ড্যান লক ৩৮ বছর বয়সী একজন চীনা ব্যবসায়ী ও ধনকুবের। ব্যবসায় সাফল্যের বাইরেও সফলভাবে তিনি নিজের একটি পরিচয় তৈরি করেছেন। সেটি হলো ‘শিক্ষাবিদ লক’। ক্লোজার ডটকম, কপিরাইটার্স ডটকম এবং সেলসকলস ডটকম-এর মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান তিনি। পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তিনি, যার মাধ্যমে বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে উচ্চ আয় সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
বিশ্বব্যাপী সিইওদের নিয়ে গঠিত ‘ইয়াং প্রেসিডেন্টস অর্গানাইজেশন’-এর একজন সদস্য ড্যান লক ১২টি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার বইও লিখেছেন। এছাড়াও, বিশ্বের সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ী ও ধনকুবেরদের নিয়ে ‘দ্য ড্যান লক শো’ নামে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা নিয়মিত করেন তিনি। ব্যবসায়িক সফলতা কিংবা দ্রুত ধনী হওয়া, সাফল্যের সূত্র কিংবা ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার উপায়- এসব বিষয়ে নিয়মিতই অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য রাখেন তিনি। ধনী হতে হলে জীবনে বই পড়বার বিকল্প নেই বলেই মনে করেন লক। আর তাই মিলিয়নেয়ার হবার স্বপ্ন দেখাদের স্বপ্রণোদিত হবার জন্য ৯টি বিশেষ বই পড়ার উপদেশ দেন তিনি।

বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। মিলিয়নেয়ার হবার স্বপ্ন দেখলে কোনো নির্দিষ্ট বই-ই পড়তে হবে এমন কথা নেই। কথায় আছে, “জ্ঞানই শক্তি”। তবে লক মনে করেন যে, কথাটা অসম্পূর্ণ। তার মতে, ব্যবহারিক জ্ঞানই হলো শক্তি। কর্মব্যস্ত সময় ছাড়া সাধারণত তিনি সপ্তাহে ৩/৪টি বই পড়ে থাকেন। কারণ তার বিশ্বাস, যারা নেতৃত্ব দেয় তারা জ্ঞানার্জন করে, আর জ্ঞানীরাই নেতৃত্ব দেয়। যারা মিলিয়নেয়ার হবার স্বপ্ন দেখেন কিংবা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখেন, এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের জন্য নয়টি অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকা করেছেন ড্যান লক।
আজকের লেখার মাধ্যমে চলুন জেনে নেয়া যাক সেই বইগুলো সম্পর্কেই।
৯. দ্য লাটে ফ্যাক্টর – ডেভিড বাখ অ্যান্ড জন ডেভিড ম্যান
‘দ্য লাটে ফ্যাক্টর’ বইটির সারাংশ হলো এরূপ, “আপনাকে ধনীর মতো জীবনযাপন করতে ধনী হতে হবে না।” বইটি মূলত মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হবার প্রণোদনা যোগায়। এই প্রণোদনা আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে যে, আপনি নিজেকে যতটা গরীব ভাবছেন, আপনি তার চেয়ে ধনী। বাখ এবং ম্যান কিছু সহজ সূত্র উল্লেখ করেছেন তাদের বইয়ে, যেগুলো আপনি আপনার প্রাত্যহিক জীবনের নানা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগাতে পারেন। তথাপি, এটিই একমাত্র বই নয় যা আপনি পড়ছেন, কিংবা এ বইয়ের সবকিছুর সাথে আপনার পূর্ণমাত্রায় একমত হতে হবে তা-ও না। বরং, বইটি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান নিজের জীবনে স্বীয় উপায়ে কাজে লাগাতে পারবেন।

৮. হাউ টু বি রিচ – জে পল গেটি
সফল হবার সবচেয়ে ভালো উপায়টি হলো সফলদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া। এক্ষেত্রে, যারা মিলিয়নেয়ার হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তাদের জন্য জে পল গেটির চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কে হতে পারে! বিলিয়নেয়ার এ ব্যবসায়ী তার বইয়ে কীভাবে সম্পদ উপার্জন করতে হবে তা নয়, বরং কীভাবে সম্পদশালী হতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত ধনকুবের কীভাবে জীবনকে দেখেন, কীভাবে অর্থের মূল্যায়ন করেন, ‘হাউ টু বি রিচ’ বইটি তা-ই দেখাবে পাঠককে।

বইটি পড়া মানে এই নয় যে আপনাকে পল গেটির সকল তত্ত্ব আর যুক্তির সাথে একমত হতে হবে। বরং, তার সকল ধারণার সাথে একমত না হয়েও বইটি থেকে একজন সফল ব্যক্তির চোখে জীবন ও অর্থ সম্পর্কিত, এমনকি পরিবার সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাওয়া সম্ভব হবে।
৭. দ্য লিটল বুক অব কমন সেন্স ইনভেস্টিং – জন সি বোগল
আধুনিককালে মানুষের মাঝে ‘কমন সেন্স’ বা কাণ্ডজ্ঞানের বড়ই অভাব। মানুষ এখন চমক আর চাকচিক্য অধিক পছন্দ করে, প্রতিষ্ঠিত হবার শর্টকাট খোঁজে। অথচ, প্রতিষ্ঠিত হবার প্রধান শর্ত মৌলিক জ্ঞানের কথাই মানুষ ভুলে যায়। মানুষ ভুলে যায় সার্বজনীন চর্চাই কাণ্ডজ্ঞান নয়। ফোরেক্স ট্রেডিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি, হালনাগাদ বিনিয়োগ ট্রেন্ড, এসব চমকপ্রদ বিষয়েই এখন মানুষের আগ্রহ বেশি। অথচ স্টক কিংবা রিয়েল স্টেট মার্কেট, যেকোনো ক্ষেত্রেই মৌলিক কৌশল সম্বন্ধীয় জ্ঞান থাকাটাই সাফল্যের জন্য অধিক জরুরি। আর এই জরুরি বিষয়টির উপরই জোর দেয় জন সি বোগলের ‘দ্য লিটল বুক অব কমন সেন্স ইনভেস্টিং’।

কীভাবে বিনিয়োগের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় করা যাবে, কীভাবে ‘কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট’-এর সর্বোচ্চ সুবিধাটা নিতে হবে কোনো প্রকার ঝুঁকি ছাড়াই ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা রয়েছে বইটিতে।
৬. দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যাবিলন – জর্জ. এস. ক্ল্যাসন
জর্জ. এস. ক্ল্যাসনের ছোট্ট বই ‘দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যবিলন’ অল্প সময়েই পড়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ছোট্ট এ বইয়ে যেসব মৌলিক নির্দেশনা দেয়া আছে, সেগুলা আয়ত্ব করা সাধনার ব্যাপার। অর্থ এবং বিনিয়োগের ব্যাপারে এ বইটি উচ্চতর জ্ঞানের প্রাথমিক বুনিয়াদস্বরূপ। দীর্ঘকাল আগে বইটি পড়লেও আজও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে এ বইয়ের সহায়ত নিয়ে থাকেন লক।

এ বইয়ে আলোচিত নীতি ও তত্ত্বকথাগুলো কোনো কৌশলপূর্ণ চমক নয়। বরং, সাদামাটা এই তত্ত্বকথাগুলো প্রমাণিত, শত শত বছর ধরে অপরিবর্তিত, এবং অনাগত সময়েও অপরিবর্তিতই থাকবে। উদাহরণস্বরূপ- আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় না করা, ভিন্ন ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা ইত্যাদি মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে এ বইটি, যা সকলের জন্যই অবশ্যপাঠ্য।
৫. পুওর চার্লি’স অলম্যানাক – চার্লি মাঙ্গার
বিশিষ্ট মিলিয়নেয়ার ওয়ারেন বাফেটের নাম শোনেননি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু, বাফেটের ব্যবসায়িক অংশীদার চার্লি মাঙ্গারের নাম ক’জন শুনেছেন? স্ব-প্রতিষ্ঠিত এই ধুনকুবেরের নাম তার ব্যবসায়িক সাফল্যের খাতিরে খুব বেশি মানুষ জানে না। তিনি বরং তার বই ‘পুওর চার্লি’স অলম্যানাক’ এর জন্যই অধিক পরিচিত।

বইটি এত চমৎকার যে একাধিকবার পড়লেও প্রতিবারই কিছু না কিছু নতুন শিখতে পারা যায়। কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, কীভাবে যুতসই পরিকল্পনা তৈরি করা যায়, কীভাবে অর্থনীতিকে বুঝতে হয়, কীভাবে বিনিয়োগ করতে হয় ইত্যাদি বিষয়ে পাঠককে চমৎকার ধারণা দেয় বইটি। এমনকি কীভাবে একটি ‘ট্রিলিয়ন ডলার’ মূল্যের প্রতিষ্ঠান চালাতে হবে, তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে এ বইয়ে। সব মিলিয়ে মিলিয়নেয়ার হতে চাওয়া মানুষদের জন্য বইটি নিঃসন্দেহে অবশ্যপাঠ্য।
৪. আনলক ইট – ড্যান লক
তালিকার চতুর্থ বই হিসেবে লক বেছে নিয়েছেন নিজের লেখা একটি বইকেই, নাম ‘আনলক ইট’। গত ২০ বছরে নিজের জীবন থেকে নেয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি এ বইয়ে। তার ভাষায়, বইটি হলো সম্পদ, সাফল্য আর তাৎপর্যপূর্ণতার ‘মাস্টার-কি’।

এখন প্রশ্ন হলো, বইটির নাম ‘আনলক ইট’ কেন হলো? লক নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বইটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রণোদনা দেবে। যেমন- কারো জন্য ‘আনলক ইট’-এর অর্থ হতে পারে নিজের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটানো, কারো জন্য হতে পারে ব্যবসায়ে মুনাফা বৃদ্ধি কিংবা ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি করা। প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেকের চাহিদাও ভিন্ন। তথাপি বইটি সকলকেই নিজস্ব স্বকীয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সহায়তা করবে। অ্যামাজনসহ যেকোনো বড় পরিসর বই বিপণীতেই পাওয়া যাবে লকের এ বইটি।
৩. দ্য সাক্সেস সিস্টেম দ্যাট নেভার ফেইলস – ডব্লিউ. ক্লেমেন্ট স্টোন
ক্লেমেন্ট স্টোনের এই অসাধারণ বইটি জনপ্রিয়তার বিচারে একটু পিছিয়ে। এ প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন হিলসের জনপ্রিয় বই ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ বইটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। নেপোলিয়ন হিলস ক্লেমেন্ট স্টোনের প্রতিষ্ঠিত ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সেলস ট্রেইনার হিসেবে কাজ করতেন, যার অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি এ বইটি লিখেছেন।

যা-ই হোক, লক জানান যে ক্লেমেন্ট স্টোনের ‘দ্য সাক্সেস সিস্টেম দ্যাট নেভার ফেইলস’ বইয়ের সাক্সেস সিস্টেমটি হলো পারিপার্শ্বিক পরিবেশ; এমন পরিবেশ যা আপনার বিরুদ্ধে যাবে না, বরং আপনাকে এগিয়ে দিতে সহায়তা করবে। এখানে কেবল বাহ্যিক পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে না। আপনার চারপাশের মানুষজন, যাদের সাথে আপনার ওঠা-বসা, তারাও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের অংশ। এই পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে হতে পারে সাফল্যের চাবিকাঠি, তা জানতে পড়ুন ‘সাক্সেস সিস্টেম দ্যাট নেভার ফেইলস’ বইটি।
২. প্রিন্সিপ্যালস – রে ডালিও
এ বইটির লেখক রে ডালিও একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত বিলিয়নেয়ার। তিনি এ বইয়ে কেবল অর্থ উপার্জন নিয়ে কথা বলেননি, বরং পাঠকের জন্য জীবনে চলার পথে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক নিয়মনীতি ও কাঠামো উল্লেখ করেছেন, সবকিছু আরো গভীরভাবে চিন্তা করে আত্মসচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই দ্রুত উন্নতির পথ খোঁজে। আর এ প্রক্রিয়ায় তারা হারিয়ে ফেলে জীবনের সকল নীতি, যা একটি বড় ভুল। লক মনে করেন, কর্মপন্থা পাল্টে যেতে পারে, কিন্তু জীবনের মৌলিক রীতিনীতি কদাচিৎ পাল্টায়। আর তাই রে ডালিওর ‘প্রিন্সিপ্যালস’ বইটি প্রত্যেকের পড়া উচিত নিজের জীবনের নীতি ও আদর্শ ঠিক করবার জন্য।
১. রিচ ড্যাড, পুওর ড্যাড – রোবার্ট কিয়োসাকি
ব্যক্তিক অর্থনীতি ও লেনদেন নিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় এ বইটি হয়তো ইতোমধ্যেই পড়ে থাকবেন আপনি। বইটিতে কিয়োসাকি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সম্পদ আর দায়বদ্ধতার পার্থক্য করেছেন। যা কিছু অর্থ সমাগম করে তা-ই সম্পদ। আর দায়বদ্ধতা ঠিক তার উল্টোটি। আরো সহজ করে বললে, আপনার সম্পদ আপনার অন্ন যোগায়, আর দায়বদ্ধতা আপনাকে গ্রাস করে।

দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় থাকে, মধ্যবিত্তরা অর্থ ব্যয় করে দায়বদ্ধতা কিনে নেয় সম্পদ মনে করে, আর ধনীরা হয় প্রকৃত সম্পদের মালিক। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থান নির্দেশ করার পাশাপাশি কিয়োসাকি বইটিতে কীভাবে সম্পদ অর্জন ও বৃদ্ধি করতে হবে এবং সেই সম্পদ কীভাবে স্থায়ী অর্থের যোগান দিতে পারবে, তা নিয়েও আলোচনা করেছে।
উপরে আলোচিত এ নয়টি বই প্রত্যেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির পড়া উচিত, যারা একদিন মিলিয়নেয়ার হবার স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য, এ বইগুলোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করলেও ড্যান লক তার অনুসারীদের আরো অসংখ্য বই পড়বার পরামর্শ দেন।