স্যাটায়ার বা হিউমার বলতে আমরা সাধারণত কী বুঝি? খুব সহজ ভাষায় বললে কারো কোনো কর্মকান্ড বা কথাবার্তাকে কেন্দ্র করে হাস্যরস তৈরি করা। হাস্যরসের সৃষ্টি হলে উদ্ভূত পরিস্থিতে আমরা হেসে ফেলি, হাসিতে গড়াগড়ি খাই এবং আমাদের আড্ডা আরও জমে ওঠে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে স্যাটায়ার বা হিউমার যে আমাদের দৈনন্দিন যোগাযোগ বা কমিউনিকেশনের একটি বড় মাধ্যম হতে পারে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো?
পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট সিমু নাসেরের মতে, স্যাটায়ার বা হিউমার কমিউনিকেশনের একটি বড় মাধ্যম। স্যাটায়ার বা হিউমারে মাধ্যমে কমিউনিকেশন করার অনেক ভালো দিক রয়েছে। যার একটি হলো, স্যাটায়ার বা হিউমারের মাধ্যমে কমিউনিকেশন তৈরি করলে অনেক সময় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো যায়। আপনি যা বুঝাতে চাচ্ছেন, সেটি যেমন বুঝাতে পারবেন তেমনি যার সাথে কমিউনিকেশন করছেন তার সাথে মতের অমিল থাকলেও কোনো রকম বৈরিতা তৈরি হবে না।
রকমারি ডট কম আয়োজিত ক্যারিয়ার কার্নিভালের দ্বিতীয় দিনে ক্যারিয়ার ক্যাফে লাইভে প্রকৌশলী রাতুল খানের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট সিমু নাসের। সিমু নাসের বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন। অতীতে কাজ করেছেন প্রথম আলোর স্যাটায়ার ম্যাগাজিন আলপিনে, বর্তমানে রস আলো ও কিশোর ম্যাগাজিন কিশোর আলো’তে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পূর্নাঙ্গ অনলাইন স্যাটায়ার কনটেন্ট সাইট eআরকি’র প্রতিষ্ঠাতা। ক্যারিয়ার ক্যাফে লাইভে ঘন্টাখানেকের আলোচনায় সঞ্চালক রাতুল খান ও দর্শকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। এসময় তিনি আড্ডার ছলে স্যাটায়ার কনটেন্টের নানা বিষয় ও কনটেন্ট ব্র্যান্ডিংয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সে আড্ডার কিছু গল্পকথা নিয়ে এবারের আয়োজন।
স্যাটায়ার বা হিউমার কনটেন্ট
যেকোনো কনটেন্টের কাজ হলো, কোনো বিষয়কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। কনটেন্ট তৈরির বিভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে, যেমন- কোনো মেসেজ বা বার্তা প্রদান করা, সচেতনতা তৈরি করা ইত্যাদি। স্যাটায়ার বা হিউমার কনটেন্টের কাজ হলো, কথার মাধ্যমে অন্যকে কখনো আঘাত করে আবার কখনো আঘাত না করেও হাস্যরস সৃষ্টি করে কোনো মেসেজ প্রদান করা বা কোনো বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।
সঠিক কমিউনিকেশনের অভাবে দ্বন্দ্ব বাড়ে!
সিমু নাসের বলেন, স্যাটায়ার বা হিউমার কমিউনিকেশনের অনেক বড় একটি মাধ্যম। মানুষ যখন স্যাটায়ার বা হিউমারের মাধ্যমে কমিউনিকেশন করে তখন কোনো রকম দ্বন্দ্ব বা বৈরিতা তৈরি হয় না। মানুষের মধ্যে যখন কমিউনিকেশন দক্ষতার ঘাটতি থাকে তখনই নানা ধরণের অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রায় দেখা যায় আমাদের দেশের বিভিন্ন আঞ্চলে সামান্য ব্যাপারকে কেন্দ্র করে একাধিক গ্রামবাসী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যদি স্যাটায়ার বা হিউমারের মাধ্যমে কমিউনিকেশন করা হয় তাহলে এসমস্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো যায়। স্যাটায়ার বা হিউমার বুদ্ধিদীপ্তভাবে অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়।
হিউমার কিভাবে মারামারি বন্ধ করে!
হিউমার কিভাবে আকস্মিক উদ্ভূত বৈরী পরিস্থিতির সহজ সমাধান দিতে পারে সে কথাই সিমু নাসের তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি মজার গল্প দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দু’জন সহপাঠী দু’টি ভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। একদিন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সংগঠন দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। মুহূর্তে তার এক বন্ধু অপর বন্ধুকে আঘাত করে বসলেন। আঘাতপ্রাপ্ত বন্ধুটি পালটা আঘাত না করে হিউমার সৃষ্টি করলেন। তিনি তার বন্ধুকে বলে উঠলেন, ‘বন্ধু তুমি আমাকে মারলা? গতকাল না তোমাকে আমি চা খাওয়ালাম!’ ব্যাস ! মুহুর্তেই অপর বন্ধুটি তাকে জড়িয়ে ধরে ‘স্যরি’ বলল এবং ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন খাবার খাওয়ালো। সিমু নাসের বললেন, এখানে পাল্টা আঘাত না করে হিউমারের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাধান তৈরি হলো। মোট কথা, হিউমার দিয়ে কমিউনিকেশন করলে কখনো মারামারি হয় না।
স্যাটায়ার টাইম মেশিনের মতো!
স্যাটায়ারের রকমারি ক্ষমতা আছে। স্যাটায়ার অনেক সময় টাইম মেশিনের ন্যায় ভবিষ্যতের কথা বর্তমানে বলে দেয়। সিমু নাসের বলছিলেন তেমনি আরেকটি মজার অভিজ্ঞতার কথা। চলতি বছরের এপ্রিলে করোনার উপর eআরকি একটি স্যাটায়ার কনটেন্ট তৈরি করেছিল। কনটেন্টের বিষয়টি ছিল এমন- করোনা ঘুষখোরদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। এখন ঘুষ নিতে হলে আগে হাত স্যানিটাইজড করতে হবে। এপ্রিলে তারা যে স্যাটায়ার কনটেন্ট বানিয়েছিলেন, আগষ্ট মাসে এসে তারই এক বাস্তব চিত্রের দেখা মিলল। রাজশাহীতে এক পুলিশ কর্মকর্তা হাত স্যানিটাইজড করে ঘুষের টাকা গুণে নিচ্ছেন এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল ইন্টারনেটে ও সংবাদ মাধ্যমে।
স্যাটায়ার প্রতিবাদের ভাষা
স্যাটায়ার হতে পারে প্রতিবাদের অন্যতম বড় মাধ্যম। যেখানে সরাসরি কিছু বলার ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে সেখানে স্যাটায়ারের মাধ্যমে আমরা আমাদের কথা বলতে পারি। সিমু নাসের বলেন, ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে আমাদের সাথে যত রকম অন্যায় ঘটে সব ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবাদ করা শিখতে হবে। আমরা প্রতিবাদ না করলে, কথা না বললে পরিবর্তন কখনো আসবে না। তাই আমাদেরকে স্যাটায়ার বা হিউমারের ভেতর থেকে প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে বের করতে হবে। কখনো চুপ থাকা যাবে না।
সবাই কি সব হিউমার-স্যাটায়ার নিতে পারে?
সবাই সব ধরণের হিউমার-স্যাটায়ার নিতে পারে না। সিমু নাসের বলেন, পৃথিবীর সবকিছুকে নিয়েই স্যাটায়ার বা হিউমার করা যায়। তবে এই হিউমার বা স্যাটায়ার কার উদ্দেশ্যে করছেন, সেটা ভেবে নিতে হবে। তা না হলে মিস কমিউনিকেশনের সম্ভাবনা থাকে। স্যাটায়ার বা হিউমার নেওয়ার ক্ষমতা একেকজনের একেক রকম। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, তার জানাশোনা ও শিক্ষার উপর। তাছাড়া তাৎক্ষনিকভাবে যারা হিউমার নিতে পারেন না, এদের অনেকে পরবর্তীতে হিউমারটি বুঝতে পারেন। তখন ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যায়। আমরা যখন স্যাটায়ার কনটেন্ট তৈরি করি তখন ম্যাক্সিমাম অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখে তৈরি করি। তবে ভিন্ন ভিন্ন অডিয়েন্সের কথা ভেবেও ভিন্ন ভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করতে হয়।
স্যাটায়ার কনটেন্ট চর্চার বিষয়
সিমু নাসের বলেন আমাদের দেশে আমরা প্রতিভাকে বড় করে দেখি। কিন্তু নেপথ্যের চর্চা, পরিশ্রমকে আমরা সেভাবে দেখি না। যেকোনো বিষয়কেই চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত্বে আনতে হয়। আমাদের সবারই বন্ধু সার্কেলে এমন একজন বন্ধু থাকে সে সবসময় হিউমার তৈরি করতে পছন্দ করে। হিউমারের মাধ্যমে সে তার বন্ধুদের সাথে ঠাট্টা তামাশা করে। এটা তার সহজাত প্রতিভা। কিন্তু এর বাইরে প্রফেশনালি স্যাটায়ার কনটেন্ট বানানো পুরোটাই চর্চার বিষয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন ঘরে বসে পৃথিবীর কোথায় কোন হিউমার আছে আমরা সেগুলো দেখতে পারি। আর স্যাটায়ারের ধরণও নির্দিষ্ট কয়েক রকম। জোকসের কথা বললেও তাই ঘুরেফিরে অল্প কয়েক ধরণের জোকস আছে সেগুলোই আমরা বিভিন্ন রকমে ফেলে বিভিন্ন রকমভাবে উপস্থাপন করি। ভালো মানের স্যাটায়ার কনটেন্ট তৈরি করতে হলে জীবনের সবকিছুকে স্যাটায়ার-হিউমারের আঙ্গিকে ভাবতে হবে। চর্চা করতে করতে হবে।
eআরকি’র ব্র্যান্ডিং সিক্রেট
সিমু নাসের বাংলাদেশের অনলাইন ভিত্তিক স্যাটায়ার সাইট eআরকি’র প্রতিষ্ঠাতা। সাইটটি প্রতি মাসে ছয়শ থেকে সাতশটি স্যাটায়ার কনটেন্ট তৈরি করে থাকে। যার প্রতিটি কনটেন্টে বিশেষ কিছু বিশেষত্ব থাকে, যা দেখে সহজে বুঝা যায় সেগুলো eআরকি’র কনটেন্ট। eআরকি’র ব্র্যান্ডিং সিক্রেট সম্পর্কে সিমু নাসের বলেন, এখানে সিক্রেট বলে কোনো কিছু নাই। এটা নির্ভর করে কে কতদিন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করে। কেউ যখন একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার কিছু সিগনেচার দাঁড়িয়ে যায়। ব্র্যান্ডের সাথে জড়িতরা যা ভাবে একটি ব্র্যান্ড মূলত সেটিই প্রকাশ করে। গ্রাফিক্সের ক্ষেত্রে আমরা হলুদ রঙকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ব্র্যান্ডিং কালার কোডে প্রতিটি রঙয়ের বিশেষ অর্থ থাকে। আমরা যেহেতু তরুণদের জন্য ভাইব্রেট কিছু কনটেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করি সঙ্গত কারণে আমরা হলুদ রঙকে বেছে নিয়েছি। এছাড়া eআরকি’র আরেকটি দিক হলো আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে খুব বেশি সরব থাকার চেষ্টা করি।
লেখাটি শেষ করার আগে আমরা আমাদের বন্ধু মহলে আরেক বার ফিরে যাই। বলবো আমাদের সে বন্ধুটির কথা যে সবকিছুতে হিউমার তৈরি করে, যার কথাতে আমরা হাসির রসদ পাই। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, তার হিউমারের পেছনে উন্নত কোনো জীবনবোধের গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে? তার হিউমারের পেছনের গল্প এমনও তো হতে পারে যে- সে ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে সবাইকে নিয়ে এগোতে চায়। আঘাতের জবাব না দিয়ে সে হিউমার তৈরি করে, কারণ- সে বোঝাতে চায় সে আপনার করা আঘাত তার গায়ে মাখেনি। তাই চলুন আমরাও হিউমার তৈরি করি এবং জীবনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিই।
কনটেন্ট বিষয়ক বইগুলো