উপন্যাস ‘ভাঙন’ মূলত কীর্তিনাশা নদীর ভাঙনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। তবে এই ভাঙনের সাথে ঔপন্যাসিক রেদোয়ান মাসুদ তাঁর উপন্যাসে কীর্তিনাশা নদীর ভাঙনের সঙ্গে প্রেমান্ধ হৃদয় ভাঙার গল্পের মিশ্রণ ঘটিয়ে একরকম মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আর তাতেই ‘ভাঙন’ উপন্যাসের নামের সার্থকতা ফুটে উঠেছে।
এই উপন্যাসটি পড়লে অনেকে নতুন নতুন বেশকিছু তথ্য খুঁজে পাবেন। বারো ভূঁইয়াখ্যাত চাঁদ রায়, কেদার রায় ও মহারাজা রাজবল্লভের এমন সব ইতিহাস এখানে উঠে এসেছে, যা কালের গর্ভে ইতোমধ্যে বিলীন হতে শুরু করেছে। বিক্রমপুর যে দুই ভাগে ভাগ হয়েছিলো এবং ভয়ংকর কীর্তিনাশা নদী কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো, এই উপন্যাস পড়লে খুব সহজেই তা জানা যাবে।
কীর্তিনাশার করাল গ্রাসে যে কেবল নদী ভাঙন সৃষ্টি হয়েছিল বিষয়টা এমন নয়, বরং সেখানে তৎকালীন মানুষের সামাজিক জীবনযাত্রা তুলে ধরতে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিতা ও নয়নের হৃদয় ভাঙার গল্প নির্মাণে লেখক তাঁর প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। নন্দিতা ও নয়নের প্রেম ও জীবন সংগ্রাম এই উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসে কীর্তিনাশার ভাঙনে তৎকালীন রাজপ্রাসাদ ও স্থাপত্য ভাঙনের বর্ণনা পড়ার সময় মনে হয় স্বচক্ষেই যেন দেখছি।
শায়েরি, গান, পুঁথি, কবি গান, জারি গান, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি যেন গ্রাম থেকে আজকাল বিলুপ্ত হতে চলেছে অথচ লেখক তাঁর উপন্যাসে এই সব সৃষ্টিতে দারুণ চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে এই উপন্যাসের প্রাণ মনে হয় বিশাল এক পুঁথির সৃষ্টি যেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি লিপিবদ্ধ আছে।
বইটির ফ্ল্যাপের অংশ
মানুষের মন ভাঙে আর নদীর ভাঙে কূল। মানুষের যেমন মন বদলায়, নদীরও তেমন গতিপথ বদলায়। তার ফলে সৃষ্টি হয় নতুন নদী। আর এভাবেই পদ্মা নদীর পথ বদলানোর খেলায় বিক্রমপুরের বুকে নতুন এক নদীর সৃষ্টি হয়। বারো ভূঁইয়াখ্যাত মহাপ্রতাপশালী রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরের সকল কীর্তি নাশ করেছিল বলে নদীটির নাম হয়ে যায় কীর্তিনাশা। এই নদী বিক্রমপুরের মানচিত্রকেই পালটে দিয়েছিল। ইতিহাসখ্যাত বিক্রমপুরকে দুভাগ করে নাম হয়ে যায় দক্ষিণ বিক্রমপুর ও উত্তর বিক্রমপুর। কীর্তিনাশার দুপাড়ের সকল ভূমি ও স্থাপনার মতো মানুষের হৃদয়ও ভেঙেছিল।
আশেপাশের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনসহ সকল আপনজন। কীর্তিনাশার পাড়ে ছিল বিক্রমপুরের আরেক রাজা রাজবল্লভের রাজধানী রাজনগর। সেই রাজনগরের সকল কীর্তিও কীর্তিনাশা নাশ করে যেন নামকরণের সার্থকতা অর্জন করে। সামান্য একটি খাল হঠাৎ করে বিশাল নদী হয়ে যাওয়ার কারণে নয়ন ও নন্দিতা নামে দুজন মানুষের প্রেমান্ধ হৃদয়ও ভেঙে ছারখার হয়ে যায়। দুজন দুদিকে পড়ে যায়। এক সময় কীর্তিনাশা তাদের ঘরবাড়িও ভেঙে ফেলে এবং কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করায়।
একদিকে থাকার জায়গা নেই, অন্যদিকে পেটেও অন্ন নেই। তার ওপর বুকের মাঝে জমে থাকা ভালোবাসার মানুষের কোনো দেখা নেই। এক জায়গায় ঘর তুলে কিছুদিন থাকতে না থাকতেই আবার সেই জায়গাও ভেঙে যায়। এভাবেই কীর্তিনাশা বিক্রমপুরের মানুষকে নিয়ে ফুটবলের মতো খেলতে খেলতে এদিক থেকে ওদিক ফেলে এক ভয়ংকর নেশায় মেতে ওঠে। এক সময় সেই কীর্তিনাশা তার সকল মিশন শেষ করে পদ্মার বুকে হারিয়ে যায় আর পদ্মা নদীও তার গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন পথে প্রবাহিত হয়।

প্রচ্ছদ ও উৎসর্গপত্র প্রসঙ্গ
বইটির প্রচ্ছদটি করেছেন অসাধারণ চিত্রশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। প্রচ্ছদটি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে এই প্রচ্ছদের ভিতরেই যেনো গল্প লুকিয়ে আছে। তবে উপন্যাসের যে গভীরতা রয়েছে তাতে প্রচ্ছদের কালার একটু বেশি চকচকে মনে হয়েছে। আমার ধারণা, বর্তমান বাজারে বইয়ের কাটতি বাড়াতে বইয়ের ভেতরের বক্তব্যের সাথে মিল না রেখে রঙচঙা টাইপ করে প্রচ্ছদ নির্মাণশৈলী সব বইয়ের সাথে মানায় না।
এবার আসি উৎসর্গ পত্র প্রসঙ্গে। আমি সবসময় বই পাঠের আগে বইয়ের প্রচ্ছদ, উৎসর্গ আর ভূমিকা বা লেখকের কথা পড়ি৷
উৎসর্গটি দেখলেই লেখকের সত্তাকে বুঝা যায়— সততা থেকে লিখেছেন নাকি স্বার্থান্বেষী চাটুকারিতার জন্য। এই বইয়ের উৎসর্গটি দারুণ লেগেছে৷ মনে হয়েছে তার পূর্বসূরীকে আগামী প্রজন্মের জন্য প্রামান্য দলিলের মত তুলে ধরেছেন।
তবে লেখকের ভূমিকা অংশ পড়ে চমকিত হয়েছি। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ না হলে অকপটে নিজের দুর্বলতা আর অগোছালো সত্তাকে কেউ প্রকাশ করতে চায় না। লেখক তাঁর ভূমিকায় সেই সুনিপন ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি এই ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রয়োজনের নিমিত্তে যাবতীয় তথ্য এবং তাতে যে সব ঘাটতি উনি অনুভব করেছেন তা স্পষ্ট করে সবার কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
তাঁর এই সততা এবং এ প্রয়াসকে আমি সাধুবাদ জানাই। নিশ্চয়ই তাঁর পরবর্তী লেখায় উনি আরও সাবলীল এবং আরও শৈল্পিক লেখকের পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন।
পাঠ অনুভূতি
ইতোপূর্বে রেদোয়ান মাসুদের যতগুলো কাব্যগ্রন্থ আর উপন্যাস বের হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলো গ্রন্থ আমি পড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এবার ২০২১ বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ” ভাঙ্গন” পড়ার পর মনে হয়েছে তিনি তাঁর আগের সবগুলো গ্রন্থের চেয়ে এইবারের উপন্যাসটি এক নতুন মাত্রায় উন্নত করেছেন। আরও সহজ করে যদি বলি তবে এইবারের বইটাতে উনি একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পসত্তা কিংবা লেখক সত্তা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন এবং তাঁর এই প্রচেষ্টাকে আমি অভিনন্দন জানাই।
আমি যেকোন গল্প, উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে প্লট নির্মাণশৈলী এবং বর্ণনা ভঙ্গিকে বেশি প্রাধান্য দেই৷ আমি মনে করি দূর্বল একটি প্লট কেবল বর্ণনার কারণে দারুণ রূপও নিতে পারে৷ তার গল্পের প্লটটা চমৎকার। স্থান,সময়,চরিত্রের বর্ণনায় কোথাও বাহুল্যতা নেই।
উপন্যাসের কিছু কিছু উপমা এতই সুন্দর ছিলো যে আমি সেগুলো দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বারবার দেখেছি।
ভালো লাগার কিছু লাইন
“যার যেটা নেই সে কখনো সেটার মূল্য বোঝে না, একমাত্র সে-ই ব্যক্তিই সেটার মূল্য বোঝে যার কোনো জিনিস পূর্বে ছিল কিন্তু এখন নেই।”
“জীবনে চলার পথে বাধা আসতেই পারে তাই বলে থেমে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই, যেখানে বাধা আসবে সেখান থেকেই আবার শুরু করতে হবে।”
“বাবা হলেন একটি বাড়ির ছাদ, যে নিজে পুড়ে সন্তানদের ছায়া দেয়, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না।”
“পুরুষদের পুরুষত্বের গর্বই হলো নারীদের প্রতি অবহেলার মূল কারণ।”
“প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার পার্থক্য হলো দুঃখ। তাই নিজের প্রত্যাশাটা একটু কমিয়ে ফেলুন, দেখবেন আপনার দুঃখও কমে গেছে।”
“এ পৃথিবীতে মানুষ শুধু সফলদের কথাই জানে কিন্তু সফল হতে গিয়ে যে কত মানুষ ব্যর্থ হয়ে নিঃস্ব হয়েছে তার কথা কেউ জানে না বা জানার প্রয়োজনও মনে করে না।”
“পরমাণু বোমার চেয়েও শক্তিশালী বোমা হলো মানুষের বুকফাটা কান্না, একটা বোমা ফাটার শব্দ সারাবিশ্ব শুনতে পায়, অথচ মানুষের বুকফাটা কান্না পাশে বসে থাকলেও কেউ শুনতে পায় না।”
সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি
লেখকের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে আরও সাবলীল ও মনোমুগ্ধকর হওয়া উচিৎ ছিল বলে মনে হচ্ছে। উপন্যাসের অলংকার, রুপক, উপমা ইত্যাদির ব্যবহারও তুলনামুলকভাবে কম দেখেছি। প্রথমে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে কেবল প্রবন্ধের মত মনে হয়েছে। তারপর পড়তে পড়তে বেশকিছুক্ষণ যাবার পরেই মনে হয়েছে উপন্যাসের মূল পটভূমি নির্মাণ করতে গিয়ে ইতিহাসকে প্রবন্ধের নিরিখে উল্লেখ করায় এই অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। উপন্যাসের প্রয়োজনেই হয়তো এই ঘরানা আবশ্যক ছিল।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, শত শত বছর আগের ঘটনাগুলোর সর্বজনগৃহীত এবং স্বীকৃত তথ্যসূত্র পাওয়া সত্যিই কঠিন। তবে বেশ কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে উপকথা ও প্রচলিত ধারণা থেকে এবং লেখক তার খুব কাছের সাহিত্যিক, ব্যক্তিত্ব ও প্রিয়বন্ধুর কাছে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বইটিতে প্রয়োজনের নিমিত্তে সেসব তুলে ধরেছেন কিন্তু সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আরেকটা বিষয় মনে হয়েছে- উপন্যাসের শেষের দিকে লেখক তাঁর উপন্যাসটি শেষ করতে তাড়াহুড়ো করেছেন। হয়তো লেখক সেটাও তাঁর চিন্তাশীলতার জায়গা থেকেই করেছেন যেন তা আবার পাঠকের মনে বিদ্রুপ না জাগাতে পারে।
ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটা অবশ্যই পড়ার মতো একটা বই। তবে বইটাকে খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে আলোচনা ও বিতর্কে জড়ানো কিংবা এখানে বিতর্কের তথ্যসূত্র না খোঁজাই উচিত।
প্রকাশনীর প্রডাকশন সম্পর্কিত
অনিন্দ্য প্রকাশের প্রোডাকশন ছিলো দুর্দান্ত। পৃষ্ঠা,বাইন্ডিং,ফন্ট, মেকাপ সবই খুব সুন্দর হয়েছে।
পরিশেষে বলব, লেখক তাঁর বর্ণনাভঙ্গিতে এবং প্লট নির্মানশৈলীতে তাঁর আগের গ্রন্থের চেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। এই উপন্যাসে আমি লেখক রেদোয়ান মাসুদকে নতুন রুপে খুঁজে পেয়েছি। দারুণ তৃপ্তি নিয়ে বলবো উনার বিগত বইগুলোর চেয়ে এই বইটা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে সম্ভাবনাময় একজন করে তুলতে পারে।। যদি আরও মনোযোগী হন তবে আরও ভালো করবেন৷
রেদোয়ান মাসুদের “ভাঙ্গন” উপন্যাসটির অনেক অনেক শুভকামনা। বইটি সকল শ্রেণির পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাক৷
-মিঠা মামুন
আরও পড়ুন– মৌরি মরিয়মের সেরা ৫ উপন্যাস
বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন