মাত্র ৪৯ বছরের জীবন, মাত্র ৪৯ বর্ষা। জন্ম দিয়েছেন নক্ষত্রসম সন্তানদের। সবচেয়ে উজ্জ্বল সন্তানের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই কথাটি অজানা নয়। তবে যিনি রবীন্দ্রনাথকে পেটে ধরেছিলেন তার সম্পর্কে জানাটা মানূষের অত্যন্ত কম। অনেকেরই প্রশ্ন আসে, কেমন ছিলো রবির মায়ের জীবন?
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত নন এমন সাহিত্যপ্রেমী, এপার-ওপার দুই বাংলাতেই খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আর শুধু এই উপমহাদেশেই নন, সমগ্র বিশ্বেই তিনি অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হিসেবে নন্দিত। আর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’ এর জন্য নোবেল পুরস্কার পাবার পর বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তিনি লাভ করেছিলেন এক চিরস্থায়ী আসন। কাজেই সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক আছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের সাথে পরিচিত নন, এমন মানুষের খোঁজ পাওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁর অসাধারণ সব সাহিত্যকর্মও। তিনি সমগ্র বিশ্বেই একজন কবি, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে অতি পরিচিত ও অতি বিখ্যাত হলেও তাঁর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সারাজীবন মানুষের জানাশোনার বাইরে থেকে যাওয়া, বিশেষ জায়গাসমূহে তেমন উদ্ধৃত না হওয়া এই মানুষটি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদাত্রী মা, সারদা দেবী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারদা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন না। কনিষ্ঠ ছিলেন ‘বুধেন্দ্র নাথ’। বুধেন্দ্র নাথ খুব ছোট বয়েসে মারা যাওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন সংসারের ছোট ছেলে। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতা না হলেও, সারদাসুন্দরী নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁর কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “মাতাঠাকুরাণী ত কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদায়িনী মা সারদা দেবী সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। তিনি রয়ে গিয়েছেন সাহিত্যপ্রেমী ও সাধারণ মানুষের অগোচরে। কিন্তু তাঁর জীবনও কম নাটকীয় ছিলো না। ১৪ সন্তানের জননী এই নারী মারা গিয়েছেন মোটামুটি কম বয়সেই, যার ফলে তাঁর সকল সন্তান, যার মধ্যে রবিঠাকুর অন্যতম, বঞ্চিত হয়েছেন তাঁর যথাযথ আদর ও ভালোবাসা থেকে। আর একটি চঞ্চল ও কর্মব্যস্ত জীবন হঠাৎই শেষ হয়ে যায়, যার ফলে তিনিও থেকে যান সকলের অগোচরে, আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করেন সকলের স্মৃতি থেকে। অন্য সকলের স্মৃতি থেকে হারানো সম্ভব হলেও তাঁর নিজের সন্তানদের স্মৃতিতে তিনি থেকে গিয়েছিলেন আজীবন। আর রবিঠাকুর জননীকে তাঁর তেমন কোনো সাহিত্যকর্মের উৎসর্গ পাতায় না রাখলেও বিভিন্ন সময়েই বলে গিয়েছেন মায়ের কথা। তবে তারপরও খুব বিশেষ কোনো তথ্য ও ঘটনা পাওয়া যায় না রবিঠাকুরের মা সারদা দেবী সম্পর্কে। কারণ তাঁকে নিয়ে কথাবার্তা যেমন কম হয়েছে, আবার তেমন কোনো বইও লেখা হয়নি সারদা দেবীকে নিয়ে। যার কারণে সবসময় নিভৃতেই থেকে গিয়েছেন তিনি। আর তাঁকে নিয়ে সেভাবে বই বা লিখিত উপাত্ত না থাকায়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে জানার সুযোগ পাচ্ছেন না আগ্রহী পাঠক, সাহিত্য বিশারদ ও গবেষকরা।
তবে অবশেষে শেষ হয়েছে এই নিয়ে অপেক্ষার পালা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত লেখা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ বই, যেখান থেকে জানা যাবে তাঁকে নিয়ে নানা জানা-অজানা কথা। আর রবিঠাকুরের মাকে নিয়ে রচিত এই বইটির নাম হলো ‘রবির মা‘। রবিঠাকুরকেকে সংক্ষেপে রবি লেখা হয়েছে এখানে, আর তাঁর মাকে নিয়েই বইটি লেখা হয়েছে বিধায় এই নামকরণ। পুরো পৃথিবীর কাছে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে পরিচিত হলেও তাঁর মায়ের কাছে তো তিনি ছোট রবিই ছিলেন। তাই ‘রবির মা’ নামকরণটি বেশ যুক্তিযুক্ত হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিশিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘কথাপ্রকাশ‘ থেকে।

বইটি রচনা করেছেন বিশিষ্ট লেখক শেখ সাদী। পেশায় সাংবাদিক শেখ সাদী এর এখন পর্যন্ত রচিত বইয়ের সংখ্যা ৮, যার মধ্যে ‘রবির মা‘ বইটি অন্যতম। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন, একইসাথে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিষয়ে একজন অত্যন্ত আগ্রহী ও উদ্যমী ব্যক্তিও। এই দুই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তাঁর ঝোঁক ও আগ্রহ অপরিসীম। বিশেষ করে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের একজন বিশাল ভক্ত এবং একইসাথে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী। তিনি রবীন্দ্রনাথের সকল সাহিত্যকর্ম শুধু অনুসরণই করেননি, রীতিমতো তাঁকে নিয়ে, তাঁর রচিত সাহিত্য ও তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর এই গবেষণার ক্ষেত্রে বাদ পড়েননি রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষরাও। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রবিঠাকুরের মা সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা ও তথ্যাবলী খুঁজে বের করেছেন, গবেষণা চালিয়েছেন ও সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। যেগুলো তিনি পরবর্তীতে তুলে ধরেছেন তার রচিত এই বইটিতে। রবীন্দ্রনাথের একজন বিশাল মাপের ভক্ত হিসেবে এই বইটি রচনা করেছেন তিনি এবং রবিঠাকুরের মাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন পাঠকদের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে।
১৮৩০ সালে জন্মগ্রহণ করা সারদা দেবী অনেক কম বয়সে এক মামার সঙ্গে পাড়ি দেন কলকাতায়, এবং একসময় কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের ছেলে দ্বেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। একে একে তিনি ১৪ সন্তানের জন্ম দেন। তবে সংসারের বিভিন্ন কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকায় তিনি তাঁর সন্তানদের ঠিকমতো সময় দেয়ার সুযোগ পাননি। আর বিশেষ করে রবিঠাকুর বঞ্চিত হন তাঁর ভালোবাসা থেকে। ছোটবেলা থেকেই রবিঠাকুর মায়ের সান্নিধ্য তেমন পাননি মায়ের বিভিন্ন অসুস্থতা ও অন্যান্য সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে। আর এরপর রবিঠাকুরের বয়স যখন ১৪, ১৮৭৫ সালে তাঁর মা সারদা দেবী মারা যান। ফলে চিরকালের জন্য মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন তিনি, যা পরিণত হয় তাঁর আজীবনের আক্ষেপে। এসকল নানা কথা এবং অন্যান্য জানা-অজানা নানা বিষয়ই সুচারুভাবে লেখক শেখ সাদী ফুটিয়ে তুলেছেন ‘রবির মা‘ বইটিতে।
কাজেই কারো যদি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার, বিশেষ করে তাঁর মা সারদা দেবীকে নিয়ে জানার আগ্রহ থাকে, তাহলে তার জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। আর রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হলে বইটি এমনিতেও সংগ্রহে রাখা অবশ্য কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা কে নিয়ে লেখা বইটি দেখুন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আরোও যে ৪ টি বই পড়তে পারেন
১) দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে/ আকবর আলি খান
২) রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে/ কেতকী কুশারী ডাইসন
৩) রবীন্দ্রনাথ : অন্য আলোয় ঈশ্বর আত্মা কারণ/ পিনাকী ভট্টাচার্য
৪) রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা/ অমিতাভ চৌধুরী
*লিখেছেন সিয়াম আলমাস
comments (0)