বাংলাদেশের সামজিক, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের লেখা এ বইটি খুবই সময় উপযোগী একটি বই। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জে কর্মরত আছেন। বিভিন্ন দেশ বিদেশের তথ্য উপাত্ত ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্নীতি ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন এ বইটিতে।
মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আজকে বিশ্বব্যাপী যুবসমাজের করুণ পরিণতি। তারা মূল্যবোধ হারিয়ে লিপ্ত হচ্ছে নানা অসামাজিক, গর্হিত ও নীতিবিরোধেী কার্যকলাপে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সামাজিক সমস্যার। অন্যায়-অনাচার সন্ত্রাস আর ব্যভিচারে বিপর্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী। অশান্তির দাবানল জ্বলছে প্রতিটি সমাজে-রাষ্ট্রে। মানবজীবনের রয়েছে বিভিন্ন দৈহিক ও আধ্যাত্মিক দিক; আর তাদের সাথে যুক্তও রয়েছে বহুবিধ কাজকর্ম। এসব কাজকর্মের মাঝে রয়েছে মর্যাদাভেদ।
লেখক বইটির সূচিপত্র সাজিয়েছেন এভাবে- মূল্যবোধের অবক্ষয়ে যুবসমাজ: আমাদের করণীয়, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও যুবসমাজ, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নারী নির্যাতন, সামাজিক বিপর্যয় হিসেবে সমাজে নারী নির্যাতনের প্রভাব, দুর্নীতি ও নৈতিক মূল্যবোধ, দুর্নীতি জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায়, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার: মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ, ইসলামে নৈতিকতার সামাজিক গুরুত্ব, ইসলামি নৈতিক মূল্যবোধের চর্চাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের সহায়ক, ইসলামি নৈতিক মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমেই আখলাকে হাসানা বা সুন্দর চরিত্র বিকশিত হয়, মুনাফাখোরী, মজুতদারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়: ইসলামি দৃষ্টিকোণ।

সব প্রত্যয় ও মূল্যের শীর্ষে রয়েছে কল্যাণ ও শুভর ধারণা। শুভর প্রত্যয়ই জগতের উৎস ও ভিত্তি। সূর্য যেমন আলোর উৎস, শুভর ধারণাও তেমনি সত্য-সুন্দর প্রভৃতি সব মূল্যের উৎস। প্লেটোর দৃষ্টিতে কল্যাণের ধারণা ঈশ্বরের ধারণার সমপর্যায়ভুক্ত। অ্যারিস্টলের মতে, ‘কোনো বস্তুর সঙ্গে তার পরিণতি বা মূল্যের সম্বন্ধ সেই বস্তুর স্বরূপের অপরিহার্য অংশ।’ মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বাংলাদেশের যুবসমাজ করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। অশিক্ষা-অদক্ষতা, কর্মসংস্থানের অভাব, আইন-শৃঙ্খলা কাঠামো, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও পেশিশক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্তার, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য রহিত, ধন ও সম্মান সমার্থক হওয়ার পরিবেশ, সাংস্কৃতিক দৈন্যদশা―এসবের মাঝেই বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের যুবসমাজ।
বর্তমানে চলচ্চিত্র, স্যাটেলাইট ও মোবাইলের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি মারাত্মক ব্যাধির মতো দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে সমাজে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে যৌন হয়রানি, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, খুন। আরেকটি সামাজিক বিপর্যয়ের নাম মাদকাসক্তি। মাদকের প্রসার ও ভয়াবহতা নিয়ে ‘দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ‘মাদক নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে’। প্রতিবেদকের ভাষ্য―ফোন করলেই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মাদক। আর মাদকের সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। অবৈধ অস্ত্র, অর্থ আর রাজনৈতিক প্রভাবে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে এই মাদক মাফিয়ারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখন তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
আমরা একদিকে যেমন বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে আমাদের জীবনধারণের বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হয়েছি, আনন্দও প্রাঞ্জল্যময়ী করতে পেরেছি আমাদের চলার পথকে; সর্বোপরি বিশ্বকে গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে দেখতে সক্ষম হয়েছি, তেমনি অন্যদিকে গোটা বিশ্বকে একটি বিষয় গ্রাস করে ফেলেছে। আর তা হলো অপরাধ। এটা মূলত নৈতিকতাহীন জীবনেরই কুফল মাত্র। নৈতিকতাহীন জীবন প্রকৃতপক্ষেই সমাজে নানা জটিলতার সৃষ্টি করে।
দুর্নীতি এবং দারিদ্র্য আমাদের জাতীয় জীবনের দুটি সমবর্তী সমস্যা। দারিদ্র্য অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে সহায়তা করছে আবার দুর্নীতির ফলে আমরা দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। দুর্নীতি পদে পদে দারিদ্র্য বিমোচনের সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি যেটুকু হচ্ছে তাও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, এনজিও কর্মকর্তা ও ধনকুবেরদের যোগসাজশে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে থেকে যায়। অথচ দুর্নীতির ফলে যে অর্থ অপচয় হয় তা যদি দারিদ্র্য বিমোচনে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যেত তাহলে কয়েক বছরেই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হতো।
মানবেতিহাসের সূচনালগ্নে মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানবুদ্ধির পরিসর যখন ছিল খুবই সীমিত, তখন তাদের কর্ম ও আচরণের মূল্য বিচারে কোনো প্রামাণিক মানদ- ছিল না। এমতাবস্থায় দৈনন্দিন জীবনের জরুরি প্রয়োজনে এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা সুরক্ষার স্বার্থে তাদের নির্ভর করতে হতো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিছুর রীতি-নীতি ও প্রথা-প্রচলনের ওপর। ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের বিতর্ক নিরসন এবং নৈতিক সমস্যাবলির সমাধানের লক্ষ্যে তাদের পূর্বপুরুষরা যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন এবং যেগুলো ছিল পুরুষানুক্রমে গৃহীত, সেগুলোকেই তারা গ্রহণ করত সমাজজীবনের ঐক্যশক্তি এবং নৈতিক সদাচরণের আদর্শ মানদন্ড হিসেবে।
বইটিতে ইসলামের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক বলেন- ইসলাম পুরোপুরি একটি নৈতিক আদর্শ। গবেষক-সমালোচক, ইতিহাসবিদ-চিন্তানায়ক আর বুদ্ধিজীবীরা তাই ইসলামকে অভিহিত করেছেন ‘একটি পরিপূর্ণ নৈতিক বিপ্লব’ নামে। ইসলামি নৈতিকতার প্রথম, প্রধান এবং বলা যায় একমাত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে মানুষের চরিত্রের স্বাভাবিক, চিরন্তন এবং সর্বজনীনভাবে কাম্য গুণগুলোই গৃহীত হয়েছে। সাধারণভাবে চরিত্রের যে বিশেষ দিক ও গুণগুলোকে অনাদিকাল থেকে মানুষ গ্রহণীয় মনে করে এসেছে তারই প্রথাসিদ্ধ, সুশৃঙ্খল শোভন উপস্থাপন হলো ইসলামি নৈতিকতা।
মানুষের প্রকৃতিতে চরিত্রের অনুভূতি একটি স্বাভাবিক অনুভূতি। এটা এক প্রকারের গুণ ও কাজকে পছন্দ করে এবং অন্য এক প্রকারের গুণ ও কাজকে অপছন্দ করে। পছন্দ-অপছন্দের এই অনুভূতি ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো কম বা বেশি হতে পারে কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানবতার তীব্র চেতনায় এই অনুভূতি তীব্র এবং চিরন্তন। চরিত্রের কোনো কোনো গুণকে ভালো এবং কোনো কোনো গুণকে মন্দ বলার ক্ষেত্রে মানবতা চিরদিন এক অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে।
লেখক এ বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন- সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে হলে দেশপ্রেমিক হতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সহ সকল নবী-রাসূল দেশপ্রেমিক ছিলেন। সাহাবা (রা.) এবং তাদের পরের সকল মনীষীর মধ্যে দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশ ছিল।
খোলাফায়ে রাশেদার সোনালি যুগে বায়তুল মালের মালিক ছিল জনগণ। বায়তুল মাল থেকে খলিফাগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতেন না। তারা ছিলেন বায়তুল মালের পাহারাদার মাত্র। বায়তুল মালের সম্পদ দিয়ে সরকার জনগণের প্রয়োজন মেটাবে, এই দায়িত্ব পালন করা শাসকগোষ্ঠীর জন্য ফরজ। এ দায়িত্ব পালন না করলে আল্লাহর কাছে কিয়ামতের মাঠে জবাব দিতে হবে। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, “ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মরে তাহলে কিয়ামতে এর জন্য আমি ওমরকে জবাবদিহি করতে হবে।”
পবিত্র কোরআনের আলোকে ইসলামি রাষ্ট্র আর্তমানবতার তথা জনগণের গার্জিয়ান। শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ, নিম্ন বেতন ও কাজের অধিক সীমা নির্ধারণ এবং কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়ার পর পেনশন নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামি সরকারকে গার্জিয়ানের ভূমিকা পালন করতে হবে। বেকারদের বেকার ভাতা, বিধবা, এতিম, অসহায়, রোগী ও সর্বহারা মানুষের অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের দায়-দায়িত্ব অবশ্যই ইসলামি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। অন্ধ, পঙ্গু, আঁতুড় ইত্যাদি আর্তমানবতার জীবনধারণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ইসলামি রাষ্ট্রের গ্রহণ করতে হবে। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ শাসকগোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত না করে জনগণের মাঝে বণ্টন করতে হবে।
লেখক এ বইয়ের সার কথা বলতে গিয়ে বলেন-‘ইসলামি নৈতিকতা চর্চার মাধ্যমে আমরা সচেতন হয়ে মুনাফাখোরী, মজুতদারি, ভেজাল প্রতিরোধ করতে পারি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে না ধরলে আমরা জাতীয় ক্ষতির পাশাপাশি নিজেরাও অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। যা আমাদের ইহকাল-পরকালকে ধ্বংস করে দেবে।’ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন এ বইটিতে তার মতামত ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে নানা উদাহরণ ও যুক্তি দিয়েছেন। ফলে এ বইয়ের পাঠক একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবে এবং একই সাথে এ বিষয় নিয়ে চিন্তা ও সচেতনতার জায়গা তৈরি করবে।
মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের অন্যান্য বই দেখুন
সাহিত্যদেশ প্রকাশনীর বইগুলো দেখুন