লেখক একজন জাদুকর। নিজের বুকের ভেতর থেকে তিনি বের করে আনেন মানুষের স্বপ্ন আর কল্পনার পৃথিবী। আর লেখকের চিন্তাভাবনাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করার দায়িত্ব নেন একজন প্রকাশক। তিনি বইয়ের ভাববস্তুকে প্রচ্ছদে–আকারে–নকশায় রূপ দেন এবং আক্ষরিক অর্থে লেখকের স্বপ্নকে পরিবেশন করেন দুটি মলাটের ভেতর। সেসব স্বপ্ন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, পাঠকের সঙ্গে জাদুভরা পৃথিবীর সেতুবন্ধ রচনা করার উদ্দেশ্য নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল প্রথমা প্রকাশন। সে লক্ষ্যে কলকাতাসহ দেশি–বিদেশি বইয়ের বিপুল সমাহার বলা যায় প্রথমাকে। জনপ্রিয় উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, জীবনী–আত্মজীবনী, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়, ধর্ম, আত্মোন্নয়ন, রহস্য–রোমাঞ্চ, অনুবাদ, কবিতা, কী নেই প্রথমার ঝুলিতে? মিডিয়াস্টার লিমিটেডের (প্রথম আলো) এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০২২ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানসম্পন্ন বই। তেমনই কিছু বইয়ের কথা আলোচিত হলো এই লেখায়।
১। মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকান্ড- মিজানুর রহমান খান
বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন দলিলপত্রে সংরক্ষিত অনেক গোপন তথ্য মিজানুর রহমান খান প্রথমবারের মতো এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। তাঁর একাগ্র চেষ্টা ও কঠিন পরিশ্রম ছাড়া হয়তো এই তথ্যগুলো কোনো দিনই আমরা জানতে পারতাম না। বইটি পড়লে আমরা আমাদের ইতিহাসের এক কৃষ্ণ অধ্যায় সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য জানতে পারব, যা হয়তো আমাদের ধারণারও অতীত ছিল । লেখাগুলো ইতিপূর্বে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সব কটি লেখা একত্র করে এই প্রথম প্রকাশ করা হলো। বইটি কেবল সাধারণ পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্তি ও বাড়তি কৌতূহলের জন্ম দেবে না। গবেষকদেরও প্রয়োজন মেটাবে বলে আমাদের ধারণা।

২। বাংলা গানের ইতিহাস–গোলাম মুরশিদ
গান শুনতে সবারই কমবেশি ভালো লাগে। কিন্তু প্রথম বাংলা গান রচিত হলো কখন? কে রচনা করেছিলেন সেই গান? তাতে সুরই-বা দিয়েছিলেন কে? ইউরোপে সবচেয়ে পুরোনো যে বাঁশি পাওয়া গেছে, তার বয়স বিয়াল্লিশ হাজার বছর। আমাদের বাংলা গানের বয়স কত? উত্তরটা আমাদের জানা নেই। এ বইয়ে সে উত্তর খোঁজা হয়েছে। ভাষা না-হলে গান হবে কী করে? কাজেই বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষার জন্মের পর বাংলা গানের সৃষ্টি। আমাদের ভাষার বয়স এখনো হাজার বছর হয়নি। কিন্তু বয়স যা-ই হোক, এ ভাষায় বিচিত্র ধরনের গান লেখা হয়েছে! এ বইয়ে চর্যাপদ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাংলা গানের জন্ম এবং বিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কীভাবে তার অঙ্কুরোদ্গম ও বিকাশ ঘটল, কোন সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হলো —এ বই থেকে আমরা তা জানতে পারব। বাংলা গান এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে এ যাবৎ অনেক বই লেখা হয়েছে। এ বই তা থেকে আলাদা। লেখক এ বই লিখেছেন একেবারে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিতে।

৩। প্রাথমিক গণিতের ভিত্তি– মুনির হাসান
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যখন প্রাইমারি পার হয়ে হাইস্কুলে আসে, তত দিনে অনেকের গণিতের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ হলো আমাদের অধিকাংশ স্কুলে গাণিতিক পদ্ধতি ও সমাধানে যত জোর দেওয়া হয়, মূল বিষয়গুলোতে ততটা জোর দেওয়া হয় না। ফলে অনেকেই গণিত মুখস্থ করে। অথচ গণিতের মূল বিষয়গুলো কেউ আত্মস্থ করতে পারলে গণিতের জগৎটা হয়ে ওঠে আনন্দময়। এ বইটি তাই লেখা হয়েছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের গণিতের ভিত্তিকে জোরদার করার জন্য। গণিতের হাতেখড়ি হয় সংখ্যা দিয়ে। ক্রমান্বয়ে সংখ্যার মূর্ত ধারণা থেকে শিক্ষার্থীরা বিমূর্ত ধারণায় প্রবেশ করে। সংখ্যার ধারণা তাই যত পোক্ত হয়, উচ্চতর গণিতে তাদের বিচরণও তত সড়গড় হয়ে ওঠে। সংখ্যা পাতন থেকে শুরু করে, যোগ-বিয়োগের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এ বই পড়ুয়াদের খুব সহজে ভগ্নাংশের গুণভাগে পৌঁছে দেবে। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখে লেখা হলেও যাঁরা তাদের গণিতের দীক্ষা দেন, তাঁদের জন্য এ বইটি সমান উপযোগী।

৪। পুরানো সেই দিনের কথা– আকবর আলী খান
পুরানাে সেই দিনের কথা আকবর আলি খানের আত্মজীবনী । এ আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে লেখক তাঁর পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে লিখেছেন আবার নবীনগরের প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও লিখেছেন। ছােটবেলা থেকে লেখক ছিলেন বইপাগল। তবে নবীনগরে ভালাে বই পাওয়া যেত না। ভালাে বই পড়ার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা মিটত ঢাকায় এলে। তিনি হন তুখােড় পাঠক। এই পাঠকই একদিন পড়তে পড়তে এবং গবেষণা করতে করতে লেখকে পরিণত হন। অবশ্য কোনাে বই-ই দীর্ঘদিন গবেষণা ছাড়া তিনি লেখেন। না। তাঁর প্রথম বই বের হয় ৫২ বছর। বয়সে। ব্যক্তিগত জীবনে লাজুক এই লােকটি জীবিকার জন্য যােগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে । সিভিল সার্ভিসের বিচিত্র কাজের অভিজ্ঞতা তাঁকে মুখােমুখি করে নানা চ্যালেঞ্জের। এই অভিজ্ঞতার বিবরণ। পাঠকদের কাছে পড়তে ভালাে লাগবে। লেখক মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই বইয়ের তিনটি অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকারের ক্রিয়াকাণ্ড বর্ণনা করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধ্যায়গুলােতে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।

৫। কথাপুষ্প : প্রজ্ঞাবানদের বলা গল্প – রায়হান রাইন
ছোট ছোট গল্প, তবে একেকটি গল্পের ভেতর লুকিয়ে আছে প্রজ্ঞার গভীর দীপ্তি। প্রজ্ঞা—জ্ঞানের রহস্যময় সহোদরা, যখন সে আপনার সঙ্গে আছে, আপনি জীবনকে অর্থময় দেখতে পান, সবকিছু ইতিবাচক হয়ে ওঠে আপনার কাছে, বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েও আপনি সহজ থাকেন, আপনার অন্তর থাকে শান্ত। আলোর বিচ্ছুরণে আপনি নিজে এবং আপনার চারপাশ নিরুদ্বেগ আর আনন্দময় হয়ে ওঠে। গল্পগুলোকে মনে হবে একেকটি ছোট প্রিজম, যার বিভিন্ন তল থেকে বিচ্ছুরিত হয় অর্থময়তার বর্ণিল আলো। সেই আলোর উৎস খুঁজতে, কিছুক্ষণ থামতে হয় গল্পগুলোর পাশে, সন্ধানী দৃষ্টিতে ফিরে তাকাতে হয় এবং মিলিয়ে নিতে হয় নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তখন আপনার নিজের ভেতরেও আলো এসে পড়ে।

৬। এলিয়েনের সন্ধানে– ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল এলিয়েনদের নিয়ে। কয়েকজন বিজ্ঞানী ১৯৫০ সালে দুপুরের খাবার খেতে বসে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তারা কোথায়? স্টিফেন হকিং স্পষ্ট মানা করে দিয়েছেন এলিয়েনদের সঙ্গে যেকোনো যোগাযোগের প্রচেষ্টাকে। কেন? আমাদের ছায়াপথে তারা আদৌ আছে কি? ড্রেক ইকুয়েশন কী বলে? আমরা কি একা? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য।

৭। কল সেন্টারের অপরাজিতা– রাহিতুল ইসলাম
‘কল সেন্টারের অপরাজিতা’ উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম অপরাজিতা। এই অপরাজিতা পরাজয় মানে না। আর সব কল সেন্টারের পেশাজীবীদের মতো তাকেও নানান সময় নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের অপরাজিতা তার পেশাকে ভালোবাসে। নিজেকে অন্যান্য পেশার লোকের চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করে না। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না সে। পিতৃহীন সংসারে এক ভাই আর মাকে নিয়ে তার বসবাস। সংসার চালাতে তার ভূমিকাও কম নয়। আমাদের সমাজে মেয়েদের চাকরি করা নিয়ে বাজে কথা শুনতে হয় প্রায়শই। তার ওপরে যদি হয় এমন পেশা যেখানে রাতেও কাজ করতে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আত্মীয়-স্বজনও ঠারেঠারে দুকথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না। কিন্তু অপরাজিতা এসব গায়ে মাখে না। তার সামনে পেশাগত চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি সংসারের চ্যালেঞ্জও কম না। অল্প বয়সে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় অবিবাহিতা অপরাজিতা। আমাদের সমাজে নতুন পেশার একজন নারীর ভেতর বাইরের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে।

‘কল সেন্টারের অপরাজিতা’ উপন্যাসের লেখক রাহিতুল ইসলামের ১১তম উপন্যাস। এর আগেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের না-বলা গল্পগুলো তার লেখনীতে তুলে ধরেছিলেন। রাহিতুল তার গল্প-উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে পাঠকদের জানিয়ে থাকেন তথ্যপ্রযুক্তির জগতের জানা-অজানা কথা।
আরও পড়ুন- কথাপ্রকাশের নতুন বই, পড়ে এবার ধন্য হই!
২০২২ বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনের নতুন বইগুলো
প্রথমা প্রকাশনের সবচে বেশি বিক্রিত বইগুলো দেখুন