বেশ কয়েকদিন হলো শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। জ্বর, মাথা ব্যাথা সাথে আবার শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ব্যাকপেইন। আগে কখনও ব্যাকপেইন হয়নি, তাই ব্যাকপেইনের কষ্টটা নতুন আমার কাছে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় সারাক্ষণ শুয়ে থাকা ছাড়া তেমন কাজও নেই। কাজ যে একেবারেই নেই তা বললে একরকম ভুল হবে এই জামানায়, ফেসবুক আর ইউটিউব দেখা। কিন্তু সারাটা দিন-রাত কি আর ফেসবুক-ইউটিউব ভালো লাগে? না, লাগে না। কী করা যায় ভাবতেই রুমে কিছু বাইরের দিকে নজর যায়। ইদানীং, না, বেশ কয়েক বছর হলো বই খুব একটা পড়া হয় না। পড়ার সময় গিলে খেয়েছে ফেসবুক আর ইউটিউব। আগে, বেশ আগে, যখন মাধ্যমিকে পড়তাম, তখন স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই আনতাম প্রতিদিন। পড়তাম। পড়া শেষ হলে ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে আসতাম। বড় ভাই আর আমি একই স্কুলে ছিলাম। সে-ই প্রথম বই নিয়ে আসে, তারপর আমি। বড় ভাই, বাবা বই পড়তেন। তাদের দেখে পড়তে পড়তে কেন জানি বই পড়া একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি গল্পের, উপন্যাসের বই না পড়লে ভালোই লাগত না।
সে অনেক কথা। বইপড়ার প্রতি আবেগ-ভালোবাসা মিলে একটি সুখকর স্মৃতি হয়ে আছে। আর আমি কেন এসব লিখছি বা কেন সেই দিন গুলোর কথা মনে করছি তার দায় হয়তো লেখক অসীম হিমেল কে নিতে হবে। না, দোষ দিচ্ছি না। তার লেখা বই “দূরবীনে ব্যাকবেঞ্চার” সেই বার বার সেই স্মৃতিগুলোই মনে করিয়ে দেয়, মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা। যে দিনগুলোতে না ছিল এই কর্মময় জীবনের তিক্ততার স্বাদ। বইটি পড়ছি আর বার বার মনে পড়ছে স্কুল জীবনের দিনগুলো, যখন বন্ধুরা মিলে ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে হইচই, আনন্দ-উল্লাসে কাটাতাম। মনে পড়ছে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালানোর ইতিহাস। ক্লাসে সবাই যে বন্ধু হয়, তা তো না, কয়েকজন এমন হয়, যারা আত্মার সাথে মিশে থাকে। তাদের সাথে অনেক স্মৃতি।
“দূরবীনে ব্যাকবেঞ্চার” বইটিতে লেখক অসীম হিমেল যেন সেই স্কুল, কলেজ জীবনের স্মৃতি একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছেন। বইটি উঠতি বয়সি ০৩ জন কিশোর এর ছাত্র জীবনের মর্মস্পর্শী স্মৃতিতে নির্ভর করে রচনা করেছেন। কমল, রাশেদ এবং শুভ্র। এরা তিন বন্ধু প্রথমবার কোনও ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায় না। আর এই চান্স না পাওয়া যেন তাদের নিজেদের চেয়ে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের কষ্ট আরও দিগুণ করে দিয়েছে। তারা কেন চান্স পেল না, পড়াশুনা করো নি তাই চান্স পাও নাই, ছাত্র ভালো না, আমার ঐ অমুক বা অমুকের ছেলে বা মেয়ে দেশের ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে তোমরা জানো ইত্যাদি সব প্রশ্নে আর অপমানে তাদের প্রায় নাজেহাল অবস্থা। তাই তারা সারাদিন নদীর তীরে বসে গল্প করে আবার কখনও তাদের প্রিয় ব্যান্ডের গান গায় একসাথে, বৃষ্টিতে ভেজে, কখনও আবার কষ্টগুলো মনে করে কাঁদে। এই সময় তারা লোকালয় বা লোকজন থেকে দূরে থাকে লোকজনের কাছে অপমান আর কৈফিয়তের ভয়ে।
এই টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা তিনজন প্রতিজ্ঞা করে যে, এবার তারা আরও ভাল করে পড়বে এবং ভার্সিটিতে ভর্তি হবে একসাথে। চলতে থাকে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পড়াশুনা, আড্ডা আর প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্ছু, জেমস, হাসানের এবং প্রিয় ব্যান্ড ব্যাকবেঞ্চারের জ্যাকের গান। এ-বছর তারা ভার্সিটিতে ঠিকই চান্স পায় কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তিন জন তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলাদা হয়ে যায় তারা এবার। তবে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করে তিন জন তারা সারা জীবন একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখবে।
প্রতিজ্ঞা তো তিন বন্ধু করেছিল কিন্তু তাদের ভাগ্যে কি তা লেখা ছিল? না, ছিল না। তাদের জীবনের পরবর্তী ঘটনা তাদেরকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। ভার্সিটির অপরাজনীতি আর না পাওয়া প্রিয়তমার স্মৃতি যেমন শুভ্রকে এই দেশে থাকতে দেয়নি, আবার সেই সুদূর আমেরিকা গিয়েও বিশ্ব রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে জীবন থেকে ১৬ টি বছর হারিয়ে যায় গুয়ান্তানামো বে কারাগারে। জীবনকে নতুন করে দেখার সুযোগ হয়নি আর। দীর্ঘ ১৬ বছর পর যখন শুভ্র দেশে ফেরে তখন আর এই দেশে তার কেউ ছিল না। বাবা-মা মারা গেছে সন্তানের শোকে, সে জানেও নি। প্রিয় বন্ধুগুলোও জানে, সে আমেরিকাতে মারা গেছে সেই ১৬ বছর আগেই।
কথায় বলে ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের পক্ষে লেখা হয়। সত্যিই তাই। শুভ্রর জীবনে যেন বিজয় হাতে ধরা দিয়েও তা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে তার বার বার মনে পড়ছে নচিকেতার গানের কয়েকটা লাইন;
‘বিজয়ীরা বরাবর ভগবান এখানেতে,
পরাজিতরা পাপী এখানে,
রাম যদি হেরে যেত, রামায়ণ লেখা হতো, রাবণ দেবতা হতো সেখানে,
কেন পথ নিয়ে মাথাব্যথা, জেতাটাই বড় কথা, হেরে গেলে শেম, শেম, শেম…
ব্যাকবেঞ্চার উপন্যাসটি অন্য সব উপন্যাস থেকে আলাদা এজন্য যে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে আপনি আপনার স্কুল, ভার্সিটির এবং কর্মময় ব্যস্ত জীবনের স্মৃত গুলো উপলব্ধি করতে পারবেন। মনে হবে যেন আপনি আপনার স্মৃতিগুলোই মনে করে চলেছেন কারণ বইটির বিষয়বস্তু এবং লেখকের উপস্থাপনা কৌশল এমনই। লেখক অসীম হিমেল সম্পর্কে বইটি পড়ার পর জেনেছি। চলুন লেখকের পরিচয় দেখে নেওয়া যাক।
অসীম হিমেল
অসীম হিমেল ১৯৮১ সালে ৫ নভেম্বর গাজীপুরের কালীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। এসএসসি, এইচএসসি, গ্রাজুয়েশন, পোস্টগ্রাজুয়েশন, বিসিএস শেষে এখন চাকুরী জীবনে। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। বর্তমানে আছেন জাতীয় অর্থোপেটিক (পঙ্গু) হাসপাতালে। কর্মব্যস্ততার পর যেটুকু সময় পান সেই সময়ের মধ্যেই চলে লেখালেখি। রাত, চাঁদ ও জোছনা তার ভালোলাগে। আর এ জন্যই তার সকল লেখায় রাত, চাঁদ ও জোছনা গুরুত্ব পায়। ভালোলাগে আড্ডা ও ঘুরে বেড়ানো। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে মধ্যরাতের অভিযান, জোছনায় নীল আকাশ, মেজোকুমার এক সন্ন্যাসী রাজা এবং খেদু মিয়া উল্লেখযোগ্য।
বইটির ফ্লাপে লেখা অংশ পড়ে আপনি ক্ষুদ্র ধারণা পাবেন কিন্তু পরিপূর্ণ ঘটনা বা কাহিনি যা কিছু কমল, রাশেদ বিশেষ করে শুভ্রর জীবনে ঘটে গেছে সেই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর স্বাদ পেতে বইটি পড়তে হবে।
ফ্লাপে লেখা কথা
ব্যাকবেঞ্চার, প্রথমবার এডমিশন টেস্টে কোথাও চান্স না পেয়ে বন্ধুদের থেকে এক বছর পিছিয়ে পড়া তিন বন্ধুর টানাপোড়ন এবং জয়ী হওয়ার গল্প |
ব্যাকবেঞ্চার, জীবন থেকে ষোল বছর হারিয়ে যাওয়া এক অন্ধকার জীবনের গল্প |
সব পেয়েও এক অভিমানী বাবার জীবন ও পরিবার থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসার গল্প |
ব্যাকবেঞ্চার, পিতাকে খুঁজে পাওয়া এক মেয়ের গল্প |
ব্যাকবেঞ্চার কতগুলো স্বপ্ন পুরন হওয়ার গল্প |
ব্যাকবেঞ্চার, একটি ব্যান্ডের গল্প এবং একজন ব্যান্ড শিল্পীর প্রতি এক ভক্তের ভালোবাসার গল্প | একটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠার গল্প |
ব্যাকবেঞ্চার, একটি পাওয়া না পাওয়ার হিসাবেরও গল্প …
দূরবীনের একদিক দিয়ে দেখলে যেমন খুব কাছের দেখা যায় আবার আরেকদিক দিয়ে দেখলে খুব দূরে দেখা যায়
..ব্যাকবেঞ্চার, এরকমই এক উপন্যাস ..একই জিনিস একদিকে একরকম আরেকদিকে অন্যরকম|