একজন চেয়েছিলেন লেখক হতে, একজন চাকরি ছেড়েছেন প্রকাশক হতেই। যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন, তিনিও লেখালেখিকে ভালোবেসে শেষ পর্যন্ত আসেন বই প্রকাশনায়। অন্যজন নিজের স্বপ্নের তরণীর হাল তুলে দেন তাঁর কন্যার হাতে। বলছি, মাহবুব রহমান এবং মাহরুখ মহিউদ্দিনের কথা; প্রকাশনা জগতের ইতোমধ্যেই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং এক উদীয়মান নক্ষত্রের কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ছাত্র থাকাকালীন প্রকাশিত হয় মাহবুব রহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘না ঘুমানোর দিন’। লেখালেখির বাসনা থেকেই তার মনে চাকরি না করার প্রত্যয় জন্ম নেয়। সেই প্রত্যয় থেকে আল মাহমুদের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশের মাধ্যমে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি কাজ করেন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকার সাহিত্য, ফিচার এবং সম্পাদকীয় পাতায়। ২০১৫ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি প্রকাশনা ব্যবসায় নিয়োজিত হন। সে বছরই রাগিব হাসানের দুটি এবং চমক হাসানের একটিসহ মোট তিনটি নন-ফিকশন বই আদর্শ থেকে প্রকাশ করে প্রকাশনা জগতে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। এতদিন যে নন-ফিকশন ছিল প্রকাশকদের কাছে অচ্ছ্যুত, সেই নন-ফিকশনই চলে আসে পাদপ্রদীপে। স্বল্প সময়ের মধ্যে লেখক এবং পাঠকদের কাছ থেকে অর্জন করে নেন আস্থা এবং ভালোবাসা।

চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৫ সালে প্রকাশনার প্রবাদ পুরুষ মহিউদ্দিন আহমেদ নিজ উদ্যোগে শুরু করেন স্বপ্নের ‘প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। ২০০৯ সাল থেকে মেয়ে মাহরুখ মহিউদ্দিন হাল ধরেন এই প্রকাশনীর। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ইউপিএল শুধু দেশের নয়, প্রকাশ করেছে অনেক বিদেশি লেখকের বইয়ও। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের বই প্রকাশে ইউপিএল’র অবদান অনস্বীকার্য।
ন্যাশনাল বুক সেন্টার পুরস্কার, এমেরিটাস পাবলিশার পদবিসহ এই প্রকাশনী পেয়েছে অনেক স্বীকৃতি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, চিলেকোঠার সেপাই, পরার্থপরতার অর্থনীতির মত অনেক বিখ্যাত বই প্রকাশ হয়েছে ইউপিএল থেকেই। গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষের মেধা মননকে এগিয়ে নেয়ার প্রবল প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মাহরুখ মহিউদ্দিন।
এবার এই দুই নক্ষত্র অতিথি হয়ে এলেন রকমারি ক্যারিয়ার কার্নিভালে।
প্রকাশনা শিল্পের ওপর করোনার প্রভাব কী?
পূর্বে বাংলাদেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো টেকনোলজির দিকে গুরুত্ব তেমনভাবে দিত না। তবে করোনাকালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ ভালোভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছে যে, সামনের দিনগুলোতে ই-বুক এর চাহিদা আরও বাড়বে, সেইসাথে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও এই সেক্টরে আসবেন তাদের প্রতিভা নিয়ে। ফলে, প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে। পূর্বে কেবলমাত্র ডিজিটাল বইয়ের ক্ষেত্রে নয়, বরং প্রমোশনের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল মাধ্যমগুলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করত না। তবে করেনাকালে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে। বইয়ের আলোচনা, বইয়ের প্রচার, এই দুই দিক থেকেও করোনা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এমনকি দেশের বাইরেও এই সেক্টরের মানুষের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। বক্তাদের মতে, প্রকৃতপক্ষে যারা বড় কিছু করেন, তারা সমস্ত কিছুর মধ্যেই সম্ভাবনা খুঁজে বের করেন। নেতিবাচক বিষয় থাকলেও তা দূরে সরিয়ে রাখেন। যারা জীবনে বড় কিছু করতে চান, তাদেরও এই ইতিবাচক মনোভাব থাকা উচিত।

ক্যারিয়ার ও উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশনা শিল্প কতটুকু সম্ভাবনাময়?
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)’র কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন- তিনি ২০১৪ সালের পর পুরোপুরি ইউপিএল এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রথমদিকে এটি তার জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটি যাত্রা ছিল। কেননা তিনি যে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় এই সেক্টরে এসেছেন এমনটা নয়, বরং একটি কর্তব্যসূত্রে এসেছেন। সে কারণে প্রথমদিকে কেউ এই সেক্টরে আসতে চাইলে তিনি তাকে নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি মনে-প্রাণে জানেন যে, প্রকাশনা শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, বরং এখানে একটি সামাজিক দ্বায়িত্ববোধের জায়গা রয়েছে। প্রকাশনা অন্য যে কোনো ব্যবসার মতো নয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রথম দায়বদ্ধতা পাঠকের কাছে এবং অবশ্যই লেখকের কাছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যখন একটি বই প্রকাশ করে, তখন লেখকের কাজটিকে পাঠকের কাছে তৈরি করে নিয়ে যাওয়ার যাত্রাটি সম্পন্ন করে। পাঠকের জীবনের ভ্যালু অ্যাড করার চেষ্টা করে প্রকাশক এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা বা উদ্যোগের বাইরে প্রকাশক এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা রয়েছে, এটা যারা উপলদ্ধি করেন এবং যারা গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন, তাদেরই এই ক্যারিয়ারে আসা উচিত। জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে যাদের উৎসাহ রয়েছে, তাদের অবশ্যই প্রকাশনা ব্যবসার উদ্যোগ নেয়া উচিত। আবার ইউপিএল সমাজবিজ্ঞান গবেষণার কাজগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রকাশ করে থাকে। এই ক্যাটাগরিতে পাঠক অনেক কম হলেও সামাজিক দায়িত্ব থেকে পাঠককের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেই ইউপিএল এই ধরনের বই প্রকাশ করে। সমাজকে বোঝা, অর্থনীতিকে বোঝার যাত্রা শুরু করেছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। সেসময় কেবলমাত্র দেশীয় পাঠকদের জন্যেই নয় বরং বৈশ্বিক পাঠকের এর কথা মাথায় রেখেই বই প্রকাশ করা হতো। এখনও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। সে কারণে কেবলমাত্র অর্থলিপ্সা নয়, বরং উদ্যমের কারণেই এই সেক্টরে আসা উচিত।
মাহবুব রহমান মনে করেন, প্রকাশকের মূল দ্বায়িত্ব লেখককে গাইড করা। লেখককে গাইড করার জন্য প্রকাশনার মূল বিষয়গুলো প্রথমেই জেনে নিতে হবে। একজন লেখকের রুচি, তার সম্ভাবনার জায়গাটি প্রকাশকের বুঝতে হবে, তবেই প্রকাশনায় সফল হওয়া যাবে। আদর্শ প্রকাশনীতে যখন কোন লেখকের পান্ডুলিপি আসে, তখন তারা সেই লেখকের সাথে বসে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করেন। তারা চাইলে কিছু না বুঝেই বইটি ছাপাতে পারতেন, কিন্তু প্রকাশকের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লেখকের দর্শন এবং লেখার মাধ্যমে লেখক কী প্রকাশ করতে চেয়েছেন, সেটা বোঝা জরুরি। দায়বদ্ধতার পাশাপাশি লেখালেখি এবং সাহিত্যের উপর যাদের প্যাশন রয়েছে, তাদেরই প্রকাশনা ক্যারিয়ারে আসা উচিত। আবার লেখক নির্বাচনের দিকটাও বিবেচনায় রাখা উচিত। আদর্শ লেখক খুঁজে বের করে এভাবেই। যখনই কোন লেখকের লেখা পড়ে মাহবুব রহমানের মনে হয় এই লেখায় বই বের হলে তিনি নিজে আগে কিনতেন তখনই তিনি সেই লেখকের সাথে যোগাযোগ করে বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। লেখককে সার্ভিস দেয়া, লেখককে ঠিকমতো নির্দেশনা দেয়া, সমস্ত ব্যাপারে পুরো টিমের কাছে স্বচ্ছ থাকা- এই ব্যাপারগুলোর কারণে লেখক এবং পাঠকের আদর্শ– এর প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে। কাজেই শর্টকাট কোন পথে বড় হওয়ার চিন্তা বন্ধ করে সৎ পথে চলার ইচ্ছা থাকলে তবেই এই ক্যারিয়ারে আসা উচিত।

বিরাট এই জনসংখ্যার দেশে পাঠক তৈরি হচ্ছে না কেন?
প্রকাশনা শিল্পটি যেহেতু শূণ্য থেকে কাজ করে না এবং যেহেতু এককভাবে কাজ করা কোন প্রতিষ্ঠান নয়, সেহেতু শিল্পের নানা কম্পোনেন্টের কোনোটিতে ঘাটতি রয়েছে কিনা সেটা বোঝা শুরুতেই জরুরি। বাংলাদেশে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় থাকা স্বত্ত্বেও ভাল মানের গবেষণা এখনো হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীর কী কী মুল্যবোধ তৈরি হচ্ছে? মুখস্থ নির্ভর, পরীক্ষা ভিত্তিক একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন করা, কোনো কিছু সম্পর্কে জানার চেষ্টা, এই ধরনের ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর কোন বিকাশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। যেকোন ধরনের গবেষণার শুরুই হয় ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চেনিং থেকে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, কিছুকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, শিক্ষক যা বলছেন তাই মেনে নিতে হবে এবং শিক্ষককেও কোন প্রশ্ন করা যাবে না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে এটাকে কোন সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষণ বলে মনে হয় না। স্বভাবতই পাঠ্য বইয়ের বাইরে কোনো বই পড়ার প্রচলন আগে থেকেই আমাদের দেশে তেমন ছিলো না। সে কারণেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো কোন বইয়ের ৪০০-৫০০ কপি ছাপানোর ক্ষেত্রেও অনেক ভাবনা-চিন্তা করে যে, এই বই কত মানুষ কিনে পড়বে। এমনকি খুব ভালো বইয়ের ক্ষেত্রেও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এটা ভাবতে হয় যে, এই বইটা প্রকাশ করে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মুখ দেখা যাবে কিনা। যে কারণে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তেমন কোন ইনভেস্টমেন্টে যেতে চায় না। একটি বই প্রকাশ থেকে ডিস্ট্রিবিউশন পর্যন্ত যেতে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, অনেকগুলো চ্যানেল এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই পুরো ইকো সিস্টেমের কোন একটিতেও যদি সমস্যা থাকে তাহলেও প্রকাশক অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হন। যেমন- রকমারি আসার আগে বাংলাদেশে বইয়ের তেমন কোন ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল ছিল না এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বইয়ের দোকানের উপর নির্ভর করতে হতো। সেটা অনেকাংশেই অনেক ঝামেলাপূর্ণ এবং পীড়াদায়ক ছিল। রকমারি আসার পর ডিস্ট্রিবিউশন সমস্যার অনেক সমাধান হয়েছে। কাজেই এরকমভাবে প্রকাশনার ইকোসিস্টেম কম্পোনেন্টগুলোয় ইনোভেশন এবং পরিবর্তন আনলে আরও পাঠক তৈরি হবে।
প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
যখন কোন প্রেস ছিল না, বই ছাপানোর টেকনোলজি আসেনি, তখনও মানুষ জ্ঞান চর্চা করত। বই পড়ার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন। সেটা ফিকশন, নন-ফিকশন দুই ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মাহবুব রহমান মনে করেন, জ্ঞান যে কোনোভাবে অর্জন করাটাই বড় কথা। কেবলমাত্র বইয়ের মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন করতে হবে এমন কোন কথা নেই। বর্তমানে টেকনোলজির কারণে জ্ঞানার্জনের অনেক প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বে বই পড়ার ধরন আর এখনকার বই পড়ার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। ফলে টেকনোলজির কারণে জ্ঞানার্জনের সম্ভাবনা বিস্তৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে যে ডিভাইসের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে জ্ঞান রোপন করার একটি পদ্ধতি চলে আসবে। যে কারণে ইবুক, ভিডিওবুক, অডিওবুক এই বইগুলোর সম্ভাবনা সামনের দিনগুলোতে আরও বেড়ে যাবে। অর্থাৎ আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ডিজিটাল বই। আবার এরকমও মানুষ রয়েছেন যারা হার্ড কপি ছাড়া বই পড়তে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। মাহরুখ মহিউদ্দিন মনে করেন, ভবিষ্যতে ই-বুক এর পাশাপাশি প্রিন্ট বইও থেকে যাবে খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে। কেননা- এখনও প্রিন্ট বই পড়ার অভ্যাস যাদের রয়েছে সেই জেনারেশন এখনও রয়ে গেছে। তবে ডিজিটাল মাধ্যম অনেক ডিসট্রাক্ট করে মানুষকে, সেক্ষেত্রে প্রিন্ট বই পড়ার সময় মানুষ আরামদায়ক একটি অনুভূতি পায়। সেকারণেই প্রিন্ট বই অনেক সময় পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
বইয়ের দাম কি আসলেই অনেক বেশি? পাঠকের এই অভিযোগ কতটুকু সত্যি?
বাংলাদেশে কাগজের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের প্রায় দ্বিগুণ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো যা উৎপাদন করে, সেখানে প্রোডাকশন এবং ম্যাটেরিয়াল-এর সমস্ত খরচ এক জায়গায় করলে দেখা যাবে, ৪০% খরচ হয় শুধুমাত্র কাগজ কেনা বাবদ। একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার জন্য অবশ্যই শুধু যা খরচ করা হচ্ছে সেটা উঠিয়ে আনতে পারলেই হবে না, প্রফিটও করতে হবে। একটি বই প্রকাশ করতে ম্যাটেরিয়াল ও প্রোডাকশন বাবদ খরচ হয় ৩০-৩৫%। যদি একটি বইয়ের খরচ হয় ৩০ টাকা প্রতি ফর্মা, তাহলে এর ভেতরে ৩০ শতাংশই খরচ হয় প্রোডাকশন খরচ বাবদ। সেই বইটির যদি মার্কেটিং-এর খরচ বাদ দেয়া যায়, তাহলে সেই বইটি বিক্রি করতেই বিভিন্ন খাত বাবদ মোট খরচের ১০% খরচ হয়। এর ভেতরে যারা ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে তাদেরকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ৪০% করে খরচ দিয়ে থাকে। এরপরে লেখককে যদি ১০%ও রয়্যালটি দেয়া হয়, তাহলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯০-৯৫% চলে যায়। মাত্র ৫% প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে থাকে বই বিক্রি হওয়ার পর। মাহবুব রহমান বলেন, এই স্বল্প পরিমাণ লাভ নিয়ে একটি বড় প্রতিষ্ঠান চালানো খুবই দুরূহ ব্যাপার। তিনি বলেন এক্ষেত্রে বইয়ের দামের ব্যাপারে এই দেশীয়দের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দেশী বই কিনতে গেলেই আমরা কমিশন খুঁজি, কিন্তু বিদেশী বইগুলো, এমনকি পাশের দেশ ভারতের বই কেনার ক্ষেত্রেও আমরা ৫% ও কমিশন দিয়ে বই কেনার ব্যাপারে ভাবি না। বিদেশী বই অন্তত ৩ গুণ বেশি দামে কিনতে হয়, তারপরেও আমরা কমিশন নিয়ে কথা বলি না। এটা পুরোপুরি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। এখানে কেবল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং যারা বই বিক্রি করছেন, তারাও খুব বেশি লাভ করতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০০ টাকা মূল্যের বই থেকে ৪০ টাকা লাভ করার জন্য সেলারদের ১ মাস ডিসপ্লেতে বইটি রাখতে হচ্ছে। সবথেকে বড় ব্যাপার হলো, পাঠক কি প্রকৃতপক্ষে ডিসকাউন্ট চায়, নাকি ভাল বই চায়? তিনি মনে করেন, পাঠকের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। পাঠকের ফোকাস হওয়া উচিত ডিসকাউন্ট নয়, বরং ভাল মানের বইয়ের দিকে।

মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, কাগজের দামের ক্ষেত্রে এক ধরনের জিম্মি দশার মধ্যে রয়েছেন প্রকাশকরা। ইমপোর্ট করা কাগজের উপর ৬১% ট্যাক্স দিতে হয়। সে কারণে প্রকাশকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশীয় কাগজের শরণাপন্ন হতে হয়, এই ব্যাপারটার সুযোগ নিয়ে দেশীয় কাগজের দাম কৃত্রিমভাবে অস্বাভাবিক রকম বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। অন্যান্য দেশের প্রকাশকরা সমস্ত খরচ উঠিয়েও ১০-১৫% এর বেশি প্রফিট করে, অথচ সেখানে ৩-৪% ও প্রফিট করতে পারে না প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। সুতরাং এইরকম একটি পরিস্থিতিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো যে এতদিন টিকে আছে, সেটা একটা অভাবনীয় ব্যাপার। তিনি আরও মনে করেন, বইয়ের কনটেন্টেরও যে একটি মূল্য আছে, এই ব্যাপারটি পাঠকদের মধ্যে প্রকাশকরাও প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বইয়ের দামের ব্যাপারে পাঠকদের পরিস্থিতিও বিবেচনা করতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে, যেন লেখক, পাঠক, প্রকাশক সবাই লাভজনক পরিস্থিতিতে উন্নীত হতে পারে। সেক্ষেত্রে মূল যে সমস্যাগুলো যেমন- কাগজের অস্বাভাবিক বেশি দাম- এই ব্যাপারগুলো সমাধান করা অত্যাবশ্যক। সেইসাথে পাঠক তৈরির ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
লেখক-প্রকাশকের প্রচলিত দ্বন্দের মূল বিষয়টি কী?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- লেখকরা অভিযোগ করে থাকেন যে প্রকাশকরা লেখকদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন। আবার প্রকাশকরা বলে থাকেন, একটি বই কম বিক্রি হলেও লেখকরা বেশি হয়েছে বলে দাবী করে রয়্যালটি চান। এই চিরায়ত সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে মাহবুব রহমান মনে করেন, লেখক এবং প্রকাশকের পারস্পরিক আন্তরিকতার সম্পর্ককে আরও বাড়াতে হবে। প্রকাশনা ব্যবসার বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে কোন লেখকের যদি মোটামুটি ধারণা থাকে, তাহলে সমস্ত বিষয়টিই তার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। তিনি তখন আর অভিযোগ করেন না। প্রেসে এবং বাঁধাইখানায় সব জায়গাতেই হিসাব থাকে একটি নির্দিষ্ট বই কতগুলো ছাপা হয়েছে এবং কতগুলো বাজারে ডিস্ট্রিবিউট করা হয়েছে। কোন লেখক যদি বই বিক্রির ব্যাপারটি যাচাই করে দেখতে চান তাহলে তিনি অবশ্যই তা খুব সহজে দেখতে পারেন এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেস্ট স্বচ্ছ থাকে। তবে লেখক এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর জন্য এই প্রক্রিয়াটি আরও ভালো একটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত। সেইসাথে লেখকেরও দায়বদ্ধতা থাকা উচিত নিজেদের চুক্তি এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির ব্যাপারে খুঁটিনাটি বুঝে নেয়ার। লেখক-প্রকাশক দুই তরফকেই এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।
আদর্শ এর উদ্যোক্তা মাহবুব রহমানের জীবনে প্রভাব ফেলা বইসমূহ-
২। টলস্টয়ের রচনাসমগ্র
৩। পাবলো নেরুদার রচনাসমগ্র
৪। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচনাসমগ্র
৬। সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি ইফেক্টিভ পিপল
৭। বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা– মহিউদ্দিন আহমেদ
৮। মাই নেম ইজ রেড- ওরহান পামুক
৯। মিথের শক্তি- জোসেফ ক্যাম্পবেল
ইউপিএল এর কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিনের জীবনে প্রভাব ফেলা বইসমূহ-
১। সেইসময়– সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায়
২। নিরুদ্দেশের দেশে নীললোহিত- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩। কয়েকটি বিহ্বল গল্প– শাহাদুজ্জামান
৪। কাহলিল জিবরান এর বইসমূহ (দ্য প্রফেট)
৫। সিদ্ধার্থ– হেরমান হেস