‘বই’ কেবল একটি শব্দ নয়, একটি অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীর নাম। যেখানে নেই কোনো হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ অথবা নৃশংসতা। নেই কোনো হতাশা। কেবল আছে শান্তির প্লাবন আর ইচ্ছে ঘুড়ি হয়ে কল্পনায় যখন তখন হারিয়ে যাওয়ার উদারতা। জীবনের রোলার-কোস্টারে যখন নিজেকে জর্জরিত মনে হয়, তখন একটি ভালো বই পারে সকল মানসিক চাপ ভুলিয়ে দিতে। আপনি যখন বইয়ের জগতে ঢুকে যাবেন, আপনার অবচেতন মন তখন সেই জগতকেই বাস্তব বলে ভাবতে শুরু করবে। প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর মতে,
“ লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়। তার কারণ, আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হলো মনের হাসপাতাল। ”
আপনি যখন এমন একজন মানুষের কথা পড়বেন যিনি কিনা বিশাল বিশাল সব বাধা টপকে তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেছেন, তখন তা আপনার মাঝে দারুন এক উদ্দীপনার জন্ম দেবে। যত খারাপ অবস্থাতেই আপনি থাকুন না কেন, সব সময় আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগ্রহী আর আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। সব সময়ই আপনি মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণার মাঝে থাকবেন।
অনেকেই আছেন যাঁরা বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ব্যর্থতার ভয় তাদের সামনে এগুতে বাধা দেয়। একটি ভাল মোটিভেশনাল বই এক্ষেত্রে কতটা উপকারে আসে – তা যে না পড়েছে, সে বুঝবে না।
এখানে ২০২১ সালের বেস্টসেলার ৭টি দুর্দান্ত মোটিভেশনাল বইয়ের নাম দেয়া হলো যা অবশ্যই সবার কালেকশনে থাকা উচিত।
১। যুক্তিফাঁদে ফড়িং — চমক হাসান
দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে বা সােশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের লজিক্যাল ফ্যালাসি বা যুক্তির ভ্রান্তির সম্মুখীন হই। অনেক সময় আবার তর্কের খাতিরে নিজেরাও অনেক যুক্তি দিয়ে থাকি, যা হয়তাে ভ্রান্ত যুক্তির আওতায় পড়ে। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার জন্য আমরা তা বুঝতে পারি না।
‘যুক্তিফাঁদে ফড়িং’ বইটিতে মজার সব উদাহরণ দিয়ে ২৪ টি লজিকাল ফ্যালাসি বা যুক্তির ভ্রান্তি নিয়ে গল্প করা হয়েছে। যেমনঃ Ad Hominem বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ, Red Herring বা প্রসঙ্গ ঘােরানাে, No True Scotmans বা লেখকের ভাষায় প্রকৃত বাঙালী ভ্রান্তি, Hasty Generalization বা ঢালাও সিদ্ধান্ত সহ মোট ২৪ টি ভ্রান্ত যুক্তি নিয়ে সাধারণের বােধগম্য ভাষায় আলােচনা করা হয়েছে ।
বইয়ের মূল চরিত্র হাসিব, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেই শখের বশে শিক্ষক হিসেবে গ্রামের স্কুলে যোগ দেয়। গণিত বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও সে দ্রুতই বুঝতে পারে, ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিবোধ শাণিত করাটাই আগে জরুরি। তাদের ফড়িংয়ের মতো অস্থির মন যেন কুযুক্তির ফাঁদে পড়ে পথ না হারায়, এজন্য তাদেরকে যুক্তির নানা ভ্রান্তির গল্প শোনায় সে। গল্প শোনাতে শোনাতে সেও কি একটু একটু করে নিজেকে আবিষ্কার করে?
২। কর্পোরেট কমিউনিকেশন — রোকসানা আক্তার রুপী
রোকসানা আক্তার রুপীর ‘কর্পোরেট কমিউনিকেশন’ বইটি গ্র্যাজুয়েট থেকে শুরু করে বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল, সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির জন্যও একটি সার্বিক নির্দেশিকা। খুব অল্প সময়ের চেষ্টায় নিজেদের ওয়ার্ল্ড ক্লাস কর্পোরেট প্রফেশনাল হিসেবে গড়ে তুলতে এই একটি বই-ই যথেষ্ট।
যা যা আছে এই বইতে —
কর্পোরেট রাইটিংঃ প্রফেশনাল ই-মেইল এবং অফিসিয়াল লেটার লেখার অসংখ্য স্যাম্পল।
কর্পোরেট স্পিকিংঃ প্রফেশনাল কথোপকথন, প্রেজেন্টেশন এর আন্তর্জাতিক কৌশল সমূহ ও ইংরেজিতে কমিউনিকেট করার উদাহরণসহ বিস্তারিত বর্ণনা।
কর্পোরেট এক্সপ্রেশনঃ একজন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট অফিসার হিসেবে ইংরেজিতে দৈনন্দিন কমিউনিকেশনের জন্য আছে অসংখ্য বিজনেস ইংলিশ এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফ্রেজেস।
৩। চেষ্টার জিমনেসিয়াম ফিউচারের ক্যালসিয়াম — ঝংকার মাহবুব
এই বইটিতে একজন সিনিয়র তার জুনিয়রকে পড়াশােনা এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়ােজনীয় সব উপদেশ এবং দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর এই দিক নির্দেশনাগুলােই লেখক ঝংকার মাহবুব বেশ গুছিয়ে লিখেছেন তাঁর ‘চেষ্টার জিমনেসিয়াম ফিউচারের ক্যালসিয়াম’ বইতে, যা পড়ে আপনি অবশ্যই মােটিভেটেড ফিল করবেন। তবে মােটিভেশনাল বই বলার আগে অবশ্যই সেলফ–হেল্প ক্যাটাগরিতে বইটিকে রাখতে হবে।
ইন্টারে ওঠার পরের সময়টা কমবেশি সবার জীবনেই খুব বেশি ক্রিটিক্যাল। এ সময় অনেক নতুন মানুষের সাথে দেখা হয়, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিতে হয়। ফলে এ সময় আমরা অনেকেই এক প্রকার হতাশায় ভুগি। হতাশা বললে ঠিক হবে না, আসলে ভুগি সিদ্ধান্তহীনতায়। কোন সময়ে কোন টা করবো, কি করা উঠিত, কার সাথে আড্ডা দেওয়া উঠিত ইত্যাদি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা। এই বই মূলত ঐসব ভুক্তভুগিদের জন্যই।
কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে অনেকেই ভাবে, “আমার যদি একজন মেন্টর থাকতাে, তাহলে বেশ ভালাে হতাে ! আমার বড় ভাই বা বােন থাকলে তাকে ফলাে করতে পারতাম। অভিজ্ঞ কারাে কাছে এই ব্যাপারটা নিয়ে জানতে পারলে ভালাে হতাে।” — তাদের জন্য এই বইটি একদম সেরা একটি গাইডলাইন হতে পারে বলে মনে করি।
সূচিপত্র পড়লেই মনে হবে, “এই বইটা কতক্ষণে পড়ে শেষ করবাে !”
৪। ঠিক বেঠিক মার্কেটিং — গালীব বিন মোহাম্মদ
মানুষ শেখে দু’ভাবে — দেখে আর ঠকে। এই বইয়ের ২১ টি লেখার কোনোটিই কোনো থিয়োরি বা তত্ত্বকথা নয়। বরং প্রতিটি লেখাই লেখক তাঁর প্রায় দেড়-যুগের মার্কেটিং প্রফেশনে দেখে এবং ঠকে যা শিখেছেন তারই প্রকাশ। একজন মার্কেটার হিসেবে নিজের পর্যবেক্ষণ, কেস-স্টাডিস আর একাডেমিক থিয়োরির সংমিশ্রনে বাংলাদেশের মার্কেটিং এর বিভিন্ন প্র্যাকটিসের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্য খোঁজার চেষ্টা ‘ঠিক বেঠিক মার্কেটিং’।
যেহেতু পুরোটাই লেখকের নিজের অবজার্ভেশন, তাই সাধারণ পাঠক কিংবা একজন মার্কেটার হিসেবে আপনার তাতে একমত হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। অবলীলায় দ্বিমতও পোষন করতে পারেন। তবে একমত বা দ্বিমত যা-ই হোক না কেন, লেখাগুলো যারা মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করছেন, মার্কেটিং প্রফেশনে কেবল যাত্রা শুরু করেছেন, পোড়-খাওয়া অভিজ্ঞ মার্কেটার কিংবা নবীন উদ্দ্যোক্তা — সবাইকেই মার্কেটিং জগতের নানান ঠিক এবং বেঠিক প্র্যাকটিস নিয়ে ভাবতে সন্দেহাতীতভাবে সাহায্য করবে, যা দিনশেষে নিজের ব্র্যান্ড কিংবা ব্যবসাকে দাঁড় করাতেও কাজে আসবে।
৫। লিডারশিপ ইন্টেলিজেন্স — তানভীর শাহরিয়ার রিমন
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে নানা রকম চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হতে হয়। টার্গেট ছোঁয়ার জন্য অনেক বিজনেস লিডাররা হায়ার-ফায়ারে সমাধান খোঁজেন। যেখানে প্রতিদিন বিজনেস ডায়নামিকসগুলো বদল হচ্ছে, সেক্ষেত্রে টার্গেট ছোঁয়ার অসীম চাপ সামলে একজন লিডারকে একই সাথে লক্ষ্যে পৌছানোর সফলতা স্পর্শ করার পাশাপাশি একজন মানবিক নেতা হওয়ার ভীষণ ধ্রুপদী চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে নিয়মিত।
সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই লিডারশিপ ইন্টেলিজেন্স। কেবল সিইও-দের জন্যই নয়। এই বইটি একজন সাধারণ কর্মী, টিম লিডার, বিভাগীয় প্রধান কিংবা সি-স্যুইটে অবস্থানরত সিএক্সও-দের জন্যও হবে একটি আই ওপেনার !
এই বই থেকে পাঠক জানতে পারবে — কেবল আবেগ শক্তি দিয়ে নয়, কীভাবে নিজেদেরকে সত্যিকারের নেতা হিসেবে তৈরি করা সম্ভব তার নানা উপায়, হ্যাকস ও জীবন থেকে নেওয়া গল্প। এমন নেতা যে টার্গেট মিট করবে, কর্মীদের ভালােবাসবে, তাদের পাশে থাকবে, আবার ঠিকই তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। যার সততা ও অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
৬। বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ — মুনির হাসান
স্টার্টআপ মানে একটি নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা। একটি স্টার্টআপ এর ভ্যালু যখন ১ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ইউনিকর্ন। এই বইয়ের প্রচ্ছদে তাই রয়েছে কাল্পনিক প্রাণী ইউনিকর্নের ছবি। কিন্তু বিলিয়ন ডলার মানে কতো টাকা? শূন্য ঠিকঠাকমতো বসিয়ে সেটিকে ৮৫ টাকা দিয়ে গুণ করার পর বোঝা গেল ঘটনাটি আসলে জটিল। কারণ টাকার পরিমাণটা হচ্ছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ! এতো টাকা কেমন করে হিসাব করা যায় !
লেখক মুনির হাসান এ বইতে ভিন্ন আঙ্গিকের ১৩ টি স্টার্টআপ নিয়ে কথা বলেছেন। যেমনঃ হাতের কাছে আছে আমাদের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বানাতে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে চার বিলিয়ন ডলারের একটু কম। আবার রয়েছে ফেসবুকের কথা, রয়েছে বেডিং কোম্পানি ক্যাসপারের কথা।
‘বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ’ বইটিতে নতুন করে শুরু হওয়া একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে ইউনিকর্ন হয়ে ওঠে, সে গল্প-ই শুরু থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। গল্পে গল্পে জানা যাবে, বিলিয়ন ডলার কোম্পানিগুলো কেমন করে তৈরি হয়, তাদের আইডিয়া থেকে বিকাশের পথ পরিক্রমা। গল্পের সঙ্গে কখনো কখনো ভেসে উঠবে গল্প থেকে শেখার অংশও।
উদ্দেশ্য একটাই — এক সময় আমাদেরও যেন বিলিয়ন ডলারের অনেক গল্প তৈরি হয়।
৭। রিস্টার্ট ইয়োরসেলফ — জাভেদ পারভেজ
‘রিস্টার্ট ইয়ােরসেলফ’ নিজেকে ভালাে রাখার একটি বিশেষ কৌশল । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শন এবং বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া নেতৃত্বের ধারণাগুলাে থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বইটি লেখা হয়েছে ।
এখানে একদিকে রয়েছে বুদ্ধের জীবনবােধ, যােগিক কৌশল, বিভিন্ন ধর্মীয় দর্শনের উপজীব্য ইত্যাদি। অন্যদিকে রয়েছে ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের দর্শন কিংবা স্টিফেন কোভে, উনি রবিনস ও রবিন শর্মার আধুনিক নেতৃত্বের মূলপাঠ। আছে মিহাই চিক্সেন্ট মিহাইয়ের মতাে আধুনিক সাইকোলজিস্টের গবেষণা ফলাফল এবং একার্ট টোলের মতাে বিশ্বনন্দিত স্পিরিচুয়াল গুরুর শিক্ষা। সাথে আছে পজিটিভ সাইকোলজি, নিউরােলজি ও নিউরাল নেটওয়ার্কের সর্বশেষ জ্ঞান। এসব গভীর বিষয়কে খুব সহজ উপায়ে, প্রাঞ্জল ভাষায় এবং অনেক গল্প ও উদাহরণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে যে কেউ তার জীবনকে সঠিক পথে চালিয়ে নিতে পারেন, নিজেকে রিস্টার্ট করতে পারেন ।
বইটিতে উপস্থাপিত বিষয়গুলােকে নিজেদের জীবনে প্রয়ােগ করে ইতােমধ্যেই অনেক মানুষ সুফল পেয়েছেন, পাচ্ছেন। কাজেই বইটির কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই ।
জীবন একটু সহজ হয়ে যায় যখন আমরা স্বীকার করে নেই যে, জীবন-যুদ্ধে নিজ লক্ষ্যগুলি অনুসরণ করতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে চ্যালেঞ্জ আর বাধা-বিপত্তি আসবেই। এমন মুহূর্তে মানুষ অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজে ফেরে। খুঁজে ফেরে একটি সঙ্গী। অনুপ্রেরণার একটি অন্যতম উৎস মোটিভেশনাল বই। আপনার অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে এই সঙ্গীকে বেছে নিতে পারেন। আশা করি উপকৃত হবেন।