সম্পর্ক! এমন একটি শব্দ যার মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই নানা জনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ক, অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক। কিছু সম্পর্ক হয় চিরস্থায়ী। কিন্তু সম্পর্ক খুব জটিল এবং ভঙ্গুর। তাই ভালবাসার গভীরতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় তা ঠুনকো অভিমানের কারণে ভেঙে যায়। কিছু সম্পর্ক ভেঙে গেলেও পরে জোড়া লাগে। অনেক ক্ষেত্রে আবার সেটাও হয় না। একটি উক্তি না বললেই নয়-
“আমার অভাব যদি তুমি বুঝতে না পারো, তাহলে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই দৃঢ় হবে না ।”
— কালস্যান্ড বার্গ
পিওনা আফরোজ-এর “নিহত জ্যোৎস্না” একটা জীবনমুখী গল্প সংকলন। একজন লেখকের কাছে সাধারণ পাঠকের একটাই চাওয়া থাকে, যেন সে গল্পের সব চরিত্রের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে। গল্পের সব চরিত্রে যেন সে নিজেকে খুঁজে পায়। গল্পের বর্ণনাশৈলী ও গল্পের গতিশীলতায় যেন নিমেষেই পাঠককে আটকিয়ে ফেলে বইয়ের পাতায়।
পিওনা আফরোজ নবীন কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসাই তাকে ক্রমে সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে এবং তার লেখা এতই চমৎকার যে পড়লে বোঝা যায় না তিনি নবীন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সাহিত্যের নানা শাখায় তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। তার প্রথম উপন্যাস “কাছের মানুষ দূরের মানুষ” গত ফেব্রুয়ারি ২০২১ বইমেলায় প্রকাশিত হয়ে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনই আশা করা যায় ‘নিহত জ্যোৎস্না’ বইটিও পাঠকদের মধ্যে সারা ফেলবে।
যেহেতু ‘নিহত জ্যোৎস্না‘ একটি জীবনমুখী গল্প সংকলন, তাই গল্পগুলোতে আবর্তিত হয়েছে পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের মতো বিষয়কে ঘিরে।
এই বইয়ে নয়টি গল্প রয়েছে যেগুলোর প্রথমটা “ছায়ামানুষ” এ গল্পে উঠে এসেছে প্রেমের ছদ্মবরণে প্রতারণা। গল্পের মূল চরিত্র আসিফ এবং কেয়া৷ হঠাৎ একদিন কেয়ার জীবনে চলে আসে এক তরুণ, যে ছিল পুরোটাই অপরিচিত, আসিফ নিজ থেকে এসেই পরিচিত হয় কেয়ার সাথে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয় এবং প্রায় প্রতিদিনই তাদের কথা চলতে থাকে। ছেলেটার কথার সম্মোহনী শক্তির জেরে কেয়া একটু একটু করে দুর্বল হয়ে যায়। যে মেয়ে সব কাজ নিজে করত এবং সময়ের কাজ সময়ে করত সে এখন সব বিষয়ে আসিফের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আসিফ কেয়ার সাথে সাথে কেয়ার পরিবারের সদস্যদের সাথেও ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সম্পর্কের সুবাদে আসিফ প্রায়ই কেয়ার বাড়িতে আসা যাওয়া করত। হঠাৎ একদিন কেয়া বাড়ি ফিরে দেখে তার বাড়িতে কিছু জিনিস চুরি হয়ে গেছে, তার বাবার দেওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যে সোনার চেনটা ছিল সেটাও নেই। সে তারপর আসিফের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে আসিফের কোনও খোঁজখবর আর পাওয়া যায় না। এবং তার পরিবার থেকে জানতে পারে আসিফ সর্বশেষ তাদের বাড়িতে এসেছিল। তাহলে কি আসিফই তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে তাদের ক্ষতি করে চলে গিয়েছে? নাকি অন্য কোনও কারনে আসিফ কেয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে? লেখিকা এখানেই গল্পটির সমাপ্তি টেনেছেন, এবং গল্পটির শেষ কি হবে তা পাঠকের কাছেই ছেড়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে এখনকার সময়ে এই ধরনের প্রতারণা হরহামেশাই চোখে পড়ে। কারণ আমরা সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলি আর তারা আমাদের এই দুর্বলতাকে তাদের কাজে লাগায়। যদি কেয়া আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করত? আসিফের ব্যাপারে আরও জানার চেষ্টা করত? তাহলে হইতো-বা তাকে এই প্রতারণার সম্মুখীন হতে হত না।
বইটিতে আরেকটা হৃদয় বিদারক গল্প হলো “নিহত জ্যোৎস্না”। বইয়ের নাম-গল্প। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একমাত্র ছেলে। ভালোই কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো তাদের। কিন্ত বাইরে থেকে ভালো দেখা গেলেই সবসময় ভালো থাকে, তা নয়। কোনোভাবে মেয়েটি জানতে পারে তার স্বামীর সাথে অন্য একটা মেয়ের সম্পর্ক আছে। সেটি জানার পর সে বার বার ভাবতে লাগলো কেন এমনটা হলো তার সাথে এবং সে বার বার নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো এই ঘটনা ঘটার পিছনে। যখন সে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল তখন সে কোনও সংকোচ ছাড়ায় সেটা স্বীকার করে নেয়। মেয়েটি তখন তার ছেলেকে নিয়ে তার স্বামী থেকে আলাদা থাকতে শুরু করে। নিজের এবং তার সন্তানের জন্য তাকে বেশ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর এই টানাপোড়েন ও বিচ্ছেদের কারণে সন্তানের ওপর মানসিক প্রভাব পড়ে। প্রভাবটা এত বেশি ছিল যে, সন্তানকে শেষমেষ হারিয়ে ফেলে এবং এক করুণ পরিসমাপ্তিতে রূপান্তরিত হয়।
বইটিতে “প্রতীক্ষা” গল্পটি রচিত হয়েছে একজন বাবা-মায়ের তাদের একমাত্র সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় পার করা এক একটি মুহূর্তকে ঘিরে। গল্পতে নাহিদ তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সে অনেক মেধাবী, নম্র, ভদ্র। তাকে নিয়েই তার বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন। বরাবরই স্কুলে মেধা তালিকায় তার নাম থাকে কিন্তু এবারে ফলাফল খারাপ হয়েছে। সে ভাবতে লাগলো, কিভাবে বাড়ি ফিরে ফলাফলের কথা বাবা-মাকে জানাবে? কিভাবে সে তাদের বুঝাবে যে, সে পড়াশোনায় কোনও কমতি রাখেনি? তার মনের মধ্যে এক প্রকার ঝড় শুরু হয়ে গেল, কিভাবে সে বাড়ি যাবে। কিন্তু সে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আর কোনওদিন বাড়িতে ফিরলো না। সে একবারো ভাবলো না যে, তার এ পদক্ষেপের ফলে তার বাবা-মায়ের সারাজীবন কষ্টের মধ্যে অপেক্ষা করে যেতে হবে।
এখনকার পড়াশোনা এতটা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সবাই চায় তার সন্তান সবার চেয়ে ভালো করুক। কিন্ত বাবা-মায়ের এ দাবির পিছনে ছেলে মেয়েরা যে কতটা মানসিক চাপে থাকে সেটা বাবা মা বুঝতেই পারে না। ছেলে মেয়েরা তাদের পরীক্ষার ফলাফল তাদের বাবা মাকে বলতে ভয় পায়, কারণ যদি খারাপ হয় এটি শুনে তারা কিভাবে রিয়েক্ট করবে তা ভেবে। এখনকার সময়ে এমন অনেক দেখা যায় যে, তারা পরিবার সমাজের লোকদের মুখোমুখী কিভাবে হবে তার চেয়ে মৃত্যুর পথটা অতি সহজে বেছে নেয়।
তাদের এ কাজের ফলে পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবারের কী অবস্থা হবে সেটা তারা ভুলে যায়। তাই বাবা-মায়ের উচিৎ সন্তানদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা যেন তারা সব কথা তাদের কাছে এসে বলতে ভয় না পায় এবং ছেলে- মেয়েদের ও উচিৎ বাবা মায়ের সাথে সব শেয়ার করা কারণ দুনিয়ায় বাবা-মা ই তাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আর তারা কখনোই সন্তানের খারাপ চাইবে না।
এছাড়াও অন্যান্য গল্পে উঠে এসেছে অর্থনৈতিক ভাবে টানাপোড়েনের পরেও টিকে থাকা ভালোবাসার সম্পর্ক৷ একজন চিকিৎসকের তার স্ত্রী-সন্তান এবং তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের জীবনের সাথে লড়াই । এসব কিছু জানতেই পড়তে হবে পিওনা আফরোজের নতুন বই “নিহত জ্যোৎস্না”। পাঠক ভিন্ন কিছু পাবেন এটা নিশ্চিত করতে লেখিকা সমকালের সামাজিক অস্থিরতাকে ফুটিয়ে তুলে জীবনকে নতুনভাবে চেনাতে চেয়েছেন।