বছর চারেক আগের কথা। বুঁদ হয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ পড়ছিলাম। বাদশাহ নামদার বইয়ের আলোচ্য আরেক হুমায়ুন। সে হুমায়ুনকে আমরা খুঁজে পাই ইতিহাসের পাতায়৷ মোগল সম্রাট হুমায়ুন। কিন্তু বইটি পড়ার সময় ঠিক ইতিহাসের হুমায়ুনের সাথে গল্পের হুমায়ুনকে মেলাতে পারছিলাম না। ইতিহাসের বিরক্তিকর পাঠ হুমায়ূন আহমেদের কলমে এসে মৌচাকে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখান থেকে মধু ঝরে ঝরে পড়ছে।
বেশ লালায়িত জিহ্বায় সে পাঠ চেটেপুটে খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে মনে হলো—হুমায়ুন মোগল সম্রাট ঠিক আছে; কিন্তু সে সম্ভবত ‘বাদশাহ নামদার’ না। জীবনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সিংহাসন টিকিয়ে রেখেছেন কেবল। তাতেই যদি তিনি বাদশাহ নামদার হন, তবে যিনি পুরো জাতিকে শূন্য থেকে পূর্ণ করেছেন, মুক্তির দিশা দেখিয়েছেন, অন্তহীন মহা কল্যাণ দান করেছেন, তিনি কী হবেন? তাঁর স্মরণ আসতেই মনে করার চেষ্টা করলাম, তাঁকে নিয়ে বাংলা ভাষায় হুমায়ূনের মধুর ভাণ্ড ‘বাদশাহ নামদার’—এর মতো কোনো উপন্যাস আছে কিনা।
দীর্ঘকাল ভাবার পরও এমন কোনো বইয়ের সন্ধান আমার সচেতন মস্তিষ্ক আমায় দিতে পারল না। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’র কথা মাথায় এসেছে যদিও; তবে বইটি একদিকে উপন্যাস না, অপরদিকে সাধু রীতিতে লেখা। কিন্তু আমার অতীন্দ্রিয় আকাঙ্ক্ষা খুঁজে বেড়াচ্ছিল চলিত রীতির আধুনিক গ্রন্থ।
আমার পাঠের সীমা যেহেতু নিতান্তই সসীম, তাই ভাবলাম তেমন সিরাত থাকলেও থাকতে পারে। খোঁজার উদ্দেশ্যে বইমেলার অলিগলি ঘুরলাম, দীর্ঘদিন স্বনামধন্য লাইব্রেরিগুলোর বুকশেলফ হাতড়ে বেড়ালাম; কিন্তু কোথাও কাঙ্ক্ষিত বইয়ের সন্ধান পেলাম না। পরে জানলাম হুমায়ূন আহমেদ শুরু করেছিলেন বটে; ‘নবীজি’ শিরোনামে অল্প কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছিলেনও; কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। বেশ হতাশ হলাম। সেই হতাশাকে আশায় রূপ দিতে শেষ পর্যন্ত সংকল্প করলাম—নিজেই লিখে ফেলব!

রীতিমতো দুঃসাহস বটে। তখনও অনলাইনে নিয়মিত লিখছিলাম; কিন্তু বই লেখার চিন্তা সেই প্রথম৷ সেই চিন্তা আবার এমন একজনকে নিয়ে, যাঁর ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—“আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের রহমত-রূপে প্রেরণ করেছি।” অতএব, তাঁকে যতই জানি না কেন, আরও জানা প্রয়োজন। যতই পড়ি না কেন, আরও পড়া প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, কোনো বিষয়ে লিখতে গেলে সে বিষয়ে যতটুকু লেখা হবে, তার অন্তত দশগুণ পড়াশোনা প্রয়োজন।
সেই প্রয়োজন বোধ থেকে পড়াশোনা শুরু। একে একে সিরাতের ঐতিহাসিক মৌলিক গ্রন্থ ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা, খাসায়িসুল কুবরা, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আর রাহিকুল মাখতুম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চৌদ্দ খণ্ডের সিরাত বিশ্বকোষ-সহ অনেকগুলো প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ পড়ে শেষ করলাম। ততদিনে প্রায় এক বছর পার হয়ে গেছে। শুরুটা কীভাবে করা যায় ভাবতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে ভাবনার দিবানিদ্রা পেয়ে বসল। শুরু আর হচ্ছিল না। এক নিরালা নিশীথে হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল—
জেগে ওঠ্ তুই রে ভোরের পাখি, নিশি-প্রভাতের কবি!
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি।
আমি কবি নই; তবুও অদৃশ্যের এই ডাক আমার সমগ্র দেহ-মনে অদ্ভুত শীতল পরশ বুলিয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে লেখা শুরু করলাম— গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুর। গাছের ছায়ায় বসেছিল বালক। সামনে বিস্তৃত প্রান্তর…
ফ্লাশব্যাক দিয়ে শুরু। বারো বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে ভ্রমণকালে সিরিয়ার বাণিজ্য পথে পাদরি বহিরার সাথে নবীজির ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে। অতঃপর পেছনের গল্পে ফিরে এসে তাঁর সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে দুনিয়ায় শুভাগমন। এরপর ক্রমান্বয়ে আগাচ্ছিল গল্প। লিখতে লিখতে একাধারে ছয় পর্ব শেষ। একাধারে বলতে প্রায় দুমাস লেগেছে এই ছয় পর্বে। যেহেতু গঠন আঙ্গিকে সাধারণ জীবনীর মতো নয়, সম্পূর্ণ উপন্যাসের ধাঁচ, তাই মূল সময়টা যাচ্ছিল পরিকল্পনায়। লেখালিখিতে যেটা সাধারণ ঘটনা।
সেই ঘটনার ফাঁকে চীন ঘটাল অচেনা কাণ্ড। একুশ শতাব্দী দেখল তার প্রথম মহামারি। করোনা কোনো করুণা ছাড়াই মানুষ মারা শুরু করল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পুরো বিশ্বে। আতঙ্কে নিশ্বাস যেখানে বন্ধ হবার যোগাড়, সেখানে কলম চলে আর কোন শক্তিতে? কলমও বন্ধ হলো করোনার করুণ ছোবলে।
দেড় বছর কেটে গেল সেই বিরতিতে। নতুন করে শুরু করা হয়ে উঠছিল না। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষ ফিরছে স্বাভাবিক জীবনে। মস্তিষ্কের পোকা আমায় আবারও টোকা মারা শুরু করল। কিন্তু শুরু করার হৃদমটা পাচ্ছিলাম না ঠিকঠাক। পূর্বের লেখা ছয় পর্ব এক এক করে পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে। সাড়া পড়ল ব্যাপক। প্রচুর পাঠকের অনুরোধ পেলাম—ভাই, এটাকে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনীতে রূপ দেন। পাঠকের আগ্রহ দেখে আশাবাদী হলাম৷ সবার যখন লকডাউন ছেড়ে মুক্ত হবার তাড়া, আমি তখন নিজেকে বন্দী করলাম ‘প্রশংসিত’র ধ্যানে-জ্ঞানে। নিজেকে পুরোপুরি ঢুকিয়ে নিলাম অন্য এক জগতে। সে জগতে রাতে নিদ্রা নাই। খাওয়ার কোনো সময়জ্ঞান নাই। মায়ের দেয়া লোভনীয় গরম চা কখন শরবতে রূপ নেয়—খবর থাকে না। পাঠ, পরিকল্পনা আর লেখা—এই তিনে মিলে অতিবাহিত হতে লাগল দিন। একুশ সালের নভেম্বরে এসে থামল সে সাধনযজ্ঞ। ৬ পর্বে থেমে যাওয়া চাকা পৌঁছে গেল ৬৩ পর্বে। রূপ পেল একটি পূর্ণাঙ্গ বই। নাম ধারণ করল ‘প্রশংসিত’।
উপন্যাস পড়তে পড়তে যে আকাঙ্ক্ষা চার বছর আগে আমায় তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পেরে মহাপরিকল্পনাকারীর দরবারে অজস্র কৃতজ্ঞতা আদায় করছি। সমস্ত প্রশংসা তাঁর। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত ক্ষুদ্র আমার মাধ্যমে এই দুঃসাধ্য সাধন হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। সাথে সাথে অজস্র দরুদের নজরানা প্রেমময় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাক চরণে নিবেদন করছি, যিনি এই বইয়ের মূল উপজীব্য। যাঁর দয়ার নজর না হলে এই বই লিখে সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না বলে মনে করি। সেই সাথে এই দীর্ঘ কর্মযজ্ঞে যাঁরা আমায় নানানভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতিও বেশুমার কৃতজ্ঞতা।
পুরো বইটি সাজিয়েছি উপন্যাস আকারে। উপন্যাস হয়ে উঠতে পেরেছে কি না সে বিচার-বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব অবশ্য বিশারদদের হাতে৷ আমি কেবল এটুকু বলতে পারি, একটি উপন্যাসে যা যা যোগ্যতা থাকা দরকার, সবটার সন্নিবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছি। গল্পের প্রয়োজনে আশ্রয় নিয়েছি নাটকীয়তার। করেছি সংলাপের ব্যবহার। তৈরি করেছি চরিত্র। মাঝে মাঝে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে পরপর এনে শিকলের মতো গেঁথে দিয়েছি ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। এ-সব করেছি অবশ্য মূল বর্ণনার সত্যতা অক্ষুণ্ন রেখেই। উপন্যাস নানান উপমা, উদাহরণ, ব্যঞ্জনার অপূর্ব সমাহার। তবে এসবের জন্য আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। যাঁর জীবনের পরতে পরতে এত ব্যঞ্জনা, মাধুরিমা, তাঁর জীবন লিখতে খুব কষ্ট করে কল্পনার জগতে হাতড়ে বেড়াতে হয়নি। বাস্তব যেখানে এত অকল্পনীয়, সেখানে কল্পনার জগতে চষে বেড়ানোর অর্থই বা কী? তা ছাড়া তিনি এত অনুপম যে, তাঁকে নিয়ে লিখতে উমপা খুঁজে হয়রান হতে হয়নি। তিনি এত প্রশংসিত যে, তাঁর প্রশংসার জন্য অতিমাত্রিক কিছু ভাবতে হয়নি। শেখ সাদীর ভাষ্যে—
“বালাগাল উলা বিকামালিহি–
চূড়ান্ত চূড়ায় তিনি নিজ মহিমায়।”
অতএব, তাঁর জীবনকে যত উৎকৃষ্ট পন্থায় বর্ণনা করি না কেন, তাঁর মহিমার তুলনায় তা নিতান্তই তুচ্ছ। কারণ- তাঁকে উপমায় বাঁধা সম্ভব না, তিনি অনুপম। উদাহরণে ফেলা কঠিন, তিনিই যুগ-যুগান্তরের উদাহরণ। প্রশংসা করে শেষ করা সম্ভব না, তিনি মুহাম্মদ—চির প্রশংসিত। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। দরুদ লিখতে গিয়ে মনে পড়ল ভেতরের বর্ণনায় অসংখ্য জায়গায় দরুদ লেখা হয়নি। সুবোধ পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, সেসব জায়গায় বর্ণনার চাহিদার কারণে লেখা হয়নি। কোথাও ছেদ পড়ার সম্ভাবনা আর কোথাও বিরুদ্ধবাদীদের সম্বোধন—এই দুই কারণে স্কিপ করা হয়েছে। তেমনিভাবে সাহাবিদের নামের পরে লেখা হয়নি ‘রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’, যা একজন মুসলমান ভক্তিভরে পাঠ করে থাকেন। তাই ‘মুসলিম’ পাঠকদের সমীপে আরজ—নিজ প্রেমের তাড়নায় নবীজির নামের পর দরুদ ও সাহাবাদের নামের পর ‘রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’ পড়ে নেবেন।
বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানান রীতির অনুসরণ করা হয়েছে৷ তবে কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত বানানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সিরাতে কুরআনের আয়াত আসবে অবশ্যম্ভাবী। তাঁর পুণ্যময় জীবনের পরতে পরতেই যে কুরআনের অবতরণ। বর্ণনার চাহিদায় কোথাও সরাসরি আয়াতের বাংলা উচ্চারণ এসেছে, আর কোথাও কেবলই ভাবানুবাদ উল্লিখিত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও করা হয়েছে কাব্যানুবাদ। রেফারেন্স হিসেবে সুরা ও আয়াত নাম্বার লেখা হয়েছে ফুটনোটে। এ ছাড়া যতটা সম্ভব ফুটনোটের ব্যবহার এড়িয়ে গিয়েছি৷ সিরাত বর্ণনায় আসেনি রেফারেন্স। যেহেতু উপন্যাস আকারে রচিত, তাই এখানে রেফারেন্সের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ নেই। তবে রেফারেন্সপ্রিয় পাঠকের উদগ্রীব হবার প্রয়োজন নেই, যে কোনো বর্ণনার সত্যতা নিশ্চিত করতে লেখক সর্বদা প্রস্তুত।
যেসব বর্ণনা বইতে এসেছে, সে-সবের মূল বর্ণনা সম্বলিত একগাদা পুস্তক লেখকের নিকট মওজুদ রয়েছে আলহামদুলিল্লাহ! পাঠ্কে হৃদয়গ্রাহী ও রোমাঞ্চকর করে তুলতে করা হয়েছে কবিতার ব্যবহার। সিরাতের বিভিন্ন মৌলিক গ্রন্থ থেকে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী রচিত কবিতার সহজবোধ্য কাব্যানুবাদ করার চেষ্টা করেছি। এনেছি উর্দু-ফারসি কবিতার কাব্যানুবাদ। বইতে বাংলা কবিতার রাজত্ব নজরুলের করায়ত্তে। বই লিখতে লিখতে মনে হয়েছে কবি বহুবছর আগে কেবলই আমার জন্য কিছু কবিতাংশ লিখে গেছেন। এ ছাড়াও এসেছে অন্যান্য কবিদের বিভিন্ন কবিতার খণ্ডাংশ।
বইটি সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা হচ্ছে এটি কোনো রেফারেন্স গ্রন্থ নয়। গতানুগতিক জীবনীও নয়। বরং পাঠক যাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যময় জীবনকে প্রেম নিয়ে উপভোগের সাথে জানতে পারে, সে লক্ষ্যেই উপন্যাসের ধাঁচে লিখিত সংক্ষিপ্ত সিরাত। তাই, বইটি পাঠককে রেফারেন্সের দিকে ছুটোবে না, প্রেমে আবিষ্ট করবে। নবীজিকে আরো ব্যাপকভাবে জানতে আগ্রহী করে তুলবে। তাঁর প্রতি মোহিত হৃদয়কে আরো মোহমায়ায় আচ্ছন্ন করবে। তবে আর দেরি কেন, এখনই ডুকে পড়া যাক তাঁর পুণ্যময় জীবনের ঘটনাপ্রবাহে…
বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন