পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের তেইশ বছরের একতরফা সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে ২৫ মার্চ রাতে। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কামান ও ট্যাংক বহর নিয়ে বাঙালিদের অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে। সারাদেশে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করতে থাকে। ইসলামী পাকি মুখােশ’ ঝলসে উঠে যখন মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমান মেয়েদের ধরে পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করতে থাকে। হাজার হাজার বাঙালি নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের লােভ-লালসার শিকার হয়।
আজ একটা পক্ষ বিতর্ক সৃষ্টি করতে যেয়ে ধুয়া তােলেন যে, ১৯৭১ সালে নয়মাস মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ দেয়নি। পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল। মাত্র তিন লক্ষ বাঙালি। ভাবটা এই যে, তিন লক্ষ বাঙালির প্রাণ এমন কিছু নয়, পাকিস্তানিদের এতে অপরাধ দেওয়াও চলে না!
আজ যদি ধরেও নেওয়া হয়, তিন লাখ বাঙালিই সেদিন মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিল। এ হিসাব কি ছােট? তিন লক্ষ মানুষের জীবন কি এতই কম যে তাকে নিয়ে পরিহাস করতে হবে? বিতর্ক করতে হবে?
২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও গােলাবর্ষণের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নতুন করে কোনাে ঘােষণা দেওয়ার প্রয়ােজন ছিল না। কারণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল ক্ষমতাকে দখল করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বাকি ছিল সামান্য দিক। কারণ- ঢাকাসহ সারাদেশের সেনানিবাসগুলােতে লক্ষাধিক পাকি সৈন্য অবস্থান করছিল। বঙ্গবন্ধুর মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের উওাল দিনগুলােতে এই সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ মীমাংসার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
এ সময় তিনি বারবার বলেছেন, “সে-ই হচ্ছে সফল সিপাহসালার যে রক্তপাত বিনে উদ্দেশ্যপানে যেতে পারে।” রক্তপাত যাতে না ঘটে, সেই প্রচেষ্টা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন । বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেছিলেন। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর মীমাংসার প্রচেষ্টার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি রক্ত দিয়েছে। এই রক্তপাত ছাড়া স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ধৈর্য তাকে মহামানবে রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু তিনি এও ধারণা দিয়ে রেখেছিলেন, পাকিস্তানিরা যদি আক্রমণ শুরু করে তাহলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হবে। এই ঘােষণা অত্যন্ত স্পষ্ট করে বঙ্গবন্ধু আবার ৭ মার্চের রেসকোর্সের ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দিয়েই রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন :
“আর যদি একটি গুলি চলে এবং আমার লােককে হত্যা করা হয়, তাহলে তােমাদের কাছে আমার অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করাে।”
বঙ্গবন্ধুর আগাম এই যুদ্ধ ঘােষণা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি শান্তিপূর্ণভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নের মীমাংসা করে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যদি একটি মাত্র গুলি চলে অথবা আর একটি মাত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হবে এবং যুদ্ধ করেই স্বাধীনতার প্রশ্নের মীমাংসা করে নিতে হবে।
এইরকম সিদ্ধান্তের আরাে একটি তাৎপর্য ছিল এই যে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করবে না, পাকিস্তানিরা যদি বাঙালিদের করে, তাহলেই বাঙালিরা প্রতিরােধ করবে। এই রাজনৈতিক অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সহায়ক হয়ে উঠেছিল। যদি আগে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ করত, তাহলে পাকিস্তানিরা বহির্বিশ্বে বলে বেড়াত যে, পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ চালানাে হয়েছে তাই তারাও বাঙালিদের উপর আক্রমণ করার অধিকার রাখে। এই প্রচার পাকিস্তানিদের গণহত্যার পক্ষে একটা বড় ধরনের পয়েন্ট হয়ে থেকে যেত।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা এমনিভাবে সেদিন মার খেয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর পূর্ব-ঘােষণা ও নির্দেশ অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানিদের হামলার পর বাঙালিদের প্রতিরােধ যুদ্ধ আপনা-আপনিই শুরু হয়। নতুন করে স্বাধীনতা ঘােষণা ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘােষণার প্রয়ােজন ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি পত্রপত্রিকার তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন
১৯৭১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যাতেই ‘লন্ডন টাইমস্ রিপাের্ট করে –
“শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে
‘বাঙালি জাতির কথা উল্লেখ করেন।”
২৪ ফেব্রুয়ারি ‘লিভারপুর ডেইলি পােস্ট’ মন্তব্য করে :
“হোয়াইট হলে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ পর্ব পাকিস্তান নিজে স্বাধীন বাঙালি মুসলিম প্রজাতন্ত্র বলে ঘােষণা করবে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে এখন আর পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছেন না, বলছেন বাঙলা প্রজাতন্ত্রের কথা । হােয়াইট হলে এটা অনুধাবন করা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সরকার একটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশবিভক্তির মারাত্মক সম্ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছেন।”
১৯৭১ সালে ৩ মার্চ ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’ পত্রিকা ২ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকার সাংবাদিক সম্মেলনের খবর পরিবেশন করে বলে :
“আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় তাড়াহুড়াে করে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বললেন, আওয়ামী লীগ মার্চ মাসের ৭ তারিখে একটি জনসভা অনুষ্ঠান করবে এবং এই সভায় তিনি বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি প্রদান করবেন। তিনি স্বাধীনতার দাবি করবেন কিনা একথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অপেক্ষা করুন।”
৯ মার্চ সংখ্যায় ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা মন্তব্য করে :
“শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা একরকম ঘােষণাই করেছেন; ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রদত্ত ৪ দফা দাবির মধ্যেই একথা লুকায়িত রয়েছে।… আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তাঁর আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে জাতীয় পরিষদে সহযােগিতার জন্য ভিন্ন শর্ত আরােপ করেন, যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেন না।”
একই দিনে ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে:
“আমরা ইতিমধ্যেই পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য শুনছি যা বাংলাদেশ কিংবা বঙ্গভূমি হতে পারে। এর পতাকাও বানানাে হয়ে গেছে।”
১৫ মার্চ নিউইয়র্ক ভিত্তিক ‘টাইম’ সাপ্তাহিক রিপাের্ট করে :
“পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করনে আসন্ন বিভক্তির পশ্চাতে যে মানুষটি রয়েছে তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। গত সপ্তাহে ঢাকায় শেখ মুজিব ‘টাইম’-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে বলেন, “বর্তমান পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝােতার আর কোনাে আশা নেই।” তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা বলেন এবং জানান যে তাঁর অনুগামীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর দিতে অস্বীকার করেছে যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। মনে হচ্ছে তিনি (শেখ মুজিব-লেখক) তাঁর ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন।… এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের এই নেতা (শেখ মুজিব-লেখক) পশ্চিম পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বলেন, “আমি তাদের পঙ্গু করে দেব এবং তাদের নতি স্বীকার করতে বাধ্য করব।” “
‘টাইম ম্যাগাজিনের এই আমেরিকান সাংবাদিক ডন কগিন সম্ভবত ৭ মার্চে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ মন্তব্যের কারণেই আমি তাদের পঙ্গু করে দেব’ শীষর্ক রিপাের্ট পাঠায়। বস্তুত বঙ্গবন্ধু এদিন একথা বলেছিলেন পাকিস্তানিদের অস্ত্রের খেলা এবং বিভিন্ন জেলায় বাঙালিদের গুলি করার প্রতিবাদ হিসেবে। গুলি চালানাের প্রতিরােধে ‘ভাত পানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘােষণা অনেক অনেক বেশি মার্জিত প্রতিবাদ। একথা সেদিন আমেরিকান এই সাংবাদিক-বন্ধু হয়তাে উপলব্ধি করতেও সমর্থ হননি ।
১৬ মার্চ লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা তার সংবাদদাতা মার্টিন এডেনি-এর পাঠানাে প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে জানায় :
“সারা পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত অন্যান্য কমিটির মতাে সংগ্রাম পরিষদেরও আলােচনার বিষয় ছিল, তাদের বিবেচনায় ইতােমধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ’ তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। ৫৮টি গ্রাম থেকে প্রায় শ তিনেক লোক একত্রিত হয়েছে। তারা প্রয়ােজনবোধে সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত এবং এজন্য তারা এমন একজন গ্রামবাসীর কাছে ট্রেনিং নিচ্ছে যুদ্ধবিদ্যা যার একমাত্র অধিকার।”
একই দিনে ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকা ১৪ মার্চে বঙ্গবন্ধুর নতুন জারি করা নির্দেশের বরাত দিয়ে মন্তব্য করে :
“মিস্টার মুজিবুর রহমান, এসব নির্দেশ জারি করে বলেছেন যে, তিনি ‘বাংলাদেশ’-এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করছেন।”
হংকং ভিত্তিক পত্রিকা ‘ফার ইস্টার্ন ইকোমিক রিভিউ’ ২০ মার্চ সংখ্যায় লেখে :
“প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর পরবর্তী উদ্যোগের কথা ভাবছিলেন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঢাকার বাড়িতে আমাদের প্রতিনিধিকে বললেন, এটাই শেষদফা। শেখ মুজিবের বাসভবন বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন প্রতীক দিয়ে সুসজ্জিত ছিল। একথার কী অর্থ তা জিজ্ঞেস করায় তিনি সেই স্লোগানটি দিয়ে তার জবাব দিলেন যা তিনি হাজার হাজার বার জনতার সামনে উচ্চারণ করেছেন, ‘জয় স্বাধীন বাংলা’, ‘স্বাধীন বাংলা দীর্ঘজীবী হােক।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার ইতিহাসের কাহিনী দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান ঘটনা। এর মূল্যায়নে ও ইতিহাস অনুসন্ধানে কোনাে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দলীয় রাজনীতির বহির্ভূত একটি বিষয়। মাত্র দুই দশকের মধ্যেই এই মহান ঘটনা নতুন বাঙালি প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। কী ছিল সেদিনের আসল ঘটনা, কেমন করে ঘটল সব বীরত্ব কাহিনী, যারা এর প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের পবিত্র দায়িত্ব তা লিপিবদ্ধ করা কোনােপ্রকার উদ্দেশ্যপ্রণােদিতা ছাড়াই।
হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রচেষ্টা ছিল কিন্তু বারবারই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে সেই মহান স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করা হয়। আর এর পেছনে ছিল কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাগাতার আপসহীন ভূমিকা, মরণজয়ী লড়াই এবং ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ।
তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ, ড. মোহাম্মদ হাননান
ড. মোহাম্মদ হাননানের বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জনপ্রিয় বইগুলো দেখুন