স্বপ্ন বিলাসিতা মানুষের চিরায়ত স্বভাব। আর তাই জন্মগ্রহণ করে বুঝতে শেখার পর পর-ই স্বপ্নময় আবেগতাড়িত মানুষ ভাবে, জীবনে বড় কিছু হতে হবে। ছেলেবেলা থেকেই মানুষ স্বপ্ন দেখে ভালো কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করার। স্বপ্নের চাকরি পেতে অধিকাংশ লোকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনাও করে। স্বপ্নের চাকরিটা পেতে চেষ্টা চালিয়ে যায় সবাই। তবে ক’জন পারে স্বপ্নটাকে সত্যি করতে ! – এ প্রশ্নটি কিন্তু রয়েই গেছে। স্বপ্নের চাকরি পেতে মানুষ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে ঠিকই, তবে স্বপ্নকে ধরতে পারে না তাদের কিছু ব্যক্তিগত ও ভাবনাগত অভাবের ফলে। অভাবগুলো এতটাই তীব্র হয় যে, পুরোদমে বিকল করে দেয় ২০-২৫ বছর ধরে পুষে রাখা স্বপ্নের চাকরির আকাঙ্ক্ষা। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব অভাবগুলোকে জয় করেই আমাদের স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। ভালো ক্যারিয়ার গড়তে বাস্তবে অনেক বিষয়ই বিবেচ্য। সেসকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এ লেখায় আমরা এমন দশটি জনপ্রিয় ক্যারিয়ার বিষয়ক বই নিয়ে আলোচনা করবো যেন ক্যারিয়ার নিয়ে সত্যিই আপনাকে আর ভাবনা ভাবতে না হয়………
১. শরবতে বাজিমাত — মুনির হাসান
নতুন কিছু করার জন্য সবসময় উদ্যোক্তাদের ওপর একটা চাপ থাকে। বলা হয়ে থাকে, নতুন কিছু করতে পারলেই সাফল্য এসে ধরা দেবে। তবে, কেবল নতুন কিছু নয় — প্রচলিত ব্যবসাকে ভিন্নভাবে করে গড়ে তােলাও কিন্তু একধরণের সফল উদ্যোগ। যেমনটা করেছিলেন, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তিন বন্ধু – রিচার্ড রীড, এডাম বেলন এবং জন রাইট। ১৯৯৮ সালে তারা নিজ নিজ চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন, শরবতের ব্যবসা। মাত্র ৫০০ পাউন্ড হাতে নিয়ে ইনােসেন্ট নামের এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তারা। বর্তমানে ইউরােপের ১৩টি দেশে ইনােসেন্ট বিক্রয় হয়। কোম্পানির বাজার দর প্রায় ১০ কোটি পাউন্ড (এক হাজার কোটি টাকার বেশি) !! এর ৯০ ভাগের বেশি ওরা বিক্রি করে দিয়েছে কোকাকোলা কোম্পানির কাছে! তারা প্রত্যেকে এখন প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যক্তিগত দ্বীপের মালিক।

একটি বইতে তারা তাদের কোম্পানি গড়ে তােলার অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে আমাদের মন-মানসিকতা ও সিস্টেমের অনেক মিল। সেজন্য দেখা যায়, আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মতাে এই তিন বন্ধুও রাস্তায় ঘুরেছেন মাসের পর মাস। ‘এসএমই বান্ধব ব্যাংকিং নীতিমালা’ থাকা সত্ত্বেও কোনাে একটি ব্যাংকও তাদের ফুটো কানাকড়িও দেয়নি। সবাই সারাক্ষণ তাদের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেছে “তােমাদের পদ্ধতিতে শরবত বানালে, তােমরা দেউলিয়া হয়ে যাবে। এই ভাবে হয় না।”
হাজার হাজার ‘না’ কেমন করে অতিক্রম করেছেন এই তিন বন্ধু? কেমন করে শরবত তাদের আর্থিক মুক্তির পথ খুলে দিয়েছে? কেমন করে বিনা পুজিতে তারা মার্কেটিং করেছেন? কোন বুদ্ধিতে একটার পর একটা দেশে ব্যবসা বাড়িয়েছেন আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলেছেন একটি চমৎকার সংস্কৃতি ! এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা হয়েছে এই বইতে।
২. রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড — রবার্ট টি. কিয়োসাকি
‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’–কে রবার্ট টি. কিয়োসাকির সেরা বই ধরা হয়। এটি সর্বসময়ের সবচাইতে জনপ্রিয়, ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বই হিসেবে বিখ্যাত। লাখো মানুষের টাকা সম্পর্কিত ধারণাকে বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে এই বইটি।
রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বইটি আসলে ধনী আর গরিবের মানসিক পার্থক্য নিয়ে লেখা। সেই সাথে লেখক শিখিয়েছেন, কিভাবে নিজের মানসিকতা বদল করে ধনী হওয়া যায়। ‘সুশীল’ সমাজের লোকেরা একটা কথা প্রায়ই বলেন, “পুঁজিবাদের কারণে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরীবেরা গরীব থেকে যাচ্ছে”। ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট সেলার বই ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড (Rich Dad Poor Dad)’ এর লেখক রবার্ট কিয়োসাকি বলেন, এটা একদম ফালতু কথা। ধনীরা আরও ধনী হওয়ার পেছনে পুঁজিবাদের কোনো ভূমিকা নেই। ধনীরা ধনী হয় তাদের মানসিকতার কারণে। গরিবরাও গরিব থেকে যায় তাদের মানসিকতার কারণে। সঠিক পথে চিন্তা আর পরিশ্রম করলে, যে কেউ ধনী হতে পারে।

রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড একটি অর্থ সম্পর্কিত বই। বইটির একেবারে মূল ম্যাসেজ হলো, ধনী হওয়ার জন্য একাগ্রতা ও সাহসের অনেক বেশি দরকার। বইটি পড়লেই যে আপনি ধনী হয়ে যাবেন, বিষয়টা মোটেই এমন নয়। তবে হ্যাঁ, ধনী হওয়া যে অকল্পনীয় কোনো বিষয় নয়, সেটা খুব ভালোভাবে জানতে পারবেন এই বইটির কল্যাণে।
৩. বিলিওন ডলার স্টার্টআপ — মুনির হাসান
‘স্টার্টআপ’ — বর্তমান তরুণ সমাজের কাছে এক জনপ্রিয় ও আকাঙ্ক্ষিত শব্দ। স্টার্টআপ মানে একটি নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা। একটি স্টার্টআপ এর ভ্যালু যখন ১ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ইউনিকর্ন। এই বইয়ের প্রচ্ছদে তাই রয়েছে কাল্পনিক প্রাণী ইউনিকর্নের ছবি। কিন্তু বিলিয়ন ডলার মানে কতো টাকা? শূন্য ঠিকঠাকমতো বসিয়ে সেটিকে ৮৫ টাকা দিয়ে গুণ করার পর বোঝা গেল ঘটনাটি আসলে বেশ জটিল। কারণ টাকার পরিমাণটা হচ্ছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ! এতো টাকা কেমন করে হিসাব করা যায় !
লেখক মুনির হাসান এই বইতে ভিন্ন আঙ্গিকের ১৩ টি স্টার্টআপ নিয়ে কথা বলেছেন। যেমনঃ হাতের কাছে আছে আমাদের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বানাতে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে চার বিলিয়ন ডলারের একটু কম। আবার রয়েছে ফেসবুকের কথা, রয়েছে বেডিং কোম্পানি ক্যাসপারের কথা।

‘বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ’ বইটিতে নতুন করে শুরু হওয়া একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে ইউনিকর্ন হয়ে ওঠে, সে গল্প-ই শুরু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। গল্পে গল্পে জানা যাবে, বিলিয়ন ডলার কোম্পানিগুলো কেমন করে তৈরি হয়, তাদের আইডিয়া থেকে বিকাশের পথ পরিক্রমা। গল্পের সঙ্গে কখনো কখনো ভেসে উঠবে গল্প থেকে শেখার অংশও।
উদ্দেশ্য একটাই — এক সময় আমরাও যেন বিলিয়ন ডলারের অনেকগুলো গল্প তৈরি করতে পারি।
৪. ১০০ ওয়েজ টু মোটিভেট আদারস — স্টিভ চ্যান্ডলার, স্কট রিচার্ডসন
‘১০০ ওয়েজ টু মোটিভেট আদারস’ বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় একটি বই। মোটিভেশন বা প্রেরণাদায়ক বইগুলোর মধ্যে সাধারণত পুরাতন বইগুলোই আমাদের দেশে অধিক প্রচলিত। নতুন সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে শিক্ষা, ব্যক্তিগত জীবন বা কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ও ধারাবাহিক উন্নতির জন্য পরীক্ষিত একটি বই এটি।
বইটি শুরুই হয়েছে একজন হতাশ ম্যানেজারের গল্প দিয়ে; যিনি নিজের টিম নিয়ে হতাশ ছিলেন। পাশাপাশি নিজেও প্রশিক্ষণ নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ঐ ম্যানেজারই দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং নিজের টিমের উপর তা অ্যাপ্লাই করে সফল হন। নিজ হতাশা কাটিয়ে একজন প্রাণবন্ত মানুষে পরিণত হন তিনি।

‘১০০ ওয়েজ টু মোটিভেট আদারস’ বইটি উন্নতির জায়গাগুলো পয়েন্ট আকারে দেখিয়ে দেয়। পাশাপাশি কার্যকর কাজের পদ্ধতিও নির্দেশ করে।
৫. আমি একঅজন সেলসম্যান: তানভীর শাহরিয়ার রিমন
লেখক তানভীর শাহরিয়ার রিমন তাঁর ১৭ বছরের কর্পোরেট জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই মূলত মার্কেটিং এর উপর এই বইটি লিখেছেন। বইয়ের কথা আর চরিত্রগুলোর পাশাপাশি লেখকের গল্প বলার ধরণ যে কতটা সুন্দর ! – এই বইটি না পড়লে তা বুঝতে পারবেন না।
বইটি ৮০পৃষ্ঠার একটি কর্পোরেট উপন্যাস। বইটিতে লেখক সেলসম্যানদের জীবন সংগ্রাম, কিভাবে টার্গেট পূরণ করতে হয়, কিভাবে অন্যের প্রতি বিশ্বাস রেখে কাজ করতে হয়, ছাড় দিতে হয়, কিভাবে অন্যের কাজের প্রশংসা করতে হয়, অন্যের কাছে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে হয় – এসব বিষয় বোঝাতে চেয়েছেন। দেখানো হয়েছে, কিভাবে রাগ-অভিমান ভুলে সংবেদনশীলতার সাথে কাজ করতে হয়। লিডারশীপ দক্ষতার উদাহরণও দেওয়া হয়েছে।

লেখকের জীবনের বাস্তব গল্প দিয়ে লেখা হলেও এটি আসলে গল্পের বই না। ‘আমি একজন সেলসম্যান’ বইটিতে লেখক গল্পের ছলে আমাদেরকে কিছু গভীর ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন। কর্পোরেট সংস্কৃতিতে যারা অভ্যস্থ, যারা সেলস পেশায় আছেন, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান, অথবা শীর্ষ কর্মকর্তা – এই বইয়ে তারা নিজেদের খুঁজে পাবেন অন্যরকম ভাবে। আবার যারা নতুন, ক্যারিয়ার মাত্র শুরু করেছেন কিংবা চাকরি খুঁজছেন – এই গল্প তাদেরও। এমনকি যারা তরুণ উদ্যোক্তা, টিম তৈরি করতে মুখিয়ে আছেন তারাও এই বইতে ভিন্ন স্বাদ খুঁজে পাবেন।
৬. কর্পোরেট লিডারশিপ — তৌফিকুর রহমান
লিডারশিপ নিয়ে আমাদের মনে নানান রকম প্রশ্ন কাজ করে – আসলে লিডারশিপ কী, কেন প্রয়ােজন, ম্যানেজমেন্ট এবং লিডারশিপের মধ্যে পার্থক্য কী, ইত্যাদি। বিশেষ করে পেশাগত পরিমণ্ডলে একজন সফল লিডার হতে গেলে তার আসলে কী কী বিষয়ে দক্ষতা প্রয়ােজন – এ নিয়ে সংশয়ে ভােগেন অনেকেই। ‘কর্পোরেট লিডারশিপ’ বইটিতে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় সবার বােঝার উপযােগী করে, বিভিন্ন উদাহরণ এবং উদ্ধৃতির মাধ্যমে এসব বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বইয়ের লেখক তৌফিকুর রহমান একজন সফল প্রফেশনাল ট্রেইনার, কনসালটেন্ট এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন প্রফেশনাল কোচ। বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, লিডারশিপ, ব্যবসা পরিচালনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৫০০টিরও বেশি প্রফেশনাল ট্রেনিং প্রােগ্রাম পরিচালনা করেছেন তিনি।
৭. উদ্যোক্তা ও ১০১ বিজনেস আইডিয়া — আবদুল হাকিম নাহিদ
প্রতিবছর ত্রিশ লাখ তরুণ পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারিসহ নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয় মাত্র দশ লাখ। আর এভাবেই বছর বছর বেকার সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিসাবমতে, বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠী চার কোটিরও অধিক। বিশাল জনসংখ্যার এদেশে চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা হওয়া-ই হতে পারে বেকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান অবলম্বন।
যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, আজ থেকে ৪/৫ বছর পরে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে চায়, তাদের জন্য লেখকের ১০১ টি পরামর্শমূলক বিজনেস আইডিয়া আর সফল মানুষদের নানান সমস্যা কাটিয়ে উঠে সফলতা অর্জনের গল্প – ‘উদ্যোক্তা ও ১০১ বিজনেস আইডিয়া’।

উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-দাদা ব্যবসায়ী ছিলেন না বলে আপনি ব্যবসা করতে পারবেন না — এ কথা মোটেও সঠিক নয়। অন্য সবকিছুর মতোই ব্যবসাটাও শিখতে হয়, খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতে হয়। শুধু একটি ভালো আইডিয়া আছে, প্রস্তুতি নেই, কিন্তু ঝাপিয়ে পড়লাম — বিষয়টা এতো সহজও নয়, আবার জটিল জটিল কোনো তত্ত্ব মুখস্থ করতে হবে — এমনও না। আপনার আশেপাশের ব্যবসা সম্পর্কে জেনে রাখা, কিভাবে মূলধন ও বিনিয়োগ পাবেন তা খুঁজে বের করার পদ্ধতি এবং ব্যাংক কখন কিভাবে আপনাকে লোন দিবে সে উপায় নিয়েও এই বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটি তাদের জন্য যারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী কিংবা যাদের মাথায় ভালো কোনো স্টার্টআপ বিজনেসের আইডিয়া নেই। অথবা যারা ব্যবসা করছেন কিন্তু এখনও সুন্দরভাবে নিজের ব্যবসা গুছিয়ে নিতে পারেননি তাদের জন্যও এই বই।
ক্যারিয়ার সংক্রান্ত আরও বই পড়তে চাইলে ক্লিক করুন