শেখ কামাল; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে হিসেবে এক নামে তাঁকে চেনেন সবাই। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়, আর ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন তিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর ঘরে জন্মানোটাই একমাত্র কৃতিত্ব নয় শেখ কামালের। তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অত্যন্ত প্রখ্যাত একজন ব্যক্তিত্ব। এদেশে খেলাধুলার প্রসার ঘটাতে যে ক’জন ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য, শেখ কামাল তাদের মাঝে অন্যতম। ক্রীড়াঙ্গনে ধূমকেতুর মতো উজ্জ্বলরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। তবে ধূমকেতু যেমন বেশিক্ষণ থাকে না আকাশে, তেমনই তিনিও অকালেই চলে গিয়েছিলেন আমাদের মধ্য থেকে।
প্রচন্ড সৃষ্টিশীল আর সম্ভাবনাময় এই যুবক বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রযাত্রায় যে ভূমিকা রেখেছেন তা প্রবাদতুল্য। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। দেশে গেরিলা বাহিনীর যে আক্রমণগুলো হয় পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে, তাতে অংশ নেন তিনি। আর যুদ্ধ থেকে ফিরে পিতার দেশ পুনর্গঠনের কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তিনি।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশের অবস্থা তখন খুব শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। বেকারত্বের সমস্যা গ্রাস করে ফেলেছিল দেশের যুবসমাজকে। আর কামাল নিজেও তখন ২৩ বছর বয়সী টগবগে একজন তরুণ। তাই তখন তরুণ সমাজকে তাঁর চেয়ে ভালো কে বুঝবে! তিনি তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরামর্শ দেন ক্রীড়া ও সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহ দিতে, যাতে তরুণ সমাজ এই দিকগুলোতে আকৃষ্ট হয় এবং ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতেই পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করে। ফলে তাদের বিপথগামীতা সহজে রোধ করা সম্ভব হবে। সেই সময় তিনি নিজেও ক্রীড়া বিষয়ক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে একজন দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের জনক হিসেবে পরিচিতি লাভ করা শেখ কামালের এদেশে ক্রীড়াঙ্গনের প্রসার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা, তা কখনোই অস্বীকার করা সম্ভব নয়৷ তবে বর্তমান সময়ের অনেকের কাছেই তাঁর এসকল ভূমিকা ও অবদানের কথা অজানা। কারণ বিশেষ কোনো তথ্য ও উপাত্ত সংবলিত লিখিত দলিল পাওয়া যায় না এই বিষয়ে। তাই শেখ কামালের এসকল অবদান থেকে যাচ্ছে পর্দার আড়ালেই।
তাই তাঁর বাংলাদেশের ফুটবল, সর্বোপরি সমগ্র ক্রীড়াঙ্গনেই শেখ কামাল যে অবদান রেখেছেন, তা এদেশের মানুষ, বিশেষ করে যুবসমাজের সামনে তুলে আনতে তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে একটি বই। ক্রীড়া বিষয়ে শেখ কামালের নানা কর্মকাণ্ড ও অবদান নিয়ে রচিত এই বইটির নাম ‘শেখ কামাল : ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু’। বইটি রচনা করেছেন বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা। বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বর্তমানে বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ) এর সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। বইটি ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। আর বইটি প্রকাশ করেছে প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘কথাপ্রকাশ‘।

এই বইয়ে শেখ কামালের খেলাধুলার সাথে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। তাঁর নিজস্ব খেলোয়াড়ি জীবন, খেলাধুলায় অবদান ইত্যাদি সব কিছুই পাওয়া যাবে এই বইটিতে। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের ছিলেন শেখ কামাল, সাথে তাঁর ছিলো খেলাধুলার প্রতি অসীম আগ্রহ। কৈশোরে তিনি যখন শাহীন স্কুলে পড়াশোনা করতেন, তখন স্কুলের সব ধরনের খেলার অংশগ্রহণ করতেন। ফুটবল, ক্রিকেট অথবা হকি- কোনোটাই বাদ দিতেন না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এদেশের খেলাধুলায়, বিশেষ করে ফুটবলের ক্ষেত্রে বিপ্লব আনেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এদেশের খেলার মাঠসমূহে আধুনিকায়ন শুরু হয়। আর দেশের ঘরোয়া ফুটবলের জন্য তিনি সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেন, তা হলো দেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে অন্যতম জনপ্রিয় ও সফল ফুটবল ক্লাব ‘আবাহনী’ প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৭২ সালে শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেন ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’। শুরুতে ‘আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি এবং তারপর সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল’ কিনে নেন। সাথে কিনে নেন ক্রিকেট দলটিও।
সব মিলিয়েই গড়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। খেলার মাঠে দলকে সমর্থন দেয়ার জন্য দর্শক টেনে আনার জন্যও নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন শেখ কামাল। আবাহনীর ফুটবল শিল্পের পুরোটাই শেখ কামালের অবদান। তিনি নিজ হাতে গড়ে তোলেন ফুটবল ক্লাবটিকে। আর বাংলাদেশের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তুলতেও নিরলস পরিশ্রম করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৭৩ সালে তিনি বিদেশি কোচ বিল হার্টকে আবাহনীর দায়িত্ব প্রদান করেন, যা তখনকার সময় ছিলো অকল্পনীয়। তাঁর পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফসলই ছিলো সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের জয়জয়কার, রোমাঞ্চকর আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ এবং মাঠভর্তি দর্শকের উন্মাদনা।
ক্রীড়াপ্রেমী এই ব্যক্তি ১৯৭৫ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন আরেক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব সুলতানা খুকীর সঙ্গে, যিনি নিজেও ছিলেন একজন জনপ্রিয় ও দেশসেরা অ্যাথলেট। তবে ক্রীড়াপাগল শেখ কামাল এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে খুব বেশি দূর নিয়ে যাওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সপরিবারে।
ক্রীড়াপ্রেমী ও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ কামালের এসকল জানা-অজানা নানা কথাই উঠে এসেছে সনৎ বাবলার লেখা এই ‘শেখ কামাল : ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু‘ বইটিতে। এদেশের সকল ক্রীড়াপ্রেমীর জন্য এই বইটি একটি অবশ্যপাঠ্য।
এই ব্লগটি লিখেছেন সিয়াম আলমাস।