২০২২-এ শেষ করা প্রথম বই ‘প্রতিদিনের পাথরগুলো।‘ বই প্রি-অর্ডার করা ছিল, ফলে রকমারিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতে পেয়ে গেছি। এবং বইয়ের ৬ টা গল্পের ৪টা অফিসে বসে পড়ে ফেলেছি। বাকি দুটা রাতে বাসায় ফিরে। এর মধ্যে একটা গল্প অবশ্য আগের পড়া ছিল। মোটমাট দুটো বই পড়েছি কাসাফাদ্দৌজা নোমানের, দুটোই গল্পবই। প্রথমটা ছিল সম্ভবত ‘অদ্ভুত তুমিহীনতায় ভুগছি’, যেটার ‘কুচি কুচি করে কাটা শসা’ এবং ‘অজগর’ নামে দুটো গল্পের কথা আমার মনে আছে। এ বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে চারটা গল্প সম্পর্কে বলা যাক প্রথমে—
প্রথম গল্প ‘আলী মনসুর কাঁদছে’। আলী মনসুর নামে একজন নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন আর তার পরিবারকে নিয়ে ক্রাইসিস এবং সেটার সমাধান গল্পের মূল বিষয়বস্তু। পড়তে পড়তে আঁচ করছিলাম ধাক্কাটা কোনদিক থেকে আসবে। লেখক গল্পে দুরকমের সম্ভাবনা তৈরি করেছেন, এবং মজার ব্যাপার হলো, পাঠক হিসেবে আমি মোটামুটি দুটোর সঙ্গেই প্রায় আপোস করে ফেলেছিলাম। আর সবশেষে দেখলাম যে, তিনি প্রতিটি সম্ভাবনাকেই নাকচ করে দিয়ে একটা তৃতীয় সম্ভাবনায় গিয়ে পরিসমাপ্তি টানলেন। এইদিক থেকে গল্পটা আনপ্রেডিক্টেবল ছিল। হ্যাপি এন্ডিং ঘরানার হৃদয়স্পর্শী গল্প। পড়তে ভালো লেগেছে।
দ্বিতীয় গল্প, ‘সত্যের কাছাকাছি’। এই গল্পটার কথাই বলছিলাম যে, আগে পড়েছি। কিন্তু আগের পড়া হলেও গল্পটা পুনরায় পড়তেও খারাপ লাগেনি। দারুণ পাঞ্চ আর লেখকের স্বভাবসুলভ হিউমারসমৃদ্ধ রূপক গল্প ‘সত্যের কাছাকাছি’, নামের মধ্যেই যার ইঙ্গিত আছে কিছুটা। একজন জনপ্রিয় লেখকের মৃত্যুর খবরে শহরে শোক ঘুরে বেড়াচ্ছে বিষণ্ণ কোনো ফুলের ঘ্রাণের মতো, অথচ কেউ জানে না কিভাবে লেখক মারা গেলেন। কেউ বলছে হার্ট এ্যাটাক, কেউ বলছে খুন, কেউ ভাবছে আত্মহত্যা। আসলে লেখক যে কিভাবে মারা গেলেন, তা জানেন কেবল গল্পকথক। আর সেই মৃত্যু এমন মৃত্যু তাতে আপনি হাসবেন নাকি বিষণ্ণ হবেন, সেই দায় নিতান্তই আপনার। আর এর রূপকার্থও বুঝতে পারা খুব একটা কঠিন নয়।
চতুর্থ গল্প ‘মালা’। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা কোনো নারীর নাম। না, তা তো নয়। গ্রামের এক বিধবা নারীর কাছে প্রায় অগুরুত্বপূর্ণ এক প্রেমপ্রার্থী যুবককে এলাকাবাসী জুতার মালা পরানোর কথা ভাবছে। অভিযোগ গুরুতর। সে ঐ বিধবাকে উত্যক্ত করছে। এই নিয়ে জনতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গল্প শেষ হওয়ার পর কিছু প্রশ্নের উদয় হয় মনে, আরে, আসলে এই দুজনে সম্পর্ক কী! আগে থেকেই এমন ছিল? নাকি হঠাৎ ইউটার্ন নিল? নাকি কোনো ক্ষোভ ছিল বিধবার মনে? সব প্রশ্নের উত্তর গল্পে থাকতে হবে এমন কথা নেই। এটুকু পাঠকের কল্পনার জন্য ঝুলিয়ে রেখে গল্পটাকে সার্থক করে তুলেছেন নোমান। গল্পের চরিত্র, ডায়লগ এবং সামান্য একটু জায়গার মধ্যে মব সাইকোলজির চমৎকার প্রকাশ ও পরিবর্তন উপভোগ করেছি। এটাও একটা হ্যাপি এন্ডিং ধরনের গল্প, যেখানে রূঢ়তাকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত শুভবোধই উপস্থাপিত হয়েছে।
বইয়ের ষষ্ঠ এবং শেষ গল্প ‘মিকদাদ মৃধা পেদ্রো’। নামের মধ্যেই একটা কিছু আছে, যা গল্পটা পড়তে বাধ্য করেছে আমাকে। আচ্ছা, মানুষের নামে কি কুকুরের নাম হয়? কেন হবে না? মানুষ তো মানুষের সঙ্গে মিলিয়েই সব কল্পনা করে। ঝন্টু, মন্টু, রন্টু এইসবই মানুষের নাম, আবার পোষা প্রাণীর নাম হিসেবেও এগুলো সুবিদিত। কিন্তু ধরা যাক, কোথাও গিয়ে দেখলাম তাদের কুকুরের নাম তাশমিন নূর, তাহলে কেমন লাগবে আমার? অথবা যদি হয়ও, তাহলে সমস্যা কী? আমি কে? আর কুকুরইবা কে? আমাদের দুজনের তফাৎ কোথায় কোথায়? আমার মতে, গল্পের থিম, প্লট ও ভাবনার বিস্তার মিলিয়ে এটাই এই বইয়ের সেরা গল্প। গল্পটা শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময় নিয়েছেন নোমান। কিন্তু একবারের জন্যেও কোনো কিছুকেই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি। গল্পটার একদম ভেতরে ঢুকতে পেরেছেন লেখক, এবং সেখান থেকে বের হয়ে এসেছেনও চমৎকারভাবে। যে কারণে গল্পটা অনেক প্রাণময় হয়েছে ও পরিপূর্ণতার অনুভূতি দিয়েছে।
বাকি রইল দুটো গল্প—নামগল্প ‘প্রতিদিনের পাথরগুলো’ ও ‘কয়েক ধরনের সংকট’। গল্পগুলোতে ঘুরেফিরে এসেছে নাগরিক ও যাপিতজীবনের কড়চা ও আপাত নিস্পৃহ হতাশাবিলাস, এরকম লেখা আগেও পড়েছি বলে মনে হয়। দুটো গল্পকেই আদতে গল্প বলে মনে হয়নি, বরং মুক্তগদ্যের সমন্বয় মনে হয়েছে। গল্পগুলোতে কাব্যময়তা আছে, জীবনবাদ আছে, কিন্তু গল্প অনুপস্থিত (আবার যেগুলোকে গল্প বলব, সেগুলোতে কাব্যময়তার জ্বর-জারি নেই)। তবে পড়তে খারাপ লাগেনি নিঃসন্দেহে।
নোমানের লেখায় ভাষার কারিকুরি তেমন নেই। আমাদের দেশে সাহিত্যমান অর্জনের জন্য কাব্যময়তা এবং ভাষার কারিকুরিকে খুব বড় করে দেখানো হয়। এতে করে যারা বর্ণনা এবং ভাষার ব্যাপারে খুব মনোযোগী থাকেন, প্রায়শই তাদের লেখার অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে পাঠক তেমন মাথা ঘামান না। এমন অনেককেই দেখেছি বলতে- “আপনার গদ্যের বর্ণনা সুন্দর।” ঐ পর্যন্তই রিভিউ। যেন আর কিছু নেই সেই গদ্যে। কিন্তু এই ব্যাপারে যারা নিস্পৃহ থাকেন, অথবা বলা যায় সহজ-সাধারণ গদ্যে যারা গল্পটা বলে যান, তাদের লেখার মূলভাবে পাঠক সহজেই পৌঁছে যেতে পারে, কিংবা বলা যায়, “আপনার বর্ণনা সুন্দর” রিভিউয়ের পেছনে সেটা চাপা পড়ে যায় না। তাই এই ভাষার কারিকুরি না থাকাটা এক দিক থেকে তার লেখার প্লাস পয়েন্ট । অথবা এটাও হতে পারে, তিনি নিজেই যে গল্পগুলোর ব্যাপারে বেশি সিরিয়াস ছিলেন, সেগুলোতে সচেতনভাবে কাব্যময়তা পরিহার করেছেন, যেহেতু ওপরে বলেছি যে, ‘প্রতিদিনের পাথরগুলো’ এবং ‘কয়েক ধরনের সংকট’ গল্পে কাব্যভাব উপস্থিত।
যাই হোক, একজন লেখককে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে তার একটা বা দুটো বই পড়ে সেটা করা যায় না। ক্রমান্বয়ে পড়তে হয়। কিন্তু কাসাফাদ্দৌজা নোমানের প্রথম দিকের গল্পগুলোর সাপেক্ষে বলতে পারি, তার লেখার ধরন আকাশ-পাতাল বদলেছে। আমরা তাহলে আশাবাদী হতে পারি।
আরও পড়ুন- কত নদী সরোবরে জ্বলে কত দীপাবলি…
প্রতিদিনের পাথরগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে
কাসাফাদ্দৌজা নোমানের অন্যান্য বই দেখতে ক্লিক করুন