সফলতার কোন সংজ্ঞা নেই, সফলতা একটা মানসিক ধারণা মাত্র। সবার জীবনে সফলতার মানদন্ড একই রকম নয়। কেননা জীবনকে একেকজন একেকরকম ভাবে দেখে। সফলতা জীবনে সন্তুষ্টি আনে। কিন্তু সফল হওয়ার এই রাস্তা মোটেও সহজ নয়, অনেক চাপ ও ব্যার্থতার গ্লানি সামলে তাকে এগিয়ে যেতে হয়। তেমনি ১১ জন মানুষের গল্প এখানে রয়েছে যারা ব্যার্থতাকে ভালোবেসে সফলতার পথে এগিয়ে গিয়েছেনঃ
কর্ণেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স
কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন। এক রেসিপিতেই পুরো বিশ্বের স্বাদ বদলে গেলো। আশ্চর্যের ব্যপার হল বিখ্যাত এই রেসিপিই একদিন প্রায় এক হাজার নয় বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু মানুষটি যে কর্ণেল স্যান্ডার্স। তার মতে “মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি ব্যর্থতাই ভালো কিছু তৈরির একেকটি প্রস্তর”। KFC’র লাল লোগোতে থাকা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি জীবনে কখনই পিছিয়ে যাননি। ফ্রাইড চিকেন এর ছোট্ট সার্ভিস সেন্টারকে হাজার বাঁধা সত্ত্বেও তিনি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টে রূপান্তর করেছিলেন। পরে একটা সময় নিজের রেসিপির অধিকারস্বত্ব দুই মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানীর কাছে…
মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি ব্যর্থতাই ভালো কিছু তৈরির একেকটি প্রস্তর
স্বপ্নের গভীরতা তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতেন। তাইতো বলেছিলেন-“আমার ধারণা স্বপ্ন কিছু একটা শুরু করার পরামর্শ মাত্র”।
ওয়াল্ট ডিজনি
জীবনের মূলমন্ত্র ওয়াল্ট ডিজনি তার এই এক কথায় দিয়ে দিয়েছেন যা মেনে চললে আর কোন কিছুই অসম্ভব মনে হবেনা। আঁকাআঁকি ভালো লাগত তাঁর। সেই ভালো লাগা থেকে প্রতিষ্ঠা করেন সবাক স্টুডিও ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানী। একসময় তৈরি করেন বিখ্যাত কার্টুন মিকিমাউস এর প্রথম সংস্করণ মার্টিমার। কিন্তু জনপ্রিয়তা পেল না। পরে সেই মার্টিমারকেই মিকি মাউসে রূপান্তর করা হল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয় নতুন আইডিয়া আর ক্রিয়েটিভ নন একারণে । আজ অ্যানিমিশন জগতের জনক তিনি। মিকি মাউস থেকে শুরু করে আজকের ফ্রোজেন সবই ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানীর সৃষ্টি…
“প্রথম ভাবুন, দ্বিতীয়ত বিশ্বাস করুন, এরপর স্বপ্ন দেখুন এবং সবশেষে সাহসী হোন”
ওয়াল্ট ডিজনি সম্পর্কে জানতে Disney U বইটা সংগ্রহ করতে পারেন। বইটা মূলত ডিজনি কে ঘিরে, কিভাবে তারা অসাধারণ একটা কোম্পানি তৈরী করেছে, কিভাবে তারা তাদের কালচার ডেভেলপ করেছে সে বিষয় গুলো এখানে উঠে এসেছে। তাছাড়া ডিজিনি কোম্পানি নিয়ে যে কথাটি প্রচলিত আছে তা হলো ” কাস্টমারদের কিভাবে স্পেশাল ফিল করাতে হয় তা প্রত্যেক কোম্পানি ডিজনি থেকে শেখা উচিত ‘
সইচিরো হোন্ডা
জীবন শুরু হয়েছিল বাবার সাইকেল মেরামতের কাজ দিয়ে। সে সময় জাপানে সাইকেল খুব জনপ্রিয় ছিল। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত জাপানেই সইচিরো হোন্ডা শুরু করেছিলেন নিজের সাইকেল মেরামতের দোকান। নিজেই পিস্টন রিং তৈরি করে একদিন টয়োটা কোম্পানীর কাছে সাপ্লাইয়ের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরিয়ে দেয়া হয় তাকে।
‘সফলতা তোমার কাজের এক ভাগ মাত্র কিন্তু ৯৯ ভাগ ব্যার্থতার ফলাফলও এই সফলতা’
এভাবেই নানা ব্যর্থতা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিবেশে সইচিরো তৈরি করেছিলেন তার মোটর চালিত সাইকেল। আর প্রতিষ্ঠা করেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই হোন্ডা মোটরস কোম্পানী। আজও মানুষ মোটর সাইকেল বলতে চেনে কেবল হোন্ডা নামটিকে… হোন্ডা কোম্পানি অসাধারন কালচার নিয়ে লেখা একটি অসাধারন বই হচ্ছে Driving Honda: Inside the World’s Most Innovative Car Company
ফ্রেড স্মিথ
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালিন সময়ে টার্ম পেপারে ফ্রেড স্মিথ প্রথমবারের মত তার ফেডএক্স এর আইডিয়াটি শেয়ার করেছিলেন। যদিও শিক্ষকের খুব একটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু স্মিথ তার আইডিয়া ভুলে জাননি। এরই মাঝে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দিলেন স্মিথ। বিপুল সংখ্যক সেনা, তাদের খাদ্য ও অস্ত্র স্থানান্তর করতে গিয়ে তিনি ফেডএক্স প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করেন।
“ব্যার্থতার ভয় যেন আমাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণ না হয়”
ইলোন মাস্ক
ব্যতিক্রম ঘটেনি ইলোন মাস্ক এর জীবনেও। গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে যুক্ত হয়েছিলেন টেসলা মোটরস এর সাথে। প্রজেক্ট ছিল স্পোর্টসকার রোডস্টার এর ডিজাইন। অনেক পরিশ্রম করে রোডস্টার এর ডিজাইন তৈরি হল।
‘Stars cannot shine without darkness’
গুগল প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করল। কিন্তু এতোকিছুর পর গাড়ী যখন বাজারে ছাড়া হল ব্যবস্থাপনার কিছু ভুলের কারণে সরিয়ে নিতে বাধ্য হল টেসলা। এমন বিশাল ব্যর্থতার পরও ইলোন থেমে থাকেন নি। নতুন উদ্যমে পুরো প্রজেক্ট আবার ঢেলে সাজালেন। তারপরই টেসলা দেখল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
বইটি ইতিমধ্যে বিশ্বসেরা অন্যসব বায়োগ্রাফিতে জায়গা করে নিয়েছেন। বইটি চাইলে রকমারি ডট কম এর মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারেন। এতে মাস্কের উদ্যোক্তা জীবনের অনেক গল্প সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেছে।
আকিও মরিটা
বিখ্যাত সনি কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিটা।এমন অপ্রচলিত পথে চলতে গিয়েই শুরু করেছিলেন ইলেকট্রনিক্স রাইস কুকার দিয়ে। কিন্তু সেটি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ছেলেবেলা থেকে তার ইলেকট্রনিক্স এর প্রতি ছিল ভীষণ কৌতুহল। তাইতো মরিটা বলেন, “কৌতুহল সৃজনশীলতার চাবিকাঠি”। পরবর্তিতে এক আর্টিকেল দেখে পার্টনারশীপে শুরু করেছিলেন টোকিও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন।
“শুধুমাত্র অপ্রচলিত পথই সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে”
শুরুটা হয়েছিল ২০ জন কর্মচারী ও ১৯০০০০ ইয়েন দিয়ে। একটু একটু করে সফলতা পেতে থাকলে কোম্পানীর গ্লোবাল নাম দেয়া হল সনি কর্পোরেশন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রথমবারের মত জায়গা করে নিল জাপানিজ কোম্পানী সনি।
বিয়ার গ্রিলস
জীবন একটাই। তাই বিয়ার গ্রিলস জীবন সাহসের সাথে দখল করে নিয়েছেন। ছেলেবেলা থেকে রোমাঞ্চ তার পছন্দ। প্যারাশুট আরোহণ করতে গিয়ে একবার তিনি ১৬০০০ ফুট ওপর থেকে পরে যান। সেবার মেরুদন্ডের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়। এমন অবস্থা থেকেও দূর্ঘটনার ১৮ মাস পর মাত্র ২৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করে বিশ্বরেকর্ড করেন বিয়ার। তারপর শুরু করেন বিশ্বের জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার টিভি শো দি ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড। এখানেও পৌছে যান সাফল্যের চূড়ায়।
জ্যাকি চ্যান
হ্যা আমাদের চিরচেনা সেই কুংফু সম্রাট জ্যাকি চ্যানের চারপাশটা তার পছন্দ বিরুদ্ধ ছিল ঠিকই কিন্তু তাকে দমানো এতটা সহজ ছিল না। ছেলেবেলায় কুংফুর পাশাপাশি শিখেছিলেন অপেরা। কিন্তু লিখতে পরতে না জানা ছেলেটি শুধু অপেরা দিয়ে চাকরি জোটাতে পারল না।
পরিবেশ পরিস্থিত যেন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ না করে, বরং আশেপাশের পরিস্থিতি তুমি নিজের মত করে নাও
তাই বেছে নিলেন সিনেমায় স্ট্যান্টম্যানের কাজ। আর সেখান থেকেই তার প্রতিভার আলোকে আলোকিত হল গোটা ইন্ডাস্ট্রি। দ্য ইয়ং মাস্টার থেকে রাস আওয়ার এর মত দুনিয়া কাঁপানো সব ছবি উপহার দিতে থাকলেন একের পর এক।
জ্যান কৌম
নিজের জীবনের গল্প তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। ইউক্রেনের ছোট্ট একটা গ্রামে জন্ম জ্যান কৌমের। সে সময় দেশে চলছে ইহুদী বিরোধী আন্দোলন। এমন পরিস্থিতিতে দেশান্তরিত হতে হয় তার পরিবারকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল তবে ভালো লাগতো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। তাই পুরোনো কিছু বই ঘেঁটে পছন্দের বিষয়টি ঝালাই শুরু করেন। একসময় সিকিউরিটি টেস্টার হিসেবে যুক্ত হন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আর সেখানেই আরেক সহ প্রতিষ্ঠাতাকে জুটিয়ে নেন। হ্যা দুজন মিলেই তৈরি করেন বিখ্যাত Whatsapp। পরবর্তিতে ফেসবুক এই অ্যাপসটি ১৯ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়।
বব মার্লে
এমনি সুন্দর ভাষায় বব মার্লের গান ছিল পরিপূর্ণ। একসময় দারিদ্র্যের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে বড় হয়েছিল মানুষটি। কিন্তু হাতের গিটার কখনো সরে যায়নি। রেডিওতে গান শুনে শুনে গাইতেন বব মার্লে। আর এভাবেই নজরে পরে যান লেসলি কং এর। ‘Judge not’ নামে একক গান রেকর্ডিং করেন। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন গানটি দিয়ে।
“Don’t gain the world and lose your soul,
Wisdom is better than silver and gold”
জ্যামাইকায় নিজের দল ওয়েলার্স গঠন করেন। তখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার গান রচনা হতে থাকল বাফেলো সোলজার, রিডেমশন সং, নো উইমেন নো ক্রাই, ব্ল্যাক প্রোগ্রেস আরো কত কি! বব মার্লে দেখিয়ে গেছেন শুধু গান কিভাবে অধিকার রক্ষার্থে বুকের রক্ত রাজ পথে দিতে শেখায়…
আলি বাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা, যার সর্বমোট সম্পত্তির পরিমান ১৬০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। কিন্তু তার শুরুর পথ টা খুব একটা মসৃন ছিলো না। তিনি প্রাইমারিতে ২ বার, মাধ্যমিকে ৩ বার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৩ বার ফেল করেন তিনি। চীনে যখন কেএফসি আসে তখন ২৪ জন চাকরীর জন্য আবেদন করেন, তার ভিতরে ২৩ জনের চাকুরী হয় আর একমাত্র যিনি বাদ পরেন তিনি জ্যাক মা।
Never give up. Today is hard, tomorrow will be worse, but the day after tomorrow will be sunshine
তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ১০ বার আবেদন করে ১০ বারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি হেরে যাননি বরং বার বার ঘুরে দাড়ানোর চেস্টা করেছেন আর লেগেছিলেন নতুন কিছু করার পথে। জ্যাক মা কে নিয়ে লেখা সেরা আত্মজীবনী লিখেছেন Duncan Clark, বইটির নাম হচ্ছে Alibaba: The House that Jack Ma Built
আপনার জীবনও কম ঘটনাবহুল নয় আমরা জানি , পথ সবসময় মসৃণ হবে তেমন আশা না করাটাই শ্রেয় , আসুন সৎ পথে নিষ্ঠার সাথে চলতে থাকি , বিশ্বাস করি পথ যেমনই হোক আমি সেই পথে চলতে পারবো বুক উঁচিয়ে যেখানে সফলতা হাটঁবে ঠিক পাশা-পাশি হাত ধরে ..
আরো দেখুনঃ
comments (1)
Pingback: ইহুদী জাতির ইতিহাস । আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ - রকমারি ব্লগ