বাহ্যিক দর্শন নয় মানুষের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত তার যোগ্যতা- এমন ভাবাদর্শের ওপর লিখিত ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার লম্বা ছেলে চাই?’
বইটির লেখক আল-ইমরান পেশাগত জীবনে একজন চিত্রশিল্পী। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার সুবাদে সাহিত্য জগতে বিচরণ। তিনি মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকের অভিনয়, উচ্চারণের ট্রেনিংসহ চলচ্চিত্র নির্মাণ, স্ক্রীপ্ট রাইটিং ও চলচ্চিত্র পরিচালনার উপরে দেশী ও বিদেশী প্রশিক্ষকের সনদপ্রাপ্ত হন। সংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল লেখক শুধু সাহিত্য রচনাতেই থেমে থাকেননি। সমাজে বিদ্যমান নানা অসংগতি নিয়েও সোচ্চার। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার লম্বা ছেলে চাই?’ বইটিও তেমনই এক অসংগতির ওপর আলোকপাত করেই লেখা।
নাম শুনে মনে হতে পারে ব্যঙ্গ রচনা। হ্যাঁ, ব্যঙ্গ রচনা বটেই। লেখক ব্যঙ্গ করেছেন সমাজের ব্যঙ্গতাকে। আমাদের দেশে প্রেমিক-প্রেমিকা নির্বাচন থেকে শুরু করে, বিয়ে, পেশাগত প্রতিষ্ঠান, অভিনয় জগত সবখানে লম্বা মানুষদের কদর। যারা উচ্চতায় অপেক্ষাকৃত কম তাদের নিয়ে যেন সবাই ব্যঙ্গ তামাশা করে। লেখক আল-ইমরান আমাদের সে দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যঙ্গ করেছেন।তবে শুধু কঠোর ব্যঙ্গ নয় একই সাথে লেখক যুক্তি, উদাহরণ, উইট সবকিছুর সমন্বয়ে দেখিয়েছেন কেন আমাদের এ ধারণার পরিবর্তন হওয়া উচিত। এ সমস্যার ভুক্তভোগী লেখক নিজে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা-পর্যালোচনা, ব্যাঙ্গাত্মক ছড়া-কবিতা সব মিলিয়ে লেখা ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার লম্বা ছেলে চাই?’
বইয়ের শুরুতেই লেখক নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
“আমি জীবনানন্দের প্রাকৃত কথন, রবীন্দ্রনাথের একলা চলার গান, নজরুলের চিরকেলে উচ্চণ্ডবিদ্রোহ। ভাগ্যদেবীর পথ চেয়ে বিলম্ব করব সে সময় আমি কখনও পাই না।
কারো জন্যে ব্যবস্থা নিতে আমি কখনও ভাবি না। কেন ভাববো? আমার জন্মই তো ভাবনা থেকে। শোষিত নির্যাতিত হওয়া মাত্র ব্যথীর অন্তরে আমি নড়ে উঠি। একটি দোষকে যারা সর্বোত্তম গুণ ভাবতে থাকে সর্বপ্রথম তাদের ঘাড় মটকানো আমার কাজ, আমি সেই শিবের অনুচর।”
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে লেখক সত্যি বলতে দ্বিধা করেন না। অকপটে যেখানে যা বলার দরকার সেটিই দৃঢ়কন্ঠে উচ্চারণ করতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা বইয়ের পরতে পরতে সে স্বাক্ষ্যই মেলে।

শুরুতে লেখক আমাদের ‘লম্বা প্রীতি’র কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন সবার সম্মুখে- সবচেয়ে বেশি শক্তি যদি সবচেয়ে ক্ষুদ্র ‘এটম’ বা পরমাণু ধারণ করে তবে আমরা সবাই কেন বড় হতে চাই। শুধুই বড়। বড় যে আছে সে আরো বড় হতে চায়। নিজেকে বড় ভাবতে গিয়ে আমরা অন্যকে ছোট করি। আর এ যাত্রায় যে মানব সন্তান প্রকৃতিগত ভাবেই আকৃতিতে কিছুটা ছোট তাকে হেনস্থা করার মত আনন্দ ইহজগতে যেন আর কিছু নেই। লেখক নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন এমন কিছু ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে হাস্য রসাত্মক শিরোনামের মাধ্যমে।
প্রেমিক বলি কিংবা স্বামী সবখানে লম্বা পাত্রের জয়জয়কার। মেয়েদেরও এ নিয়ে কম বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না। শুধু বৈবাহিক ক্ষেত্রেই নয়, চাকরি ক্ষেত্রে, সামরিক পদে, এমনকি নাটক বা চলচিত্রের মঞ্চেও শারিরীক ভাবে লম্বা গড়নের অধিকারীরাই যেন সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য থাকে।
বিবাহের বেলায় অনেক নারীর মাঝে মিথ কাজ করে যে, স্বামী হিসেবে লম্বা পুরুষ বেশি যোগ্য। জৈবিক চাহিদা মেটাতে তারা পারদর্শী হবে। সেইসাথে তারা পত্নী-সন্তানসহ সকলের দেখভাল ভালো করতে পারবে। যেহেতু তারা লম্বা- সবচেয়ে ভালো কাজের অফারগুলো তারাই পাবে। খর্বাকৃতির পুরুষ মানেই শারিরীকভাবে অক্ষম। তারা সবখানে পিছিয়ে পরা।
চাকরি ক্ষেত্রেও লেখক এ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। বর্তমানে সিভিতে উচ্চতার পরিমাপ লিখতে হয় যা লেখকের কাছে খুবই বৈষম্যমূলক আচরণ মনে হয়েছে। যে মানুষটির উচ্চতা দেখেই কর্তৃপক্ষ রিজেক্ট করে দেন সে হয়তো অধিক উচ্চতার মানুষটির চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু তুলনামূলক কম উচ্চতার কারণে তাকে হয়তো ইন্টারভিউর জন্য ডাকাই হয় না। আজকালকার নিয়োগদাতারাও এককাঠি এগিয়ে। তারা সার্কুলারেই ঘোষনা করে দেন প্রার্থীকে দেখতে আকর্ষণীয় হতে হবে। অর্থাৎ, সুন্দর হওয়াই যেন মানুষের প্রথম যোগ্যতা। আর সামরিক খাতের কথা তো বলাই বাহুল্য।
লেখক একসময় মঞ্চ নাটকে কাজ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন- শারীরিক আকৃতিতে যারা লম্বা-চওড়া গড়নের তারা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কিংবা মূল চরিত্রের জন্য সব সময়ের জন্য নির্বাচিত হয় আর আকৃতিতে হ্রস্বরা শুধুমাত্র ভাঁড়, চোর, চামুচ, চাপরাশি, দারোয়ান, দোকানি, কেরানি এই চরিত্রগুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণ মানুষ এসব দেখে দেখে ভাবে যে ছোটখাটো আকারের মানুষগুলো আসলে এমন চরিত্রের পাওয়ারই যোগ্য। ফলে যে ছেলেটার মনে অভিনয়ের প্রতি তীব্র আগ্রহ, কিন্তু শারীরিকভাবে দেখতে হয়তো সুশ্রী না সে ভাববে- ধুর, আমি আর এখানে কী করে জায়গা করে নিতে পারবো। শুধু বড় মঞ্চেই না, স্কুল-কলেজেও দেখা যায় যদি ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে কোন পারফর্ম করতে চায় সেখানেও অনেক সময় বেছে বেছে লম্বা-চওড়া, সুদর্শনদের নেয়া হয়। যতই তাদের দক্ষতা হোক তথৈবচ।
উদাহরণ পরবর্তী লেখায় লেখক বৈজ্ঞানিকভাবে উদাহরণ দিয়ে এ ধারণা ভেঙ্গে দেবার যে লেখা অবতরণ করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। লম্বা স্বামী মানেই সবদিক থেকে যোগ্য এ মিথের ধারণা ভাঙতে লেখক অনেকগুলো অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। সুচতুর উপায়ে সেন্সর শব্দগুলো যথা সম্ভব কম প্রয়োগে তিনি নরনারীর বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যাবলী উল্লেখ করে পাঠককে বুঝিয়েছেন কেন, কী প্রকারে একজন কম উচ্চতার সঙ্গী-সঙ্গিনী নিয়েও সুখে-শান্তিতে সংসার করা যায়। জৈবিক চাহিদা থেকে শুরু করে সামাজিক, আর্থিক সব প্রয়োজন মেটাতে একজন খর্বাকৃতির পুরুষও সক্ষম। তাই শুধুমাত্র উচ্চতার প্রেমে পরে সত্যিকার মানবিক গুণাবলীকে অবজ্ঞা না করার জন্য রমণীকুলকে অনুরোধ, উপরোধ ক্ষেত্রবিশেষে তিরস্কারও করেছেন।
সামরিক ক্ষেত্রে লম্বা প্রার্থী নিয়োগের বিষয়টিকেও যথোপযুক্ত নয় বলেই মনে করেন লেখক। খর্বাকৃতি মাত্রই সমরবিদ্যায় পিছিয়ে পরবে এমন ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করতে তিনি ইতিহাসকে স্বাক্ষী হিসেবে এনেছেন। সারা বিশ্বকে জয় করে পদানত করেছিলেন মঙ্গোল বাহিনী প্রধান চেঙ্গিস খান। তিনি যে মঙ্গোলীয় বংশদ্ভুত সে মঙ্গোলরা কিন্তু খর্বাকায় জাতি। এছাড়াও হিটলার, নেপোলিয়ন দুজনেই কম উচ্চতার মানুষ ছিলেন। সবকিছু বাদ দিয়ে আমরা যদি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দিকেই খেয়াল করি তবে দেখব- গড়ে ছ’ফুট লম্বা খান সেনারা কিন্তু তুলনামূলক খর্বাকৃতি, সামরিক শিক্ষায় অশিক্ষিত বাঙ্গালীর কাছে হেরেছিল। তাহলে সামরিক ক্ষেত্রে লম্বা-খাটোর যে নির্ণয় সেটি কি খুব যুক্তিযুক্ত? প্রশ্ন রেখেছেন লেখক।
এছাড়াও বইতে লেখক আল ইমরান কয়েকজন গুণী শিল্পীর সাথে নিজের উচ্চতা বিষয়ক প্রীতিকর-অপ্রীতিকর স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি তুলে এনেছেন জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, বরেণ্য টিভি তারকা হানিফ সংকেত, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানের সাথে সাক্ষাতের কথা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন তা হয়তো ব্যর্থ অনেকাংশেই তবু স্মৃতির মণিকোঠায়, অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এই প্রাপ্তিটুকুকেই মহার্ঘ্য বিবেচনা করে পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করেছেন।
লম্বা-খাটোর এ বৈষম্য নিয়ে লেখকের বেশ কিছু ছড়া-কবিতাও স্থান পেয়েছে বইতে। প্রতিটি ছড়াতেই উচ্চতা প্রীতির সামাজিক ব্যাধিকে নিয়ে তামাশা করেছেন। তবে ঠাট্টা-তামাশা হলেও প্রতিটি ছড়া এক বিষণ্ণতার ইঙ্গিত দেয় যা কেবল মাত্র একজন ভুক্তভোগীই মাত্র রিলেট করতে পারেন।
সর্বশেষে লেখক লম্বাকৃতির সুদর্শন পুরুষ এবং কিশোরীদের সম্ভাষণ করে খোলা চিঠি লিখেছেন। যাতে এই বইয়ের বার্তাটি নিয়ে তাদের মাঝে ক্ষোভ না জন্মে। পুরুষদের জন্য লিখেছেন-
“যথাবিহিত বিনয়ের সাথে আপনাকে একথা জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার বইটি আপনাকে আক্রমণ কিংবা অপ্রস্তুত করার জন্য লেখা নয়। বইটি ওই সকল নালায়েখদের উদ্দেশ্য করে লেখা যারা লম্বা আর খাটো মানুষদের দুই দৃষ্টিতে দেখছে এবং লম্বা আর খাটোর মধ্যে শ্রেণিভেদ তৈরি করছে।”
কিশোরীদের বার্তা দিয়েছেন, মেয়েদের নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর লেখা লিখলেও তা তাদের অপমান করে লেখা নয়। পুরুষের বাহ্যিক দিককে প্রাধান্য না দিয়ে ভেতরের গুণের কদর করে যেন তাঁরা সত্যকার রত্নটিকে চিনে নেয় এইই তাঁর প্রার্থনা।
আপনি ক্লাসের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্রটি হওয়ার পরও আপনি লম্বা ছেলে নন বলে কোন মেয়ে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী হয় না-ব্যাপারটি কতটুকু যৌক্তিক? যে যত বেশী লম্বা হবে সে তত বেশী সম্মান এবং পছন্দ পাবে, তত বেশী অভিনয় অঙ্গনে সুযোগ পাবে এবং তত বেশী উচ্চপদে চাকুরীর সুযোগ পাবে এই ব্যাপারগুলো দিয়ে মেধা প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন হয় কি? এই বিদঘুটে পছন্দ আমাদের দেশ জাতির প্রগতি, সভ্যতাও অগ্রগতিকে বেগবান করছে নাকি পিছিয়ে দিচ্ছে?
প্রিয় পাঠক, এতদসকল প্রশ্নের সমৃদ্ধ মনোসমীক্ষা পেতে পড়ুন ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমরা লম্বা ছেলে চাই?’
আরও পড়ুন- অবসরে পড়ার মত কয়েকটি সেরা বই
লেখকের অন্যান্য বই দেখতে ক্লিক করুন
আরও রম্য রচনাভিত্তিক বই দেখুন