বাংলা সাহিত্য তার ভান্ডারে ‘উপন্যাস’ কে নিয়ে আসে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত ধরে। তারপর, রবীন্দ্রযুগ বাংলা উপন্যাসে এনে দিয়েছে স্বর্ণসময়, বঙ্কিমের হাতে হয়েছে সমৃদ্ধ, বিভূতিভূষণ আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে উপন্যাসকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা, নিচুতলার মানুষদের চাওয়া বইয়ের কালো অক্ষরে মমতায় তুলে এনেছেন শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দোপাধ্যায় জুড়ে দিয়েছে্ন আধুনিকতা, এবং তারপর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যুগিয়েছেন ভাবনার খোরাক, আহমদ ছফা দিয়েছেন শক্তি আর নতুন একটি বিপ্লবের শুরু করে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। “নন্দিত নরক” দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ যে জাদুকরী ক্ষমতা তৈরী করেছিলেন, তার মধ্যে তার সৃষ্টি চরিত্র ‘হিমু’ সাহিত্যানুরাগীদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলো। “ময়ূরাক্ষী” দিয়েই ম্যাজিশিয়ান হিমুর পথচলা শুরু।

“ময়ূরাক্ষী” প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে এবং বাংলা সাহিত্যে রীতিমত সাড়া জাগিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ‘হিমু’।
“এ্যাই ছেলে এ্যাই ” বাক্যটি দিয়ে শুরু হওয়া বইটিতে পাঠক হিমুর স্বভাবসুলভ রসিকতা, মুগ্ধময় বিভ্রান্তিকরণ, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর তাৎক্ষণিক বাচিক ক্ষমতা শুরুতেই পেয়ে যাবেন। বইটির প্রথম কিছু অংশ পড়া শুরু করলে বই শেষ না করে উঠা কঠিন। জাস্টিস সাহেবের স্ত্রী আর মেয়ের সাথে ইচ্ছাকৃত জটিলতার কারণে থানায় যাওয়া এবং অতঃপর ওসির সাথে হিমুর কথোপকথন পাঠক হিসেবে আমাদের হাসাতে বাধ্য করবে। এর পরপর-ই ময়ূরাক্ষী নদীর ইতিহাস পাঠক অজান্তে হিমুর মাধ্যমে কল্পনায় পেয়ে যাবো-“নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি পরা একটি মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু এক ঝলক তাকে দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হল”।
হিমুর ফুফাতো ভাই বাদল আর ফুফাতো বোন রিনকি হিমুকে প্রচন্ড ভালবাসে। ফুপার সাথে হিমুর ছোট ছোট দার্শনিক সংলাপ আমাদের ভাবিয়ে তুলবে। ধীরে ধীরে আমরা হিমুর শৈশব থেকে শুরু করে তার বড় হওয়া দেখবো। প্রচন্ড নির্মমতায় মহাপুরুষ বানানোর লক্ষ্যে হিমুকে হিমুর বাবার সাথে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পাবো এবং চোখ নোনাময় হয়ে যাবে। পরক্ষণেই অসম্ভব রুপবতী তরুণী, রুপার সাথে সাথে আমাদেরও হিমুকে ভালবাসতে ইচ্ছে করবে; যে রুপা প্রতিদিন নীল শাড়ি পরে বারান্দায় হিমুর জন্য অপেক্ষা করে। বইয়ের শেষে হিমুর অনন্ত পথচলা দেখে আমাদের থমকে যেতেই হবে।
“ আমার সমস্যার কথা রুপাকে কি আমি বলতে পারি? আমি কি বলতে পারি – আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হবার সাধনা করি। যখন খুব ক্লান্তি অনভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুয়ে ছুয়ে এক জন তরুনি ছুটে চলে যায়,এক বার শুধু থমকে দাড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুনীটি আমার মা। আমার বাবা যাকে হত্যা করেছিলেন।
এই সব কথা রুপাকে বলার কোনো অর্থ হয় না. বরং কোনো-কোনো দিন তরঙ্গিনী স্টোর থেকে টেলিফোন করে বলি – রুপা, তুমি কি এক্ষুনি নীল রঙের একটা সারি পরে তোমাদের ছাদে উঠে কার্নিশ ধরে নিচের দিকে তাকাবে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। একটুখানি দাড়াও। আমি তোমাদের বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যাব। আমি জানি রুপা আমার কথা বিশাস করে না, তবুও যত্ন করে সারি পরে। চুল বাধে। চোখে কাজলের ছোয়া লাগিয়ে কার্নিশ ধরে দাড়ায়। সে অপেক্ষা করে. আমি কখনো যাই না। আমাকে তো আর দশটা ছেলের মত হলে চলবে না. আমাকে হতে হবে অসাধারণ।
আমি সারাদিন হাটি। আমার পথ শেষ হয় না। গন্তব্যহীন যে যাত্রা তার কোনো শেষ থাকার কথাও নয়…”
একজন পাঠকের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো হুমায়ূন আহমেদ খুব যত্নের সাথে হিমুর মাধ্যমে তুলে এনেছেন। “ময়ূরাক্ষী” দিয়ে যে হিমুর যাত্রা, তা পাঠককে আমৃত্যু অন্ত্যহীন পথে সঙ্গী করে নিয়ে বেড়াবে। যে ভ্রমণ আনন্দের, ভালোবাসার এবং এক-ই সাথে গভীর বিষাদের।
যারা বইটির কিছু অংশ পড়তে চান তারা এখানে ক্লিক করুন, ময়ূরাক্ষী , আসুন বই থেকে দেখে নেই নির্বাচিত ৫ টি উক্তিঃ
১. হাসিতে খুব সহজেই মানুষকে চেনা যায়। সব মানুষ একই ভঙ্গিতে কাঁদে কিন্তু হাসার সময় একেক জন একেক রকম করে হাসে।
২. যখনই সময় পাবি ছাদে এসে আকাশের তারার দিকে তাকাবি, এতে মন বড় হবে। মনটাকে বড় করতে হবে। ক্ষুদ্র শরীরে আকাশের মতো বিশাল মন ধারণ করতে হবে।
৩. ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনো যেতে নেই
৪. সমস্ত কষ্টের মূলে আছে আমাদের উচ্চাশা
৫. মিথ্যা বলা মন্দ। তবে আনন্দের জন্য মিথ্যা বলায় অন্যায় নেই। মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি। যেমন ধরুন, গল্প উপন্যাস এসব মিথ্যা। কিন্তু এসব মিথ্যা দিয়ে আমরা সত্যকে চিনতে পারি।
আরোও দেখুনঃ
comments (0)