ভিন্নধর্মী, প্রগতিশীল মননের লেখা দিয়ে ইতোমধ্যেই নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন সাহিত্যিক আল-ইমরান। বইমেলা ২০২২ এ তাঁর প্রকাশিতব্য দুটি বই ‘ঝরাপাতা লহরি তুলিল’ ও ‘বৃষ্টিবেরে আঁখির পিয়ালা’।
‘ঝরাপাতা লহরি তুলিল‘ বইটি একটি পত্রোপন্যাস। এখানে ব্যাথাতুরা রমণী তোজা ইয়াম্মির ১১টি চিঠি স্থান পেয়েছে। নিজের মনের দুঃখ-ব্যথা, আবেগ অনুভূতি দিয়ে প্রেমিকসম পতি নাভেদকে লেখা চিঠি। প্রেমিকসম বলার কারণ, সচরাচর স্বামী বলতে একজন প্রভুপ্রতীম পুরুষকে বোঝায়, যে নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, সেইসাথে সময়ে-অসময়ে নারীর ওপর নিজের অধিকার ফলানোকে কর্তব্য মনে করে। কিন্তু নাভেদ এমন পুরুষ হওয়া থেকে রীতিমত আশ্রয় প্রার্থনা করেছে স্রষ্টার কাছে। গতানুগতিক পুরুষ থেকে সে আলাদা। তাই তো পত্নী হিসেবে কোন কাষ্ঠবৎ পুতুল রমণীকে পছন্দ করেনি। পরিবারের সবার অমতে সে বিয়ে করে ফুটবল খেলোয়াড় তোজা ইয়াম্মিকে।
কাহিনীর পটভূমি কুটুমখালী। উপন্যাসের নায়ক নাভেদের জন্মস্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা নাভেদ একবার সিনেমার নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছে। পরবর্তীতে সে সিনেমা/নাটকের সেট নির্মাণের পেশায় যুক্ত হয়। আর ওদিকে তার স্ত্রী তোজা ইয়াম্মি একসময় ফুটবল খেলোয়াড় ছিল। ভার্সিটিতে একবার বান্ধবীদের সাথে গান গাওয়ার সময় দেখা হয় নাভেদের সাথে। সেই ছিল পরিচয়, এরপর প্রণয় থেকে পরিণয়। উপন্যাসে আমরা ইয়াম্মি-নাভেদের দাম্পত্য সময়ের ঘটনাবহ প্রত্যক্ষ করি।
আগেই বলা হয়েছে উপন্যাসটি মূলত পত্রোপন্যাস। নাভেদকে লেখা তোজা ইয়াম্মির চিঠি। কিন্তু সেই চিঠি শুরু থেকেই শুরু হয়ে যায়নি। ইয়াম্মি ও নাভেদের মাঝে মান-অভিমানের পালা চলছিল। যার কাহিনী সূত্র হিসেবে দেখি গাঁয়ের বৃদ্ধ মুল্লুক চানের অপতৎপরতা এবং যৌবনাবেগের দরুন ইয়াম্মির অনিচ্ছাকৃত চারিত্রিক স্খলন। নাভেদ পেশাগত কারণে প্রায় সময়ই বাড়ির বাইরে থাকে। ইয়াম্মি আধুনিক নারী কিন্তু সে নিষ্ঠার সাথে স্বামীর বাড়িতে শাশুড়ি-দেবর-ননদ সবার সাথে গ্রামে বসবাস করে। যৌবনের স্বাভাবিক আবেগে ইয়াম্মি আবেগ তাড়িত। সেই সুযোগ নেয় মুল্লুক চান। সে তার ঊনিশ বছর বয়সী পুত্র সাদ্দামকে প্ররোচিত করে ইয়াম্মির সাথে শারিরীক সম্পর্ক গড়ে তুলতে, যেন এর জের ধরে সে ইয়াম্মিকে কলঙ্কিনী এবং পরবর্তীতে পুত্রবধূ করে নিতে পারে। মুল্লুক-এর এহেন অভিলিপ্সার কারণ মূলত ছিল প্রতিহিংসামূলক। তার পুর্বপুরুষ ছিল ভিক্ষুক যারা নাভেদের পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করত। পরবর্তীতে অসদুপায় অবলম্বন করে মুল্লুক পয়সাওয়ালা হয়ে পড়লেও সমাজে বিশেষ সমাদর পায় না। তাই সে নাভেদের পরিবারের মুখে কলঙ্ক লেপন করতে এমন দুরভিসন্ধি করে।

একাকী জীবনে নানা সময়ে ইয়াম্মি সাদ্দামকে ডাকত, এটা-সেটা আনত, পাঠাত। সাদ্দাম তার বাবার কথায় সবসময় চেষ্টা করে ইয়াম্মির কাছাকাছি থাকতে। আগুনে ঘি পড়লে যেমন দাউ দাউ করে ওঠে, তেমনি ছাব্বিশ বছরের ইয়াম্মির যৌবনে সাদ্দামের আনাগোনাতে অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটি ঘটে যায়। তাও পরপর দুদিন। সে ঘটনার রেকর্ড থাকে মুল্লুক চানের কাছে। সে যথারীতি এ ঘটনা গ্রামে চাউর করে দেয়। এ ঘটনার পর ইয়াম্মির জীবন অনেকটাই গৃহে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। শাশুড়ি-ননদসহ গ্রামের মহিলারা কথা শোনায় তার চরিত্র, পেশা নিয়ে। এ সমাজ যে একজন খেলোয়াড় মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন লেখক। অথচ পুরুষ খেলোয়াড়ের কত সুনাম! এ ঘটনায় অনেকে ইয়াম্মির বিপক্ষে গেলেও সে সার্বক্ষনিক পাশে পেয়েছে নাভেদের চাচাতো ভাই মালেককে। সে ইয়াম্মিকে আপন বোনের মত দেখে। সে সর্বাত্মক চেষ্টা করে ইয়াম্মি-সাদ্দামের গোপন ফোনালাপ ও ভিডিও ফাঁস প্রতিরোধ করে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত মুল্লুককে ভাড়া করা লোক দিয়ে আটকে রাখে। ওদিকে নিজের পাপের অনুশোচনায় দগ্ধ ইয়াম্মি নিজের পাপ স্বীকার ও তার মনে ঘটে চলা নিজের সাথে যুদ্ধ সব কিছু নিয়ে লিখতে বসে প্রাণের মানুষ নাভেদের কাছে। শুরু হয় উপন্যাসের মূল ধারাবাহিকতা।
তোজার চিঠিতে আমরা পাই ফইজ্যা-রমিজার কথা। ফইজ্যা বাসর রাতে রমিজার উপর বাঘের মত ঝাপিয়ে পড়ে। আর এহেন আচরনকে নাভেদের মায়ের মত অসংখ্যজনই ‘আদর্শ স্বামী’ মনে করে। অপরদিকে নাভেদ বিয়ের পরে কাঙ্ক্ষিত মিলনের প্রস্তুতি নিতে সময় নেয়। তার স্ত্রীকে নিজের মনের সাথে বোঝাপড়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। এ নিয়ে তার মায়ের আক্ষেপের শেষ থাকে না। এ থেকেই আমাদের সমাজের পুরুষবাদী আচরণ প্রকট রূপে ধরা পড়ে উপন্যাসে। চিঠির পরতে পরতে তোজা নিজের নারী জীবনের নানা প্রশ্ন, নারী হবার কারণে ভোগ করা তিক্ত অভিজ্ঞতা সব নাভেদের কাছে তুলে ধরে। তোজা যেন হয়ে ওঠে প্রগতিশীল নারী সমাজের প্রতিভূ। নাভেদ সুশিক্ষাসম্পন্ন সত্যিকারের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। কিন্তু নাভেদ কি পারে তোজাকে ক্ষমা করে দিতে? সে কি পারে সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের নিগড় থেকে নিজেকে আলাদা করে নিজের ভালোবাসার জয় ঘোষণা করতে? জানতে হলে বইটি পড়তে হবে।
এই উপন্যাসে লেখক গতানুগতিক মানসিকতা এবং প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী দুই শ্রেণীর চরিত্র পাশাপাশি এঁকেছেন। তবে শুধু প্রেমের উপাখ্যানের নিগড়ে বন্দী করা যাবে না উপন্যাসটিকে। উপন্যাসের মাধ্যমে নারীর নিজস্ব যে চাওয়া-পাওয়া, আমাদের সমাজে মননশীল নারীদের প্রতি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি; সেইসাথে পুরুষ চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে ঔপন্যাসিক যে ছবিটি তুলে ধরেছেন তা মনস্তত্বের সংজ্ঞাসহ উদাহরণের তাত্ত্বিক পাঠের চেয়ে কোনো অংশে কম পরিস্ফুটিত হয়নি। সেই অর্থে বলা যায়, ‘ঝরাপাতা লহরি তুলিল’ অনেকাংশে শেকল ভাঙ্গার গান। যে শেকলে বন্দী নারী-পুরুষ সহ পুরো সমাজই।
‘বৃষ্টিবেরে আঁখির পিয়ালা’ একটি কাব্যগ্রন্থ। কবিতা প্রেমিক মনে চিরন্তন ভাষা। কিন্তু সাহিত্যিক আল-ইমরান কবিতাকে শুধু প্রেম নিবেদনের মাধ্যম নয় বরং মত প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার রূপে চিত্রায়ণ করেছেন।
৪১টি নানা ধরনের কবিতা স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। ২০০৭ থেকে ২০২২ সালে লেখা কবির বিভিন্ন কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশ হতে যাচ্ছে এ বই। বইটিতে বিভিন্ন ধরনের কবিতার সমাবেশ ঘটেছে। থাকছে প্রকৃতিকে নিয়ে কবিতা, প্রেমের কবিতা যেমন আছে, আছে সমাজের কথা। সমাজের নানা অসংগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র তুলে ধরেছেন কবিতার ভাষায়। আরো আছে বিভিন্ন বিখ্যাৎ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে লেখা কবিতা। এদের মধ্যে আছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, উত্তম গুহ প্রমুখজন। এছাড়া “ ‘নাট্যজন’ আজ জন্মদিন তোমার” শিরোনামের কবিতায় কবি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা, আবেগ নিয়ে কাব্য লিখেছেন নাট্যজন ও এর সাথে জড়িত নাট্যব্যক্তিত্বদের নিয়ে। এ থেকে কবি আল ইমরানের নাটকের প্রতি নিখাদ ভালবাসার পরিচয় প্রকাশ পায়।
আধুনিক গদ্যছন্দে রচিত কবিতাগুলো নির্মেদ ভাষায় রচিত। অল্প কথায় কীভাবে মনের ভাষা প্রকাশ করতে হয় তা কবি জানেন। তাই তো ভাষার বাহুল্য বর্জন করে বেছে নিয়েছেন সঠিক শব্দটি।

ভালবাসা আর অস্ত্রের সম্মুখে কবির দ্বিধাভরা উক্তি–
“ফুল নেবো না অস্ত্র নেবো
ভেবে হই আকুল”
কাব্যগ্রন্থের একমাত্র অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা ‘বৃষ্টিবেরে আঁখির পিয়ালা’ তে কবি ছন্দে ছন্দে বাতাস-বৃষ্টির যুগলবন্দীকে পরিণয় রূপকে তুলে ধরেছেন-
“আঁখি পিয়ালা! আঁখি পিয়ালা!
বাতাস–বৃষ্টির বিয়েবাড়ি; অখিলসুন্দর আলা–
আঁখি পিয়ালা”
কবি আল ইমরানের প্রকৃতিপ্রেমেও ধরা পরেছে বৃষ্টি, বাতাসের বিভিন্ন মনোহরী রূপ। ‘বৃষ্টিশিলা বৃষ্টিশিলা’, ‘বাতাস তোমায় আঁকতে পারি না’ প্রভৃতি কবিতায় তারই চিত্র দেখতে পাই আমরা।
‘বৃষ্টিশিলা বৃষ্টিশিলা’ কবিতায় লিখেছেন-
“কী দারুণ মখমলি শয্যা তোমার!
হাজার রঙ এর সাদার শীতল কোলে
দাবদাহে দগ্ধ আমার হৃদয় ঘুমজড়ানো হয়
তবু এই ভেবে দুঃখ হয় কত তড়িঘড়ি তোমার বিদায়”
‘বাতাস তোমায় আঁকতে পারি না’ কবিতায় বাতাসকে প্রশ্ন করেছেন কবি-
“এ কেমন ব্যস্ততা তোমার?
কেন?
তুমি কি যাযাবর
ফেরারী কিংবা গন্ধবণিক কোনো?
পাটিগণিত কষে কষে আমি বের করতে পারি না তোমার ব্যস্ততা!”
যেন বাতাস কবির কত দিনের সুহৃদ!
খাদ্যে ভেজাল বর্তমানে সময়ে আমাদের দেশের ভয়াবহ সমস্যা। একজন কবি হিসেবে আল ইমরান চুপ থাকতে পারেননি। কলম তুলে ধরেছেন এর বিপক্ষে। তাই তো তাঁর প্রতিবাদ বের হয় ‘অটিস্টিক তরঙ্গগুলি’ হয়ে যেখানে আমরা দেখি কবি বলেন-
“এমন খাদকবীর কে আর বিশ্বে আছে বাঙালি ছাড়া?
চায়নার খাবার কর্তারা সব খাবার ল্যাবরেটরিতে
আবিষ্কার করে করে তৈরি করছেন। কেন করবেন না?
বাঙ্গালির মত এমন সর্বভুক জাতি থাকার সুযোগটা
লাগবে কী কাজে তা না হলে?”
এলাকার মাস্তান থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বত্র চাঁদাবাজদের দৌরাত্য নিয়ে লিখেছেন ‘মনে কিছু নিয়ো না’ কবিতা। কী দ্ব্যর্থহীন ভাষা তাঁর!
“তর বাজানেরা আসতাছি,
রেডি রাখিস পাঁচ লাখ টাকা, দুই–চার কথার যেই
চিডিটা (চিরকুট) দিলাম, সেই মোতাবেক।”
ইভটিজিং, পরিবেশ বিপর্যয়, সমাজের অবক্ষয় প্রতিটি বিষয় নিয়ে কলম চালিয়েছেন কবি আল ইমরান। রূপক, অলংকার সব কিছু মিলিয়ে কবিতাগুলো ভাষাগত পরীক্ষায়ও সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে পাঠক সুস্বাগতম। আশা করি আপনার সময় ভালই কাটবে ‘বৃষ্টিবেরে আঁখির পিয়ালা’ হাতে নিয়ে।
আরও পড়ুন- রিয়াজ মাহমুদ’র অনুবাদে মুন্সী প্রেমচাঁদের অনবদ্য উপন্যাস ‘নির্মলা’
আল-ইমরান এর অন্যান্য বই দেখতে ক্লিক করুন