আসাদ হাসল।
বলল, চিঠি লিখে হৃদয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো। অপেক্ষায় থাকব।
তোমার হৃদয়ের পোষ্ট কোড কত?
শূন্য শূন্য দুই পাঁচ পাঁচ।
এটা কী?
আমার হৃদয়ের পোস্ট কোড নম্বর। তুমি না দিতে বললে?
রাইসা হাসল। এর মানে কী?
আমার হৃদয়ের রং নীল। আর নীল রঙের কোড হলো ০০২৫৫..
—-নীল চিঠি
বইমেলা ২০২২ এ প্রকাশিত, তরূণ সাহিত্যিক নিশো আল মামুনের নতুন উপন্যাস ‘নীল চিঠি’।
চিঠি- দুই বর্ণের ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এই ছোট্ট শব্দের মাঝে যেন লুকিয়ে থাকে একরাশ আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বিষাদের নীল ছোঁয়া। আসাদের জীবনে চিঠির প্রভাব ব্যাপক। চিঠি বয়ে এনেছে সুখের বার্তা, কখনও হারানোর বেদনা, ভালবাসার প্রথম প্রহরেও সে চিঠি দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে।
নিশো আল মামুন ১৯৮৬ সালে জামালপুর, বকশিগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। স্ট্র্যাটিজিক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে যুক্তরাজ্য থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করলেও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা অগাধ। ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘অমিমাংসীত সমাপ্তি’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ।তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মাঝে রয়েছে অমিমাংসীত সমাপ্তি, ভোরের ঝরা ফুল,জ্যোৎস্নার বিয়ে, নিখিলের নায়ক, বসন্ত দুপুরের নীলাকাশ, গৃহত্যাগী জোছনা, নীল আকাশের নীচে, কাছে দূরে, শেষ স্পর্শ, সুখের গহিনে শোক, নীল স্বপ্ন, জোছনায় ফুল ফুটেছে,মানুষছবি ইত্যাদি।
চোখজুড়ানো, মনকাড়া প্রচ্ছদের ‘নীল চিঠি’ বইটি একটি আদ্যোপান্ত ভালবাসার উপন্যাস। দুটি তরুণপ্রাণ আসাদ-রাইসার নিষ্পাপ প্রেমের উপাখ্যান এর মূল কাহিনী। সেই সাথে পৃথিবীতে অনিঃশেষ ভালবাসা বলতে কিছু নেই। ভালবাসার প্রতিবিম্ব হচ্ছে বিষাদ। তাই ‘নীল চিঠি’ সেই বিষাদেরও কাহিনী।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আসাদ। বাবা আবেদ আলী, মা আফরোজা বেগম, ছোটবোন আরভি কে নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার ছিল তাঁর। কিন্তু পরবর্তীতে ছোটবোন ও বাবাকে হারায় সে দুই মাসের ব্যবধানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে আসাদ। তাঁর ভালবাসার মানুষ রাইসা। সে একই প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগ থেকে পড়াশুনা শেষ করে আসাদের ঘরে বঁধুবেশে যাবার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করছে। উপন্যাসের শুরুতে ছোটবেলাকার আসাদের গভীর রাতে তারা দেখার ঘটনা দিয়ে শুরু করেন যার মাধ্যমে আসাদের প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা ও একইসাথে মহাকাশের অসীম জগতকে জানার আগ্রহের দিকটি প্রকাশ পায়। এর মাধ্যমেই আসাদের ফিজিক্স নিয়ে পড়াটা পাঠকের মনে গ্রহণযোগ্যতা পাবার ক্ষেত্র তৈরি করে রাখেন ঔপন্যাসিক। কিন্তু ছেলেবেলার সেই সুন্দর সময় পার হতে না হতেই আমরা দেখি আসাদ এক হাজার সিভি জমা দিয়েও ইন্টারভিউর কার্ডটি পর্যন্ত পায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই চাকরি না হলে রাইসাকে ঘরে তুলতে পারবে না। তাই রাইসা দিন গোনা চলতেই থাকে। ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে ফার্স্ট ইয়ারের রাইসার সাথে পরিচয় হয় আসাদের। দুজনার দুটি পথ যখন এক হয়ে গিয়েছে তখন থেকে রাইসা আগলে আগলে রেখেছে ভালবাসার কোমল স্পর্শে। রাইসার প্রতি ভালবাসা নিবেদনের কাব্যিক মুহুর্তে পাঠকেরও ইচ্ছে হবে প্রেমে পরার। সুদূরতমা প্রিয়াকে বলতে ইচ্ছে করবে-
তোমার জন্য এই শহরে হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট ডাকব। মশাল হাতে মিছিল করব। কাজ না হলে কারফিউ। তোমার জন্য এই শহর লাল গোলাপে সাজিয়ে দেব। নজরুলের কাছে চেয়ে নেব–রামধনু আলতা আর তারার ফুল।

মুঠোফোনে আসাদ-রাইসার কথোপকথনে আমরা একটি মিষ্টি প্রেমের সাথে পরিচয় পাই, যে প্রেমে আছে পরস্পর বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভরসা। নেই কোন অশ্লীলতা, পঙ্কিলতা।
আসাদের ঘটমান জীবনের ফাঁকে ফাঁকে লেখক নিয়ে আসেন তাঁর অতীত স্মৃতি। তাঁর পরিবারের কাহিনী। বাবা আবেদ আলী একজন সৎ স্কুল শিক্ষক। অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করা অতি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। সৎ, ভালো চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে আশ্রিত বাড়ির মালিক নিজ কন্যাকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের পর কর্ম জীবনে প্রবেশ করতে চলে আসেন ময়মনসিংহ। পৌলমী হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। কর্ম জীবনের শুরুতে সহকর্মী হিসেবে পরিচয় ঘটে দীপেন্দ্র ঘোষ। অত্যন্ত সজ্জন দীপেন্দ্র ঘোষের পরিবার-পরিজন সবাই ইন্ডিয়া চলে গেলেও শেকড়ের টানে তিনি এক থেকে যান ময়মনসিংহে। রতনে রতন চেনার মতই দুইজন শুদ্ধ মানুষ একে অন্যকে চিনে নেন। তাদের দুইজনের বেশ ভালো বোঝাপড়া তাই শুরু থেকেই তাদের মাঝে সখ্যতা দেখা দেয়। দীর্ঘ ১৫ বছর একসাথে, সুখে-দুখে মিলেমিশে থাকেন তাঁরা। পরবর্তীতে কর্মজীবন শেষে ভারতে ফিরে যাবার সময় চিরকুমার দীপেন্দ্র ঘোষ পৈতৃক বাড়ির দায়িত্ব তুলে দেন আবেদ আলীর কাছে। আবেদ আলীও দীপেন্দ্র ঘোষের ছোটভাইয়ের বিপদের মুহুর্তে পাশে দাড়াতে কার্পণ্য করেন না। এভাবে দিনগুলো ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু মানুষের জীবনে নির্বিষ সুখ থাকে না কখনো। আবেদ আলীর বাড়ীতে সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হতে তাঁর সংসারে উদয় হয় আফরোজা বেগমের দূর সম্পর্কের বোন মণি ও তার স্বামী নয়ন ডাক্তার। মেয়ের চিকিৎসার নাম করে সেই যে আসাদদের বাড়িতে এসে ওঠে পরবর্তীতে ধূর্তলোক লাল মামার চক্রান্তে আফরোজা বেগমকে বাড়ি ছাড়া করে কিন্তু নিজেরা আর ছাড়ে না। জগতে কিছু মানুষ থাকেই এমন যারা মানুষের ভালোমানুষির সুযোগে নিজের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। উপন্যাসের এ চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ঔপন্যাসিক সমাজের ওইসব মানুষদের মুখোশ উন্মোচন করার যে প্রয়াস দেখিয়েছেন তা সত্যি অসাধারণ।
অতীতের ঘটনাবলীর ফাঁকে ফাঁকে আসাদের বর্তমানের চিত্র দেখতে পাই। বড় বড় কোম্পানীতে গিয়ে আসাদ শোনে ব্যবসায় লস,পরে ডাকবে। টিউশন মিডিয়াতে সিভি জমা দিয়েও কোন লাভ হয় না। একটা টিউশনিও জোটাতে পারে না। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরা আসাদ বিড়ি তৈরির ফ্যাক্টরিতে পর্যন্ত যায় চাকরির আশায় কিন্তু সেখানে সে ওভার কোয়ালিফাইড। বিড়ি মোড়ানোর মত কাজেও যোগ দিতে পারে না আসাদ। ওদিকে তাঁর লাল নানু, মণি খালা আর নয়ন খালুর চক্রান্তে বাড়িছাড়া হতে হয় তাঁর মাকে। ঢাকা শহরে যেখানে একা মেসে থাকতেই হিমশিম খেতে হয়, সকাল-বিকেল দুবেলা মেসের মালিকের কথা শুনতে হয় সেখানে মাকে নিয়ে এসে আসাদের যেন রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ওদিকে মেসের মালিক একরাতের নোটিশে মেস ছাড়ার কথা বলে যায়। দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে বস্তিতে পর্যন্ত থাকতে চলে যায় আসাদ কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
ওদিকে রাইসার অপেক্ষার প্রহর যেন ফুরায়ই না। ঘোর শনির দশা যেন তাদের ভালবাসাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এ ঘোর অমাবস্যা কি আর কাটবেই না? বাস্তবতার কঠিন কষাঘাতে আসাদের সেই প্রেমময়তাও যেন লোপ পাচ্ছে। বেচারি রাইসা তবু হাল ছাড়ে না। আসাদের নষ্ট মুঠোফোনের জন্য ঠিকমত কথাটুকুও হয় না। এমনি একদিন কথা বলার সময়ে আসাদ-রাইসার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরেই উপন্যাসে আসে নতুন মোড়।
কথায় বলে, “রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটে আসে।” আসাদের জীবনের সমস্ত অমানিশা যখন চারদিকে ঘিরে ধরে তখন একটু আলোর আশায় সে তাঁর কলেজ শিক্ষক হাফিজ উদ্দীন স্যারের কাছে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় শান্ত, স্নিগ্ধ নদীর মত তরূণী মৃত্তিকার সাথে। এরপর আসাদের জীবনে একের পর এক নতুন চমক অপেক্ষা করে। আসাদের দুর্দিন এবার যেন শেষ হতে চলেছে। শুধু শেষই না, আসাদের সামনে আসে অনেক বড় সুযোগ। এত সব ভালো খবরের দিনে আসাদ কি রাইসার কাছে ছুটে না যেয়ে পারে? না পারে না। তাইতো একগুচ্ছ গোলাপ হাতে নিয়ে আসাদ তাঁর প্রিয়তমা, পুনশ্চ, শতরূপা-রাইসার বাসার সামনে চলে যায়। সেখানে গেলে রাইসার বদলে তাঁর বোন রচনা আসাদের হাতে তুলে দেয় একটি নীল খামে ভরা চিঠি। আসাদের জীবনের সব হিসেব-নিকেশ যেন পাল্টে দিল চিঠিখানি।
প্রথম প্রেম নিবেদনের সময় রাইসাকে আসাদ হৃদয়ের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিল। প্রথম প্রেমের অনুভূতি নিয়ে রাইসা তাঁর ভালোবাসাকে চিঠি দিয়েছিল ভালোবাসার রঙে। আজ রাইসা তাঁর হৃদয়ের সমস্ত আবেগ অনুভুতি মিশিয়ে আসাদের হৃদয়ের রঙে চিঠি লিখে নীল খামে করে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী লেখা ছিল? কেনইবা রাইসা এত বছর বাদে নীল রঙের খামে চিঠি পাঠালো? তবে কি এই বার্তা ভালোবাসার বদলে বিষাদের নীলে মাখা ছিল।
এমনই বিষাদের নীল রঙে মোড়ানো ভালোবাসাময় উপন্যাস ‘নীল চিঠি’।
মিষ্টি কিছু ভালবাসার ছোট ছোট চিত্রন পুরো উপন্যাস জুড়ে। সেটি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাবা-ছেলে, ভাই-বোন, আত্মীয়-প্রতিবেশী সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বর্তমানকালে মানুষে-মানুষে, ভায়ে-ভায়ে যে হানাহানি; উপন্যাসটি পড়া শেষে কিছুটা হলেও হৃদয়ে প্রশান্তি বিরাজ করবে এই ভেবে যে লোভের পৃথিবীতে এখনও আবেদ আলীর মত সৎ পরোপকারী, দীপেন্দ্র ঘোষের মত কোমল, আফরোজার মত মমতাময়ী, রাইসার মত প্রেমময়ী কিছু মানুষ থাকে বলেই পৃথিবী এত প্রেমময়।