ড্যান ব্রাউন এর “দ্য লস্ট সিম্বল,দ্য ভিঞ্চিকোড, উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল এর দ্য লাস্ট মুঘল,দ্য হোয়াইট মুঘল পড়ার পর ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সবসময় প্রত্যাশা ছিল উপমহাদেশের তথা আমাদের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো নিয়ে আমাদেরই কেউ উপন্যাস লিখুক। হুমায়ুন আহমেদ এর মধ্যাহ্ন, বাদশাহ নামদার পড়ে সেই অতৃপ্তি অনেকটা মিটেছে।
লেখক জয়দীপ দে যখন উপন্যাসের লেখার শুরুর দিকে ছোট ছোট স্টাটাসে পলাশী, সিরাজ এবং অন্যান্য চরিত্র নিয়ে লিখতেন তখন মাঝে মধ্যেই সেখানে দারুণ তর্ক হত। পলাশীর প্রচলিত কাহিনী, লৌকিক প্রচারে যারা ইতিহাস শুনেছেন তারা প্রায়ই ধাক্কা খেতেন। আমি তখন বেশ মজা পেতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বোদ্ধা প্রফেসর মনজুর আহসান স্যার আমাদের বাধ্য করেছিলেন লাইন বাই লাইন
১) রজত কান্ত রায়ের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ
২) সুশীল চৌধুরীর পলাশীর অজানা কাহিনী পড়তে।
মুলত প্রফেসর মনজুর আহসান স্যার এর প্রচেষ্টা এবং ড. আকবর আলী খানকে পাঠ করার মধ্য দিয়েই ইতিহাসের প্রচলিত ঘটনাবলীকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার ক্ষুদ্র চেষ্টা করি।
সে সময় তাই জয়দীপ দে কে বাতাস দিতে কার্পণ্য করিনি।
বইটির প্রতি অনিবার্য আকর্ষণ দুটি কারণে। লেখক আমার ব্যাচমেট, সেটি আমার কাছে গৌণ, মুখ্যত আমার কাছে বরাবরই আকর্ষণীয় চরিত্র সিরাজ এবং ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে পলাশীর প্রতি দুর্নিবার বেদনামাখা ব্যথাতুর ভালবাসা কাসিদের প্রতি আগ্রহকে চূড়ান্ত মাত্রা দিয়েছে।
আজ বইটি হাতে পেলাম, যদিও মাসখানেক আগেই হাতে পাবো আশা করেছিলাম, সেটা হয়নি। লেখক দূর থেকে নমঃনম করেন, কিন্ত তার সাথে সামনাসামনি আমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ৩০/৩৫ সেকেন্ডের মাত্র। তার পূর্বের লেখাগুলো বেশ যুতসই হলেও কাসিদের বিভিন্ন অংশবিশেষ আলোচনা আমাদের আত্মীক যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রায় সময়ই মনে হত প্রণমি তোমায় গুরু, মনে হত তিনি মনজুর আহসান হয়ে আমার সামনে চলে এসেছেন ।

আজ যখন কাসিদ পড়া শুরু করলাম তখন প্রথম ২০ পাতা পড়ে মনে হল হুমায়ুন আহমেদ এর বাদশা নামদার পড়া শুরু করলাম বুঝি। এরপর যত এগুতে লাগলাম, মনে হতে লাগল ইতিহাসের চরিত্রগুলো আমার ডানে বামে বসে গপ্প করছে। এই বুঝি ফিরে গেলাম নিভুনিভু মোঘল দরবারে অথবা পাটনা, মুরশীদাবাদ, কোলকাতা,ঢাকার সরাইখানায় আমি এক কৌতুহলী আগন্তুক।
যখনই সিরাজ এবং পলাশী নিয়ে পড়াতে যাই, তখনই ছাত্রদের জন্য করুণা হয়–বেঁধে দেয়া কাহিনী কপচাতে কপচাতে কত গরল আর উদগিরণ করবে তারা? ভিন্নভাবে তাদের বললে বা বুঝালেও খাতায় সেই একই লেবু কপচায়,কারণ- তাদের পাঠ্যবই যে ছাঁচে ফেলে ইতিহাস লিখেছে ?! এখন তো তাদের বলতে পারব, ‘ব্যাটা, কাসিদ পড়!’
আপনাকে কয়েকটি কারণে কাসিদ কিনতে ও পড়তে বলতে পারি
১) কাসিদ বাংলা এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই সময়ের কথাচিত্র, যা নিয়ে আগে এমন উপন্যাস কেউ লেখননি!
২) প্রথম লিখলেই যে কিনতে হবে তা নয়, লেখক বাহ্যিকভাবে দেখতে যেমন ছিপছিপে, কাসিদও তেমনি হয়েছে। এখানে মেদ জমেনি। ক্ষুরধার লেখনিতে বাস্তবের চরিত্রগুলো কল্পনার চরিত্র হিসেবে দারুণ প্রাণ পেয়েছে। মনে হবে, চরিত্রগুলো আপনার ভাই-ব্রাদার,চাচা, খুড়ো; অথবা চরিত্রগুলো আপনি এঁকেছেন।
৩) বাংলার শশাংক, ঈসাখাঁ, লক্ষণসেন বা কোন পাল রাজা কে ভবিষ্যতে রহস্যময়, টানটান উত্তেজনার উপন্যাসে দেখা যাবে, কাসিদ পড়লে সে সম্ভাবনা আপনি খুঁজে পাবেন।
৪) কাসিদ আপনার মনে ভিন্ন চিন্তার উদ্রেক করবে, বার বার মনে হবে আপনি চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলছেন; হয়ত কখনো ঘষেটি বেগমকে, কখনোবা সিরাজকে এটা-সেটা না করতে নিষেধ করছেন,বাধা দিচ্ছেন ।
৫) সবশেষে মনে হবে নাদির শাহর দরবার থেকে শুরু করে পলাশীর আম্রকানন পর্যন্ত আপনিই কাসিদ। আপনি বয়ে এনেছেন সেই বার্তা; বাংলার অমোঘ নিয়তির সেই পরাজয় সংবাদ, যা পুরো সময় জুড়ে আপনি বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন।
#অবশ্যপাঠ্য উপন্যাস
#আপনার জন্য চিন্তা ও যুক্তির দুয়ার খুলে দিবে
#এনিয়ে যেকোন বিতর্কে আপনাকে স্বাগতম
রেটিং ১০ এ ৮
কাসিদ
লেখক জয়দীপ দে
দেশ পাবলিকেশন্স
জয়দীপ দে এর সকল বই পেতে
‘কাসিদ’ বইটি সম্পর্কে লিখেছেন-