এক দেখায় প্রেমে পড়ার ঘটনা কি শুধু সিনেমায় দেখেছেন?
নাকি আপনিও এই পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছেন? একবার কোনো একজনকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে সবাই পায়নি, তা হলফ করেই বলা যায়। তবে কিছু মানুষের জীবন হয় সিনেমার চাইতেও নাটকীয়। যেভাবে কিছু কবির জীবন হয় সত্যিকারের কাব্যময়। যেমনটা ঘটেছিলো কাজী নজরুল ইসলামের বেলায়।
সত্যিকার অর্থে কবি নজরুলের জীবন ছিলো তার কবিতার মতই কাব্যময়। বিদ্রোহী কবি হিসেবে আমরা তাকে একটি ধাঁচে ফেলার চেষ্টা করলেও, দ্রোহ, যুদ্ধ কিংবা ক্ষোভের বাইরেও তিনি ছিলিন প্রেমময় একজন চরিত্র। তিনি নিজেই কিনা বলে গেছেন- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি’। নজরুলের জীবনে অনেক নারী এসেছেন। প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়েও ফিরে এসেছেন অনেকবার। তার মধ্যেও একজন ছিলেন রহস্যময়ী নারী। তার গল্পটা শোনার আগে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখা ‘নার্গিস’ বইটা থেকে জেনে আসি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের রহস্যময়ী নারীর প্রণয়ের কথন।
কবির প্রথম প্রেম
কোলকাতা থেকে কুমিল্লায় বেড়াতে এসেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর উপস্থিতিতে শান্ত মফস্বলের আবহাওয়া উত্তাল হয়ে উঠলো। তার ঢেউ এসে লাগলো মুন্সিবাড়ির মেয়ে নার্গিসের মনেও। বিয়ে হলো নজরুল-নার্গিসের। কিন্তু রাত ভোর হওয়ার আগেই কবি চলে গেলেন নার্গিসকে ফেলে। শুধু বলে গেলেন, শ্রাবণে এসে নিয়ে যাবেন তাঁকে। এরপর কেবলই অপেক্ষা। কী নিয়ে আসবে এই বেদনাভরা অপেক্ষা? নজরুলের জীবনে কি নার্গিসের ছায়া আদৌ পড়বে কোথাও?
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখা নার্গিস বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন নজরুলের জীবনের প্রথম প্রেম। নজরুলের প্রথম প্রেম নার্গিস। সেই প্রেম মিলনের পূর্ণতা পায়নি। বিয়ের রাত ফুরোবার আগেই দয়িতাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন কবি। কেন? পাঠককে সেই রহস্যের সামনে দাঁড় করাবে এই উপন্যাস। গবেষকের নিষ্ঠা ও ঐতিহাসিকের সততা নিয়ে লেখক এই উপন্যাসে একটি মানবিক সম্পর্ককে উন্মোচন করেছেন। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন নার্গিস নামের একটি গ্রাম্য মেয়ের রূপান্তরের কাহিনি, ভালোবাসা যাকে আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা করে তুলেছিল।
নার্গিস আসার খানম
নার্গিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মিলনের পূর্ণতা পায়নি। বিয়ের রাত না ফুরাতেই বিদায় নিয়েছিলেন নজরুল। বলে গিয়েছিলেন শ্রাবণ মাসে ফিরবেন। কিন্তু কত কত ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না।’ নজরুল তখন প্রেমে পড়েছেন দোলনচাঁপার। কুমিল্লার দৌলতপুর থেকে কান্দিরপারের দূরত্ব আর কতটুকু। কিন্তু নার্গিস চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তাঁর বঁধুয়া আনবাড়ি গেলেন তাঁরই ‘আঙিনা দিয়া’। সৈয়দা আসার খানমের নাম পাল্টে তাঁকে নার্গিস নামে ডেকেছিলেন নজরুল, আবার দুলি বা দোলনচাঁপাকে প্রমীলা নামটিও দিয়েছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে ছেড়ে এসেছিলেন নার্গিসকে, ১৯২৪ সালে বিয়ে করলেন প্রমীলাকে। অবশ্য বিয়ে করলেন কথাটি যত সহজে উচ্চারিত হলো, তত সহজে সবকিছু সমাধা হয়ে যায়নি। ভিন্ন দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যত রকম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়, সব পেরিয়েই নজরুলের সংসারে এসেছিলেন প্রমীলা। ওদিকে নজরুল যে আর কখনো তাঁর কাছে ফিরবেন না, এই সোজাসাপ্টা হিসাবটা বুঝে নিতে নার্গিসের সময় লেগেছিলো ১৭ বছর।
কে ছিলেন রহস্যময়ী?
তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডির একটি হলো- ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে প্রণয়। যেটি ছিলো একপেশে। কবির মর্মস্পর্শী আবেদনে সাড়া দেননি কখনই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ। এ হিসেবে তিনি দেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষও (১৯৪৮-১৯৫৭)। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী, যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যান। ফজিলাতুন্নেসা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে,
“ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না, অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাকপটু মেয়ে।”
পরিচয় পর্ব
১৯২৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নজরুলের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলাতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ফজিলাতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে ফজিলাতুন্নেসা জানতে পারেন, নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং ফজিলাতুন্নেসারও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়। এভাবে ফজিলাতুন্নেসা ও তার বোন সফীকুননেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলাতুন্নেসার ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল ফজিলাতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষ্যে ‘বর্ষা-বিদায়’ নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলাতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)। কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়”।
বর্ষা-বিদায় কবিতায় ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবি নজরুল লেখেন এভাবে-
ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!
ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া-রেণু
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু।
কুমারী ভীরু-বেদনা-বিধূর প্রণয়-অশ্র“ সম।
ঝরিছে শিশির-সিক্ত সেফালী নিশি-ভোরে অনুপম।
ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
কবি ও রহস্যময়ী
লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘নার্গিস’ উপন্যাস নিয়ে সাড়া ফেলানোর পর এবার তিনি হাজির হলেন ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির ব্যর্থ প্রেম কাহিনী নিয়ে। কবি নজরুলের জীবনে অনেক নারী, অনেক প্রেম। প্রথম প্রেম কুমিল্লার নার্গিস। নার্গিস উপন্যাসে সে কাহিনি লিখে সাড়া জাগিয়েছেন কবি-কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী। এবার তিনি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে কবির প্রেম-আখ্যান কবি ও রহস্যময়ী। নজরুলের প্রেম নানা কাহিনির জন্ম দিয়েছে, সেসব কাহিনিকে ভেতর থেকে প্রকৃত ঘটনাবলির উপস্থাপনা আর তাকে উপন্যাসের আঙ্গিকে তুলে ধরা একটা দুরূহ কাজ। বিশ্বজিৎ চৌধুরী সে কাজটিই করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
স্বাভাবিক ভাবেই ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখা বেশ কঠিন। তাও বেশ কিছু সহায়ক গ্রন্থ ও সেসময়কে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এমন মানুষের বক্তব্যকে উপজীব্য করে লেখক বোঝার চেষ্টা করেছেন কাজী নজরুলের প্রেমের আবেদন। ফজিলাতুন্নেসার চিঠিগুলো পাওয়া যায় না। তবে কাজী মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণায় এটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এরপর কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেসার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে একা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন নজরুল। এই বিদূষী নারীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কিন্তু এতকাল যে তরুণীদের সঙ্গে সান্নিধ্যের সুযোগ তাঁর হয়েছিল, ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। অন্য ধাতুতে গড়া এই নারী তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁকে। প্রত্যাখ্যানের ভাষা ও আচরণ ছিল রীতিমতো কঠোর। এই আঘাত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল কবিকে।
লেখক তার আরেকটি লেখায় লেখেন- কলকাতা ফিরে গিয়ে সম্ভবত অনুতাপ প্রকাশ করে এবং তাঁকে ভুল না বোঝার আকুতি জানিয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে চিঠি লিখেছিলেন কবি। এতে কবির প্রতি সমস্ত অভিযোগ ভুলেছিলেন ফজিলাতুন্নেসা—এমন তো নয়ই, উল্টো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছিলেন তাঁকে। সেই চিঠিতে তিনি কী লিখেছিলেন, তা হুবহু জানার উপায় নেই; কারণ সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মোতাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, সেই চিঠির ভাষা তাঁর জীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল,
‘আঘাত আর অপমান এ দুটোর প্রভেদ বুঝবার মতো মস্তিষ্ক আমার আছে। আঘাত করবার একটা সীমা আছে, যেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে ওঠে, আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী উপন্যাসের আঙ্গিকে নজরুলের প্রথম প্রেমের না-ফোটা মুকুল নার্গিস-কাহিনি লিখে পাঠকমনে সাড়া তুলেছিলেন। এবারে উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী-বিস্ময়, প্রথম বাঙালী মুসলিম গ্র্যাজুয়েট গণিতবিদ ফজিলাতুন্নেসার সাথে কবির প্রণয়কাহিনী। এখানেও লেখককে অনেক কল্পকথার ডালপালা ছাঁটতে হয়েছে, আবার রহস্যের মোড়কে ঢাকা না-বলা কথার ছিন্ন সুতো জুড়তে হয়েছে। বিস্তর পঠন আর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে তাঁকে রীতিমতো খেটে উপন্যাসের রসদ জোগাড় করতে হয়েছে। তবে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কলমে আবেগ-কল্পনা-মনন একযোগে কাজ করে। বিদ্রোহী কবির আরেকটি প্রেমের কুঁড়ি তিনি ইতিহাস ও বাস্তবের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই ফুটিয়ে তুলেছেন এবারে।
বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন
কবি নজরুলকে নিয়ে লেখা অন্যান্য বই