সাদাত হাসান মান্টো, লেখা যার ছুরির ফলার মতো বিদ্ধ করে বিদগ্ধ পাঠকের মন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের ভয়াবহতা উঠে এসেছে তার গা হিম করা লেখালেখিতে। লেখার জন্য জেল খেটেছেন, হয়েছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।ক্ষণজন্মা এই সাহিত্যিক তাই জন্মের শতবর্ষ পরেও সমানভাবে আলোচিত।
‘৪৭ এর দেশভাগ, উপমহাদেশের জনতার যাপিত জীবনের এক বিরাট আখ্যান। ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে একখানা মানচিত্র চিরে দুখানা হলো। সপ্ত পুরুষের ভিটা ছেড়ে ওইদিনই পাকিস্তান থেকে ভারত কিংবা ভারত থেকে পাকিস্তানে নির্বাসিত হলো প্রায় ২ কোটি জনতা। মুম্বাই ছেড়ে লাহোরের বাসিন্দা হলেন মান্টো। দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে লিখলেন একের পর এক গল্প। দেশভাগকে মান্টো দেখেছেন তার চশমার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে, অতি সযত্নে। ‘সিয়াহ হাসিয়ে’ যার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘কালো সীমানা’, এই সংকলনে অতি ক্ষুদ্র ৪২ টি গল্পের মাধ্যমে তিনি পাঠকের শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়েছেন শীতল রক্তের স্রোত। এসব গল্পে তিনি মেলোড্রামাটিক স্টাইলে লিখে গেছেন দেশভাগের গল্প। আদতে রাজনৈতিক ঘটনা হলেও তা অতি সাধারণ ব্যাক্তি জীবনকেও অনেকখানি প্রভাবিত করেছে।
দেশভাগ পরবর্তী সাহিত্যে দেশভাগ অনেকখানি জায়গা দখল করে থাকলেও মান্টোর দেখার চোখ ছিলো সকলের চেয়ে আলাদা। তিনি দেশভাগের স্বপ্নের জালিকার পেছনের যে কদাকার অন্ধকার, তা অতি সযত্নে তুলে এনেছেন লেখার পাতায়। তার মতো এতো প্রবলভাবে বোধকরি আজও কোনো সাহিত্যিক দেশভাগ নিয়ে লেখেননি। মান্টো চিৎকার করে বলতে চেয়েছেন,
“ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়
লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়”
(এই স্বাধীনতা ব্যার্থ
লাখো মানুষ ক্ষুধার্ত)
‘৭০ এর দশকে এই বাংলার আবুল হাসান যেমন বলেছিলেন “পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা ক্ষুধা “, ঠিক তেমনি তার কয়েক দশক আগেই মান্টো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এই মিথ্যে দিবাস্বপ্ন আমাদের ক্ষুধাটাও মেটাতে পারলো না, হায় আজাদী!
শৈশবে দেখা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা গল্প ”তামাশা’ প্রকাশিত হয়। তিনি কাজ করতেন বিভিন্ন সংবাদপত্রে, নিয়মিত ছাপা হতো তার লেখা। রাখঢাক না রাখা সেসব লেখা অনেকবারই হয়েছে কঠোর সমালোচনার বলি। এমনকি দাঁড়াতে হয়েছে কোর্টেও। মান্টোর সৃষ্টিকর্মের চরিত্র ছিলেন দেহপসারিনীরাও। এজন্য তাকে পর্ণোগ্রাফ লেখক বলেও তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সমাজের কদর্য রূপ তুলে আনায় প্রতিক্রিয়াশীল লেখক হিসেবে কটাক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন তৎকালীন লেখক সমাজের কাছেও। অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হবার পর দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন,
“আপনি যদি আমার লেখা গ্রহণ করতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে, যে সমাজে আপনি বসবাস করছেন, সেটিও অগ্রহণযোগ্য। সমাজের বস্ত্রহরণ করবার আমি কে, যখন কিনা সে নিজেই নগ্ন?”
পতিতাবৃত্তি, ক্ষমতার ঘৃণ্য লড়াই, দারিদ্র্য কিংবা যৌনতা সবই ছিলো তার লেখার উপজীব্য। জীবনকে খোলা চোখে দেখেছিলেন তিনি। এজন্য অবশ্য কম যাতনাও তাকে বয়ে বেড়াতে হয়নি আজীবন। মান্টো লিখেছেন মানব মননের নানা দিক, মানুষের ভেতরকার দ্বন্দ্ব, সমাজবাস্তবতা নিয়ে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলে গেছেন,
” একজন লেখক তখনই কলম তুলে নেন যখন তার চেতনায় আঘাত হানা হয়।”
মূলত ছোটগল্পকার হিসেবেই পরিচিত মান্টো ছিলেন অনুবাদক এবং নাট্যকারও। লিখেছেন সিনেমার স্ক্রিপ্ট। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে : মান্টোর গল্প, আও, জানাযা, ধুয়া, মান্টোর নাটকসমূহ, কালো সীমানা, ঠান্ডা গোশত, স্যাম চাচার কাছে চিঠি , আখেরি স্যালুট প্রভৃতি। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘টোবাটেক সিং’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। তিনি ছিলেন উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, মির্জা গালিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। গালিবকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টও তাঁরই লেখা।
প্রায় শতবর্ষ পরেও চর্চিত মান্টোর ব্যাক্তিগত জীবনও কম আলোচিত নয়। বিশেষত লেখক ও চিত্রপরিচালক ইসমাত চুঘতাইয়ের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা নিয়ে রয়েছে নানান জল্পনা-কল্পনা। ইসমাত এবং মান্টো দুজনই ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। আজীবন তারা ছিলেন একে অপরের সৃষ্টিকর্মের প্রেরণা।
মান্টো মূলত কাশ্মীরি পরিবারের সন্তান। শেকড়ভোলা মানুষ নন তিনি, তাইতো তার কথনে তিনি বারবার বলেছেন কাশ্মীরের কথা। এমনকি জওহরলাল নেহেরুর কাছে লেখা চিঠিতেও তুলে এনেছেন কাশ্মীরের প্রসঙ্গ। ১৯১২ সালের ১১ই মে বর্তমানে পাকিস্তানের লুধিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জীবন অতিবাহিত করেন আলীগড় ,মুম্বাই, দিল্লী এবং সর্বশেষ লাহোরে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে এই কালোত্তীর্ণ লেখক লাহোরেই মৃতুবরণ করেন।
মান্টো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতির কদর্য রূপ, দেশভাগের ভয়াবহতা আর অসহায়ের কান্না। তার কলম ছিলো সময়ের চেয়ে এগিয়ে। জন্মের শতবর্ষ পরও তাই তিনি পঠিত, আলোচিত; সমানভাবে নয়, বরঞ্চ আরও প্রবলভাবে। তাঁকে নিয়ে বানানো হয়েছে সিনেমা, লেখা হয়েছে উপন্যাস , কথা হচ্ছে সব প্ল্যাটফর্মে। কৌতূহলী পাঠক চাইলে নেটফ্লিক্সে দেখে নিতে পারেন মান্টো চলচ্চিত্রটি, যার নাম ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। বাংলা ভাষায়ও এখন মান্টোকে নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে , অনূদিত হচ্ছে মান্টোর বই। রবিশংকর বলের লেখা ‘দোজখনামা’ বইটি এক্ষেত্রে আলাদা প্রসংশার দাবীদার । উক্ত উপন্যাসে তিনি কবরবাসী দুই মহারথী মির্জা গালিব ও সাদাত হাসান মান্টোর কাল্পনিক কথোপকথনে তুলে ধরেছেন উভয়ের জীবনের প্রায় সবকটি অধ্যায়। বইটি তাই অবশ্যপাঠ্যই বলা চলে। ‘সিয়াহ হাসিয়ে’ নামক গল্পগ্রন্থটি জাভেদ হুসেন অনুবাদ করেছেন ‘কালো সীমানা’ নামে । উক্ত অনুবাদটিও সুখপাঠ্য। ঠান্ডা গোশতের অনুবাদ করেছেন অনুবাদক কাউসার মাহমুদ । এছাড়াও পত্রপত্রিকায় মান্টোকে নিয়ে হচ্ছে নিয়মিত চর্চা, আয়োজিত হচ্ছে আলোচনা অনুষ্ঠান।
একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী মুখোমুখি হচ্ছে সব নতুন সংকটের । এতসব পরিবর্তনের পরও সাদাত হাসান মান্টোর লেখা আজও প্রাসঙ্গিক । মান্টোর কথায় ফিরে গিয়েই তাই বলতে হয়, “And it is also possible that Sadat Hasan dies, but Manto remains alive.”
আরও পড়ুন– সাদাত হাসান মান্টো , একজন অন্ধকার সময়ের গল্পকার
সাদাত হাসান মান্টোর সকল বই দেখুন