জীবনের কোন এক বাঁকে কত অচেনা মানুষ চেনা হয়। আবার হয়ে ওঠে প্রিয়। জীবনের আরেক বাঁকে আবার সে মানুষগুলোই হয়ে ওঠে বড় অচেনা…
এমনই দোলাচলে থাকা জীবন আর মানুষের গল্প সেই সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়, মানুষের অন্ধকার অস্তিত্বের সাথে নতুন করে পরিচয় এসব নিয়েই থ্রিলার বই লিখেছেন ফারজানা মিতু।
লেখিকা বরাবরই প্রেমের কথা বলতে পছন্দ করেন। পৃথিবীতে প্রেম সব থেকে বড় একটা বিষয়। প্রেম না থাকলে হয়তো কোনো সংঘাতও থাকতো না। জীবন একঘেয়ে হয়ে যেতো। এমনটাই ভাবেন লেখিকা। লেখালেখিতে তাই প্রধান উপকরণ প্রেম। ঘুরে ফিরে বিরহ আর প্রেমই একাকার হয়ে উঠেছে তাঁর লেখায়। তবে গত বছর বইমেলা ২০২০ এ প্রথমবারের মতো তিনি নিজের ঘরানার বাইরে গিয়ে লেখেন থ্রিলার উপন্যাস ‘মুখোশ’। পাঠকদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় এ বছর বইমেলায় এসেছে মুখোশ বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব ‘স্কেচ’ ।
কথাশিল্পী ফারজানা মিতুর শুরুটা হয়েছিল কবিতা দিয়ে। এরপর লেখেন উপন্যাস। এরই মধ্যে দেড় ডজনের বেশি বই লিখেছেন তিনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে তাঁর কোনো না কোনো লেখা। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ সব শাখাতেই আছে সমান বিচরণ। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সামাজিক সচেতনতামূলক বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। সোচ্চার হয়েছেন নিজে, সচেতন করেছেন চারপাশের মানুষকে।
যাকে নিয়ে এত কথা বলছি এবার কথা বলা যাক সেই লেখিকা ফারজানা মিতুর লেখা নিয়ে। নিয়মিত পাঠকদের মন ভরিয়ে দিয়েছে তাঁর উপন্যাসের মাধুর্য। তবে গত বইমেলায় পাঠকদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন প্রথম থ্রিলার উপন্যাস মুখোশ এর মাধ্যমে।
উপন্যাসের শুরু হয়েছে রায়ানের চাকরি প্রাপ্তির সুখবর দিয়ে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আফজাল চৌধুরী। দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি কোম্পানী তাঁর নিজের। দেখতে সুদর্শন, চেহারায় আছে আভিজাত্য। ঠোটের কোণে রহস্যময় হাসি। এই মানুষটির অফিসেই চাকরি করবে রায়ান। রায়ান প্রথমদিনেই লোকটির রহস্যময় হাসি আর কথার মারপ্যাঁচে অনেকটাই কুপোকাত। তবে আফজাল চৌধুরীর হেঁয়ালি কথার অর্থ বুঝতে রায়ান বেশি সময় লাগেনি। সবার সামনে রায়ানকে আর সবার মতই নতুন এমপ্লই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও আসলে তাঁর কাজ অফিসের সবার ওপর নজর রাখা।
রায়ানের কাজের মধ্য দিয়েই পাঠক পরিচিত হবে আরো অনেকগুলো চরিত্রের সাথে। যেখানে আছে দীপা, রব্বানি সাহেব, নিপু, অরণী, রিনি, আশফাক চৌধুরীসহ আরো অনেকে। প্রতিটি মানুষের আলাদা জীবন, আলাদা প্রেক্ষাপট। অফিসের ছোট গণ্ডিতে মানুষ একরকম মুখোশ পড়ে থাকে। আবার সেই মানুষটিই নিজের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে আরেক মুখোশ নিয়ে হাজির হয়, পরিবারের বাইরে নিষিদ্ধ কোথাও হয়তো তার আরেকটি মুখোশের আড়ালে যেতে হয়। দিনশেষে আবার অন্য মুখোশে ফিরতে হয় কাজের জায়গায়।
রায়ান ছুটতে থাকে মানুষগুলোর পেছনে। তাদের জীবন নিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বারবার হোচট খেতে হয় তাকে। হয়তো যে হাসিখুশি দীপাকে সে চেনে, ভয়াবহ কষ্টগুলো জমিয়ে রাখা দীপা পুরো অন্যরকম। পরিবারের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, একাকীত্বের ভয়ংকর যন্ত্রণা নিয়ে যে দীপাকে পথ চলতে হয় সে যে খুব অচেনা।

ওদিকে রব্বানি সাহেব নিপাট ভদ্রলোক। এত বছর ধরে কাজ করছেন। পরিবার নিয়ে যার নির্ঝঞ্ঝাট জীবন তাঁকে কেন লুকিয়ে পুরান ঢাকায় যেতে হয়? দীর্ঘদিনের সংসার জীবন নিয়ে সে কেন সুখী হতে পারে না। কেন ছুটে যেতে হয় রেশমার কাছে?
আশফাক চৌধুরী। আফজাল চৌধুরীর ছোট ভাই। তাঁর মত অত সুদর্শন না হলেও আভিজাত্যের ছাপ স্পস্ট। তাঁর অফিস দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
সাজগোজ করা সুন্দরী মেয়ে অরণী। কিছুটা গায়েপড়া স্বভাব আছে। তবে বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে নিপুর সাথে দেখা যায়। হয়তো কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু আশফাক চৌধুরী কেন অরণীর প্রতি অতটা কড়া দৃষ্টিতে তাঁকালেন? শেষ পর্যন্ত অরণীর জীবনে কী ঘটবে??
রায়ান কেবলই প্রশ্ন খুঁজে বেড়ায়। খুঁজে ফেরে এত মুখোশের আড়ালে সত্যিকারের মানুষকে। আফজাল চৌধুরী কি সবই জানতেন? তবে রায়ানকে কেন জড়ালেন এই রহস্যের বেড়াজালে?? খুব ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে না তো???
এখানে প্রতিটি চরিত্র লেখিকা স্বতন্ত্রভাবে এঁকেছেন। সবারই আলাদা জীবনগল্প। যে গল্পে চরিত্রগুলো নিজেরাই একেকটি প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে। কাহিনীর গভীরতায় হারিয়ে যাবে পাঠক। পড়তে পড়তে রহস্যের একেকটি চিত্রপট উন্মোচন হবে এমনভাবে যেখান থেকে ঘোর কাটবেই না।
মুখোশ নিয়ে পাঠকের প্রতিক্রিয়া –
“এক প্রকার গল্প আছে যে গল্প পাঠককে একবার পেলে গল্পই পাঠককে নিজ দায়িত্বে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আর পাঠক হয়ে যায় তখন এই পৃথিবীতে বাস করেও এক ভিনগ্রহবাসী। সে তার সমস্ত কাজ, কর্ম, নাওয়া, খাওয়া, ঘুম বেমালুম ভুলে গিয়ে মোহ আচ্ছন্ন হয়ে গল্পের হাত ধরে অজানা অচেনা পথে চলতে চলতে একদম শেষ মাথায় গিয়ে নুন্যতম তিন ঘন্টা চুপ মেরে বসে থাকে। ফারজানা মিতুর মুখোশ ঠিক এই ধরনের একটি উপন্যাস।
পাঠকের নিকট উপন্যাসের চরিত্রগুলো জীবন্ত করে তোলাটাই হচ্ছে উপন্যাসিকের স্বার্থকতা। আমি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলবো ফারজানা মিতু এক্ষেত্রে সফল। কেননা, মুখোশের দৃশ্যপটগুলো তিনি এমন নিপুণ ভাবে সাজিয়েছেন যে পাঠকের মনে হবে আফজাল, রিনি, সায়ান, লতিফ, আজিজ, দীপারা তার চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছে। পাঠক তাদের বেদনায় বেদনার্ত হবে, পাঠক তাদের ক্রুড়তায় নড়ে চড়ে উঠবে।
সবকিছু মিলিয়ে মুখোশ সহজ ভাষায় তুলে ধরা যাপিত জীবনের কঠিন কঠিন চিত্র। কিছু জায়গায় কিছুটা মনমতো না হলেও অধিকাংশ জায়গাজুড়ে গল্পের টাইট গাথুনী উপন্যাসটিকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। এমন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে খুব জরুরী, ফারজানা মিতুর মতো লেখক ও বাংলা সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ। বইমেলা উপলক্ষে লেখক ও মুখোশের জন্য শুভকামনা।
পাঠকদের ঘোর যেন না ভাঙে সে-কারণেই লেখিকা ফারজানা মিতু ২০২১ বইমেলায় নিয়ে এসেছেন মুখোশ বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব ‘স্কেচ’।
‘দেখ কত মানুষ রাস্তায়। কেউ হাসছে কিন্তু ভেতরে জমিয়ে রেখেছে কান্না। কেউ কাঁদছে কিন্তু মুখে ফুটে আছে হাসি। কাউকেই ঠিকমত পড়া যায় না। কারণ সবার মুখেই লাগানো আছে একেকটা বাহারি মুখোশ।’
আবারো সেই মুখোশ দিয়েই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব স্কেচ এর কাহিনি। কালে কালে বেলা গড়িয়েছে অনেক। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। রায়ানের বয়স বেড়েছে বেশ। চুলে পাক ধরেছে। তিতিরের সাথে দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবন তাঁর। পূর্বার মৃত্যুর পর রব্বানি সাহেবে খুব বিমর্ষ হয়ে পরেছিলেন। তাই মৃত্যুর আগে তিতিরের সাথে রায়ানে বিয়েটা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ওদের কোনো সন্তান নেই। সে নিয়েও রব্বানি সাহেবের আফসোসের সীমা ছিল না। কিন্তু রায়ান আর তিতির দুজনে মিলে সুখেই আছে।

ওদিকে আফজাল চৌধুরীর মৃত্যুর পর ছেলে আবরার চৌধুরী বিশাল সাম্রাজ্যের হাল ধরেছেন। রায়ান আগের মতই পাশে আছে সবসময়। আগলে রাখছে তাঁকে। বাবা মৃত্যুর সময়ে আবরারকে যে কয়জন ভরসা করার মতো মানুষ দিয়ে গেছেন তাঁর মধ্যে রায়ান অন্যতম।
আবরার চৌধুরীর স্ত্রী স্বাতী। দেখতে সাধারণ হলেও চেহারায় অন্যরকম এক মাধুর্য আছে। আরে সে মাধুর্য আরও প্রগাঢ়ভাবে লক্ষ করে আবরারের বিদেশ ফেরত বন্ধু সত্য। সত্য আবরারের মতো নয়। সম্পর্কগুলো সে অন্যভাবে দেখে। ভালোবাসা তাঁর কাছে বড় যত্নের। তাঁর মতে ‘ভালোবাসার জিনিসে এত দোষ ধরতে নেই। তাহলে সেটা আর ভালোবাসা থাকে না’। ওর সাথে স্বাতীর সম্পর্ক দিন দিন আরো সহজ হয়ে উঠছে। আবরার কী বুঝতে পারছে? সম্পর্কের মোড় অন্য দিকে ঘুরছে না তো?
অফিসে গিয়ে বন্ধু তানভীরকে জয়েন করতে দেখে রায়ানতো অবাক! তানভীরের মায়ের সাথে পরিচয়ের সূত্রে আবরার চৌধুরী ওকে চাকরিটা দিয়েছে। রায়ান অবশ্য অনেকদিন পর অফিসে প্রিয় বন্ধুকে পেয়ে বেশ খুশি। অফিসের ফাঁকে গল্প আড্ডা সবই হয়। সেখান থেকে জানা যায় তানভীরের সাথে স্ত্রী রূপার সম্পর্কের টানা পোড়েন চলছে। তানভীর নাকি রূপাকে ভালোবাসে না। রায়ানের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। এত অকপটে বলে দেওয়া যায় ভালোবাসে না? সে কি রূপাকে আগে ভালোবাসতো, এখন বাসে না? নাকি কখনোই রূপাকে সে ভালোবাসেনি? কোনটা?
রায়ানের বাড়িতে গিয়ে তানভীর খুঁজে পায় ফেলে আসা স্মৃতি তিতিরকে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে জিততে গিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ভালোবাসা ছেড়ে। আজকের দিনটা হয়তো তিতিরের সাথে খুব সুন্দর হতে পারতো। এত বছরের তীব্র ভালোবাসার গাঢ় অভিমান জমে আছে তিতিরের মনেও। সময়ের সাথে ঘুরতে ঘুরতে কেনই-বা আবার তাঁরা মুখোমুখি? প্রকৃতি কী চায়?
স্কেচ-এ নতুন আঙ্গিকে নতুন চরিত্রের প্রকাশ পেয়েছে বটে তবে মুখোশের রং সেই একই আছে। রায়ানের চোখ এখনো খুঁজে বেড়ায় বদলে যাওয়া মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষকে। এখানে আছে সুখী প্রেম, দুঃখী প্রেম আবার মায়া কাটানো ভালোবাসা। এরই মাঝে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা।
লাল মুখোশ, নীল মুখোশ কত রং-এর মুখোশ পরে চলি আমরা। জনম জনম ধরে প্রকাশের অভাবেই আবেগগুলো মরে যায়। প্রিয় মানুষগুলো জানতেও পারে না। মুখোশের আড়ালেই চলে প্রেম আবার মুখোশের আড়ালেই কিনা খুন! কোথায় গিয়ে হবে এর সমাপ্তি??
ফারজানা মিতু এর বই সমূহ পেতে ক্লিক করুন!
ফারজানা মিতুকে জানতে ভিজিট করুন : https://www.farzanamitu.com
comments (0)