একজন গল্প কথক কী করেন? একে একে উপন্যাসের কাহিনীগুলো উন্মোচন করেন, নিজেই যখন গল্পের এক চরিত্র তখন নিজের আবেগের প্রকাশটাও হয় নিজের কথায়। কিন্তু একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষ যখন হয়ে ওঠেন উপন্যাসের মূল চরিত্র এবং গল্প কথক তখন বিষয়টা হয়ে ওঠে একেবারেই অন্যরকম কিছু।
হ্যা, এবার বইমেলা ২০২১ এ এরকম এক ভিন্নধর্মী উপন্যাস লিখেছেন প্রিয় লেখিকা নিশাত ইসলাম। তিনি পেশায় একাধারে শিক্ষক, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। তাঁর ঝুলিতে আছে চাঁদপুর গ্রুপ থিয়েটার পরিষদের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার-১৯৯৯। সাহিত্যে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার-২০০৭ প্রদান করে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চিটাগাং। বাংলার সঙ্গীত সংগঠন কতৃক প্রদত্ত সেরা লেখিকা পুরস্কার-২০১৭। ইনডেক্স মিডিয়া স্টার এওয়ার্ডস-২০১৭। কবিতা, গল্প, ভ্রমন কাহিনী ও উপন্যাস, সাহিত্যের সব শাখাতেই আছে তাঁর সমান বিচরণ। তবে উপন্যাসের প্রতি আছে লেখিকার আলাদা ভালো লাগা। যে ভালো লাগা দিনের পর দিন মুগ্ধ করেছে পাঠকদের।
এ বছরে বইমেলায় আমরা নিশাত ইসলামের আরও কিছু নতুন উপন্যাসের সাথে পেতে যাচ্ছি অসাধারন এক সমকালীন উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ‘নিতু ও একজন সুদর্শন যুবক’। কী ভাবছেন? এই নিতু আর সুদর্শনের যুবকের মাঝে কঠিন প্রেম? উপন্যাসের মূল কাহিনী নিশ্চয়ই নিতু ও ওই সুদর্শন যুবক নিয়েই এগিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা হল পুরোপুরি উল্টো। পুরো উপন্যাস জুড়ে ছিল নিতু এবং তার বডিগার্ড জামাল উদ্দিন!
তবে ভালোবাসা এখানেও আছে। একটু ভিন্নরূপে। এখানে ভালোবাসার প্রকাশটা আর সব স্বাভাবিক যুগলদের মত নয়।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে একটি প্রাইভেট হসপিটাল থেকে। নিতু এবং তার বডিগার্ড জামাল উদ্দিন প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না তাদেরকে কেন এখানে আনা হয়েছে। জামাল উদ্দিন আবার নিতুকে স্যার বলে সম্বোধন করে। নিজেদের মানসিক রোগী হিসেবে কিছুতেই মানতে রাজি নয় ওরা। তাই দুজনেই নিজেদের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে প্রমান করতে চায়। বিশেষ করে ডাক্তারের সামনে দুজনে খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। নিতু কিছুটা সফল হলেও জামাল উদ্দিনের একটু পর পর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। নার্সগুলো খুব বিরক্ত করছে। এদিকে ডাক্তারের কাছে নিজেদের সুস্থতা জাহির করতে গিয়ে আরো ফেঁসে গেলো। নিতুকে ডাক্তার তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। আর ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করায় জামাল উদ্দিন উল্টোপাল্টা কিছু নম্বর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। অগত্যা যা হবার তাই হল। ডাক্তার ওদের মানসিক রোগী হিসেবে শনাক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন মেন্টাল হসপিটালে।
নিতু ও জামাল উদ্দিনকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা এখনো প্ল্যান করে যাচ্ছে কিভাবে পালানো যায়। যদিও একটু পরেই দুজনকে আলাদা করে দেয়া হল। জামাল উদ্দিন কী করছে কে জানে। তবে নিতু এক রকম মেনেই নিয়েছে। তবে হসপিটালে গিয়ে প্রথমে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হল। হঠাৎ চোখ মেলেই দেখে সবাই মুখের সামনে এসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স এসে এদের সবাইকে যার যার বেডে নিয়ে গেল। নিতু ভালো করে চারপাশটা দেখে নেয়। গুনে গুনে দশটা বেড। একেক বেডে একেক বয়সি রোগী। নিতু ঘরটা আস্তে আস্তে ঘুরে দেখছে।
প্রথম বেডে একজন মধ্য বয়স্ক খালা। নিজের মাথা নিয়ে সে খুব দুশ্চিন্তায় আছে। ওটা নাকি বাড়িতে রেখে এসেছে। কথোপকথনে বোঝা গেল বাড়িতে ছেলে, ছেলের বউ সকলেই আছে। পূত্র বধুর সাথে মনোমালিন্য ছিল দীর্ঘদিনের। তারপর একটা সময় সব কিছু কেমন শেষ হয়ে গেল। যদিও কেন, কিসের জন্য এতকিছু, সে সব জানা গেল না। তবে এটুকু শুনেই নিতু চলে গেল পরের বেডে।
এই বেডে অল্প বয়সি একটা মেয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। মনটা বেশ ফুরফুরে বোঝা যাচ্ছে। রাতে নাকি তার প্রেমিক আসবে দেখা করতে। ওষুধ খেতে চাচ্ছিলো না। পরে নার্স বুঝিয়ে ওষুধ দিলো। বলল তার প্রেমিক বলেছে ওষুধ খেতে। তাহলেই সে দেখা করতে আসবে। ওমনি মেয়েটি লক্ষী মেয়ের মত ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এর পরেরজন বেশ মারকুটে। তার ধারণা সবাই তাকে মেরে ফেলার জন্যেই আসে। হাতে ধারালো ছুড়ি থাকবে। কথা শুনে বোঝা গেলে কেউ তার সহায় সম্পত্তি জালিয়াতি করে দখল করে নিয়েছে। তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে প্রতিনিয়ত।

এরই মধ্যে নার্সের কাছে কঠিন বকা খেয়ে নিতু চলে গেল নিজের বেডে। দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে। অন্যদের হাত মুখ ধোয়ার তাড়া না থাকলেও নিতু ওয়াশরুমে গেল। এসে দেখে খাবার নেই। নিশ্চয়ই কেউ সাবার করে দিয়েছে!
একটু পরে এলো একজন মহিলা। তিনিও পেশেন্ট। বলল মজা করে নিতুর খাবার লুকিয়েছে। তারপর কিছু ছন্নছাড়া কথা বলে। কুকুরগুলো খুব জ্বালিয়েছে, সব খেয়ে নেবে। নিতুকেও কুকুরগুলোর কাছে থেকে সাবধানে থাকতে বলল। তাকেও নাকি ছেড়ে দেবে না। ঠিক ছিড়ে খেতে আসবে।
এদের কথা নিতু সবটা বুঝে উঠতে পারেনা। বেশিরভাগ কথা তাঁর মনেই থাকেনা। তবে পাঠকের মন কাঁদাবে। একেকজন মানুষ কী ভয়ঙ্কর মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যায়, তাদের রোগী হয়ে বেঁচে থাকার পেছনে আছে হাজারও গল্প, আছে কত শত নির্মম কষ্টগাথা।
এবার আসি ডাক্তারের গল্পে। সেই যে প্রথমে যে ডাক্তার ওদের চেক আপ করে মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়েছিল সেই ডাক্তার। প্রথমে ওরা ভেবেছিল হয়তো বয়স্ক কেউ হবে। কিন্তু না রীতিমত সুদর্শন যুবক।
ওরা দুজন যখন মেন্টাল হসপিটাল থেকে পালিয়ে যায়। তখনও নিতুর দেখা হয়েছিল ডাক্তারের সাথে। তবে বুঝতে পারেনি ছেলেটি কে ছিল। ছেলেটির নাম ছিল মেঘ। আবার যখন ছিনতাইকারী মামুর সাথে নিতু ও জামাল উদ্দিনের দেখা হয় তখনো ছিল ছেলেটি। একটা সময় জামাল উদ্দিন নিজের ফোন উদ্ধারের তাগিদে দুজন মিলে গিয়েছিল ছেলেটির বাড়িতে। সরাসরি ঢুকতে পারেনি যদিও। তবে পাইপ বেয়ে জানালা দিয়ে ঠিক ঢুকেছিল। তবুও সেই ছেলেটি নিতুকে যত্ন করে ভাত খাইয়েছিল। একটা সময় নিতুরা যখন ফুটপাথে থেকেছিল। রাস্তার ওসব মেয়ে ভেবে রিকশাওয়ালা টাকা দিয়ে নিতুকে ডাকছিল গোপনে তখনও ছায়ার মত ছিল সেই ডাক্তার ছেলেটি।
রকমারিতে সমকালীন উপন্যাসের বইসমূহ দেখুন
নিতুর ভুলো মন ছেলেটিকে চেনে না। জানতেও চায়না হয়তো। কিন্তু মেঘ ছায়ার মত নিতুর সাথে থাকে। নিতুর অজান্তেই আগলে রাখে সারাক্ষণ। এই ভালোবাসার জন্ম কোথায় জানা যায়না উপন্যাসের কোথাও। তবে অনুভব করা যায় গাঢ় প্রেমের অনুভূতি, গভীর ভালোবাসার উপলব্ধি।
বার বার হসপিটাল থেকে পালিয়ে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, নানান কাণ্ড ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত নিতু কোথায় আশ্রয় খুঁজে পায়? সে কি তার বাবার কাছে ফিরতে পারে? মেঘের সাথে নিতুর এই নামহীন সম্পর্কেরই বা নাম কী?
এসব কিছু জানতেই পড়তে হবে নিশাত ইসলামের নতুন বই ‘নিতু ও একজন সুদর্শন যুবক’। পাঠক ভিন্ন স্বাদের কিছু পাবেন নিশ্চিত। লেখিকার অন্যান্য লেখার মত আবেগ আর কষ্টের সংমিশ্রন তো থাকবেই সেই সাথে অনেকটা জুড়ে থাকবে রম্য রসিকতা। সব মিলিয়ে আয়েশ করে পড়ার মত একটি বই।