস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী বিভীষিকাময় যুদ্ধ শেষের দিকে, জয়ের পতাকা ওড়ার বাকি আর কয়েকটা দিন। এমন এক সময়ে বিজয় যখন কড়া নাড়ছে, তখনই এক অন্ধকার রাতে নেমে আসে মৃত্যুদূতেরা। একে একে ধরে নিয়ে যেতে থাকে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের, যাদের ফেরত আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে পরিবার। কিন্তু ফিরে আসেননি তাঁরা। ১৫ তারিখ সকালে রায়েরবাজারে পাওয়া যায় তাঁদের মৃতদেহ। এই ভয়াবহ অপরাধের নীলনকশায় ছিল দেশকে মেধাশূন্য করার হীন পরিকল্পনা। আর এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক ও গবেষকদের মতামত এই বইটিতে তুলে ধরেছেন লেখক। বিশ্ববাসীর নজরে তীব্র নিন্দার জন্ম দেওয়া এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের ঘটনা নিয়ে লেখক এই বইটি লিখেছেন।

৩. ত্রিশ লক্ষ শহিদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা – আরিফ রহমান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণযুদ্ধ। যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ও শহীদ হয়েছেন এদেশের আপামর জনতা। তবে সেই যুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে নানা সময়েই প্রশ্ন উঠেছে, রয়েছে বিতর্ক। এই বিতর্কের একটি স্পষ্ট প্রত্যুত্তর হিসেবে আরিফ রহমান রচনা করেছেন এই গ্রন্থটি। যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের পরিবার, বীরাঙ্গনাদের বক্তব্য ও জবানবন্দি এবং দেশ-বিদেশের নানা রেকর্ডের উপস্থাপনের মাধ্যমে লেখক যুদ্ধের স্বরূপ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে তিনি প্রমাণ করেছেন যুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা। বিতর্কের ও বিভিন্ন মহলের গুজবের জবাব হিসেবে এই ভিন্নধর্মী বইটি তাই পাঠকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

৪. বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ – মতিউর রহমান
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের পর আসে ১৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের বিজয়ের আখ্যান। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ অবসানের সুখবর ও বিজয়ের বার্তা। পথে-ঘাটে আনন্দ মিছিল বের করে সাধারণ জনগণ। একটি জাতির জীবনে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার মতো আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? বিজয়ের সেই অসাধারণ ক্ষণটি কীভাবে এসেছিল এই জাতির বুকে, তা লেখক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর লেখায়। এবারের বইমেলায় বিজয় মুহূর্তের সেই আনন্দক্ষণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা বইটি বেশ সাড়া পেয়েছে পাঠকসমাজের কাছে।

৫. মুক্তিযুদ্ধ-সমগ্র – রফিকুল ইসলাম
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতন থেকে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে লাল-সবুজের এক গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিসর্জনের চেতনার এক বহিঃপ্রকাশ। এই সময়কালে সম্পূর্ণতা আসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এই বইটি হলো বাংলাদেশের জন্মের জন্য করা যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে রফিকুল ইসলামের সংকলন।

৬. বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা – আরিফ ইসলাম
বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যাবতীয় মহাগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নির্ভুল জ্ঞানের সন্ধান দেওয়ার লক্ষ্যে লেখক এই বইটি রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু, উনিশশো একাত্তর, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহের শেষ নেই। এ থেকে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডাও। এসব বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠ উত্তর লেখক আরিফ ইসলাম এই বইটিতে দিয়েছেন। ২০২০ সালের বইমেলায় বইটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

৭. ১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধু লাশ এবং – ইজাজ আহমেদ মিলন
১৯৭১ সালে গাজীপুরের বেলাই গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলায় যেন নরক নেমে আসে সেখানে। মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার এই মিশনে তারা চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টাতেও সফল হতে পারে না গ্রামের সাধারণ মানুষ। এই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে শহীদেরা বহুকাল স্থান পাননি স্বাধীনতার দলিলপত্রে। ৩ বছর অনুসন্ধানের পর বেরিয়ে আসে বাড়িয়া গণহত্যার চিত্র। সেই রোমহষর্ক দিনগুলোর বিভীষিকা লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন তুলে ধরেছেন তাঁর চমৎকার রচনাশৈলীতে। বইটি এবারের বইমেলায় পেয়েছে বিপুল সাড়া ও পাঠকপ্রিয়তা।