বাংলাদেশের যে কোন বড় গ্রন্থাগার কিংবা লাইব্রেরীতে ঢুঁ মারলে যেসব শিক্ষার্থীদের দেখা যায়, তার মধ্যে অধিকাংশই থাকেন বিসিএস পরীক্ষার্থী। এমনকি অনেকে এটা দেখে অবাক হয়ে যান যে, গ্রাজুয়েশন শেষ করে এসে তারা কেন ক্লাস নাইনের অংক কষছে! আর এজন্যই হয়তো বিসিএসকে বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল ও স্নায়ুচাপের পরীক্ষা।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত। প্রতি বছর গড়ে ৩,৫০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ প্রার্থী আবেদন করে। পুরো বছরের চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ৯০% শতাংশই বিসিএস আবেদনকারী। মুলত তিনটি ধাপের মাধ্যমে একজন আবেদনকারী ক্যাডার হিসবে উতরে যেতে পারে।
- প্রথম ধাপ: প্রিলিমিনারি। এটি বিসিএস পরীক্ষার প্রাথমিক যোগ্যতা বাছাই পর্ব। প্রতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রাথমিক এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত পরীক্ষার এক মাস আগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় এবং পরীক্ষার প্রায় এক থেকে দেড় মাস পরে ফলাফল প্রকাশিত হয়।
- দ্বিতীয় ধাপ: লিখিত পরীক্ষা। এটি বিসিএস এর প্রধান পরীক্ষা। সাধারনত প্রতি বছরের শেষের দিকে (অক্টোবর-নভেম্বর) বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার জন্য সবাইকেই এখানে বেশ ভালো ফলাফল করতে হয়।
- তৃতীয় ধাপ: মৌখিক পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মৌখিক পরীক্ষার দেড় থেকে দুই মাস পর বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়।
পরীক্ষার ধাপগুলো দেখলেই বোঝা যায়, বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে হবে মানসিক ভাবেও। মুলত বিসিএসের পড়ার অংশটা একটু বেশি হওয়ায় অনেকেই ঘাবড়ে যায়। কিন্তু কিছু সহজ ট্রিকস দিয়ে আপনি চাইলেই বেশ কার্যকরীভাবে বিসিএসের তিনটি অংশের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন। তবে সেই পড়াশোনা করার প্রস্তুতি শুরু করার আগে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। সত্যিকার অর্থে, এই প্রস্তুতি আপনার পুরো লাইফস্টাইলকেই প্রভাবিত করবে।
প্রথমত আপনার মনের সংকল্প তৈরি করে ফেলতে হবৎ, যদি এবার বিসিএস আবেদনকারীদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ করা হয় সেটা হবেন আপনি। আপনার মনে বিসিএসের ইচ্ছাটা তীব্র ভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে। একটা কথা আছে- ‘তুমি যদি কোন কিছু পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করো, মহাবিশ্বের সবকিছুই ষড়যন্ত্র শুরু করে দেবে তোমাকে সেটি পাইয়ে দিতে’। এই কোটেশনটা পাওলো কোয়েলহোর বিশ্ববিখ্যাত দ্য আলকেমিস্ট বই থেকে চুরি করা। আপনি মনের মধ্যে শক্ত সংকল্প করে ফেলেছেন? এবার শুরু করুন পড়াশোনা।

প্রথমেই আপনাকে উতরাতে হবে প্রিলিমিনারি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সঠিকভাবে প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা রাখা। আপনি যদি প্রশ্নকে ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করতে পারেন তবে পড়াশোনা আপনার জন্য অর্ধেক সহজ হয়ে যাবে। বিসিএস প্রিলিমিনারী অ্যানালাইসিস নামক বইটি আপনাকে এই ধাপে সাহায্য করতে পারে। অনেক ক্যাডারই বলেছেন, প্রিলিমিনারির প্রশ্ন যদি আপনি ধরে ফেলতে পারেন তাহলে প্রিলিতে পাশ করা শুধু সময়ের ব্যাপার। এজন্য পড়ার আগে নিজে নিজে পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করুন। তারপর সে অনুযায়ী ঠিক করুন, কোন কোন বিষয়গুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে অন্তত এক নাগাড়ে সব মুখস্থ করা থেকে রক্ষা পাবেন। বাংলা সাহিত্য কিংবা এ সম্পর্কিত বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে সৌমিত্র শেখরের বই পড়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত আসে, লিখিত পরীক্ষা। আবেদনকারীদের কাছে লিখিত বলে জটিল মনে হলেও সঠিকভাবে পরিশ্রম ও পড়াশোনা করলে এটা বরং অন্যান্য ধাপের চেয়ে বেশ সোজা। লিখিত পরীক্ষা োদরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলে কোচিং বা টিউশনের আশেপাশেও যাবার দরকার নেই। যা শেখার শিখেছেন। এখন শুধু পড়া, পড়া আর পড়া। আমরা এক নজরে কিছু টিপস দেখি-
- কোচিংয়ে যদি মডেল টেস্ট দিতে যান, তবুও সেটায় প্রাপ্ত নাম্বার নিয়ে চিন্তিত হবেন না।
- একটা বিষয়ে অনেক বেশি পড়ে রাখার চেয়ে সব বিষয়ে কম কম করে হলেও পড়ে রাখুন।
- কোন বিষয়ে পড়া শেষে মডেল টেস্ট দেয়া যেতে পারে। বাজারে অনেক ধরণের মডেল টেস্টই পাওয়া যায়।
- বাংলা পড়ার সময় ব্যকরণ, ভাবসম্প্রসারণ, সারমর্ম, অনুবাদ ইত্যাদি বিষয়ে বেশি জোর দিন।
- বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রশ্ন আকারে না পড়ে ধারণা নেবার চেষ্টা করুন। যেমন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উপর প্রশ্ন আসতে পারে ভেবে অনেকেই এ বিষয়ে এমসিকিউ সম্বলিত প্রশ্ন কেনেন। কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ হলো বইটাই স্বয়ং পড়ে ফেলা। এতে করে পুরো বইয়ের উপর আপনার ধারণা থাকবে। আর শিক্ষার্থীদের জন্য অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পেপারব্যাকে খুব কম মুল্যে পাওয়া যায়।
- ‘কোনটা পড়লে কমন পড়বে’ –এই ধরণের চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ মনে রাখবেন, আপনি প্রশ্ন কমন পাওয়ার আশা করবেন না; বরং সব প্রশ্নের উত্তরই ধারণা করে দেয়ার সামর্থ্য নিয়েই পরীক্ষা দিতে বসেবন।

সবশেষ আসবে, মৌখিক পরীক্ষা। যাকে ইন্টার্ভিউ বলি আমরা। সত্যি বলতে এই ধাপে সবচেয়ে বেশি আবেদনকারী বাদ পড়েন।
- ভাইভায় সর্বমোট নম্বর হলো ২০০। এই নম্বরের মধ্যে যদি আপনি শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর মানে ১০০ পান, তবে পাস করেছেন। এতে ক্যাডার আসবে কি না, বলা যায় না। তবে নন-ক্যাডার লিস্টে নাম থাকবে—এটা নিশ্চিত! এতে পরে হয়তো অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে আপনি সুপারিশকৃত হতে পারেন।
- ২৭ তম বিসিএসের পর থেকে ভাইবা বোর্ডে আপনার লিখিত নাম্বার রাখা হয় না। অর্থাৎ আপনি ভাইবা আসার আগে লিখিত পরীক্ষায় কতটুকু ভালো করেছেন তা তারা জানতেই পারেন না। সুতরাং আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে ভাইবার নাম্বারের উপরে।
- বাংলায় করা প্রশ্নের উত্তর বাংলাতেই দেবেন। এবং ইংরেজিতে যেই প্রশ্ন করা হবে সেটা ইংরেজিতে দেবেন। কোনভাবেই বাংলা-ইংরেজি মিশ্রনে কথা বলা যাবে না।
- যদিও কোন ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর আপনি বাংলায় দিতে চান, তবে বোর্ডের অনুমতি নিয়ে দিন। বোর্ড বাংলায় উত্তর দেয়ার অনুমতি না দিলে কোনভাবেই বাংলায় উত্তর দেবেন না।
- কোনভাবেই সবজান্তা ভাব করা যাবে না। আবার বেশি নার্ভাসও হওয়া যাবে না। সব প্রশ্নের উত্তরেই আন্তরিকতা বজায় রাখা জরুরী।
- ভাইবায় অংশ নেয়ার আগে পূর্বের ক্যাডারদের ভাইবার অভিজ্ঞতা জেনে নিতে পারেন। ভাইবা বোর্ডের মুখোমুখি কিংবা জয়কলির ভাইবা বোর্ডের সাজেশন বিষয়ক বই পড়ে যেতে পারেন। এতে করে ভাইবা বোর্ডে তাদের অভিজ্ঞতা আপনি নিজেই কাজে লাগাতে পারবেন।

আসলে বিসিএস পরীক্ষা যেমন আপনার নিজের চাকরীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি প্রশাষনিক বিভিন্ন পদে নিয়োগ করানো হবে বলে এটা রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেশে প্রচলিত অন্যান্য পরীক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেশ আলাদা ও অপেক্ষাকৃত কঠিন। কিন্তু সঠিক নিয়মে পড়াশোনা করলে ও পরিশ্রম করলে যে কোন আবেদনকারীর কাছেই লক্ষ্যে পৌছানো তেমন কঠিন কিছু নেই। পূর্বে ক্যাডার হওয়া মানুষেরাও একদিন আপনার মত সাধারণ আবেদনকারী ছিলেন এবং তাদেরও এতগুলো ধাপ পার করে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে হয়েছে। তাই নিজের সৎ সাহস থাকা খুব জরুরী। হয়তো এই পরীক্ষাটার পরই আপনি হতে চলেছেন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
বিসিএস প্রিলিমিনারি, রিটেন, ও ভাইভার বইসমগ্র পেতে ক্লিক করুন !
বিসিএস রিটেন বুক লিস্ট !
comments (0)