নিজের ঘরে বসে অস্থিরভঙ্গিতে পত্রিকা পড়ছেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর শরীর অত বেশি ভালো না। সঙ্গে যোগ হয়েছে স্ত্রীর শরীর খারাপ। খারাপ শরীরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি। বঙ্গবন্ধু পরিষদে যোগ দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অভিজ্ঞতার দৃষ্টিতে আবুল মনসুর আহমেদের ধারণা, পরিষদে যোগ না দিলে দেশে একটা যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আবার অন্যদিকে যদি এই মুহূর্তে আবেগে যুদ্ধের ডাক দিয়ে দেয়া হয়, তবে নির্বিচারে পাকিস্তানিরা মানুষ হত্যা করতে থাকবে। এই দ্বন্দ্বে কী করা উচিত সেটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। সবার দৃষ্টি শেখ মুজিবর রহমানের দিকে। তাও অন্তত পরিষদে যোগ দেবার অনুরোধ করবেন বলে ভাবলেন আবুল মনসুর আহমদ। ফোন দিলেন ধানমন্ডির বাসায়। কেউ ফোন ধরলো না। সেখানে নেমে এসেছে রাজ্যের ব্যস্ততা।
৭ই মার্চ ১৯৭১
সকাল নয়টা
আবুল মনসুর আহমদ বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠালেন তাঁর ছোট ছেলেকে দিয়ে। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মাহবুব আনামকে পাঠালেন এই মর্মে, যে কোনোভাবেই হোক, শেখ মুজিবর রহমান যেন তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। অন্তত দুপুরে ভাষণ দেবার আগেই। আবুল মনসুর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ফোন পেলেন কিছুক্ষণ পর। ফোনের কথাপোকথনটি আবুল মনসুর আহমেদের লেখা বিখ্যাত বই ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ থেকে হুবহু তুলে দেয়া হলো।

‘আমি সোজাসুজি কথায় গেলাম। বলিলামঃ পরিষদ তোমার। ন্যায়তঃ ও আইনতঃ তুমি হাউসের নেতা। ওটা আসলে তোমারই বাড়ি। নিজের বাড়ি যাইতে শর্ত কর কার সাথে? ইয়াহিয়া অনধিকার প্রবেশকারী। তাঁর সাথে আবার শর্ত কী?’
আমি বোধ হয় রাগিয়া গিয়াছিলাম। মুজিব হাসিলেন। বলিলেনঃ ‘এত সব হত্যাকান্ডের পরও আবার আমাকে পরিষদে যাইতে বলেন?’ চট করিয়া খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘মৃতদেহ’ কথাটা মনে পড়িল। বলিলামঃ ‘হাঁ, নিজের লোকের মৃতদেহের উপর দিয়াই তুমি পরিষদে যাইবা। কারণ ও-বাড়ি তোমার। সে বাড়িতে ডাকাত পড়িয়াছে। তোমার বাড়ির কিছু লোকজন ডাকাতের হাতে খুন হইয়াছে। ডাকাত তাড়াইবার জন্য তোমার নিজের লোকজনের মৃতদেহ পাড়াইয়া বাড়িতে ঢুকিতে হইবে। ডিক্টেটর ইয়াহিয়া জনমতের চাপে আওয়ামী লীগের দাবীর সামনে মাথা নত করিয়াছেন। কাজেই আগামী কালের সভায় তুমি বিজয়-উৎসব উদযাপনের নির্দেশ দিবা।‘ শেখ মুজিব আসলে রসিক পুরুষ। আমার উপমাটা তিনি খুব উপভোগ করিলেন। বিজয়-উৎসবের কথায় খুশি হইলেন। হাসিলেন। বলিলেনঃ ‘আমার আজকের বক্তৃতা শুনিয়েন। রেডিওতে ব্রডকাস্ট হইবে সোজাসুজি ময়দান হইতে। আপনার উপদেশ মতোই কাজ হইবে। কোনো চিন্তা করিবেন না। দোওয়া করিবেন।‘ ‘লিভ ইট টু মি’, ‘কোনও চিন্তা করিবেন না’, ‘দোওয়া করিবেন’ কথা কয়টি মুজিব এর আগেও বহুদিন বলিয়াছেন। আত্ম-প্রত্যয়ের দৃঢ়তার সুস্পষ্ট প্রকাশ। কথা কয়টা ওঁর মুখে শুনিলেই আমি গলিয়া যাইতাম। ও দিনও গলিলাম। মানে, আশ্বস্ত হইলাম।
৭ই মার্চ ১৯৭১, সকাল সাড়ে দশটা
ধানমন্ডি, ঢাকা
বাসার সামনে প্রচন্ড ভীড়। ছাত্রদের কিছু দল আলাদা আলাদা হয়ে মুহুর্মুহু মিছিল দিচ্ছে। পরিবেশ উত্তপ্ত না হলেও যে কোনো সময় হয়ে উঠতে পারে। ছাত্রদের দাবী একটাই- এতসব বর্বরতার পর কোনোভাবেই কোনো আলোচনা হতে পারে না। সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে হবে। আজকের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য দাবী জানানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আছেন তাজউদ্দিন আহমদ। ডা. কামাল হোসেন এবং তাজউদ্দিন আহমেদ সহ আরো বেশ কয়েকজনকে নিয়ে বসলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তার উপর তখন সমূহ চাপ। ঠিক এই মুহূর্তে তাঁর কী করা উচিত?
চলুন আমরা ইতিহাসের সেই সময়টায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তত্বকে আরেকটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। সকালে আবুল মনসুর আহমদ ফোনে জানিয়েছেন, পরিষদে না যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। বরং পরিষদে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার অপরদিকে ছাত্রসহ আন্দোলনকারীদের রক্ত গরম। তারা এত বর্বরতা সহ্য করতে পারছে না। তারা শুধু চায় স্বাধীনতার ডাক। এদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কোনো কথা ছাড়াই গুলি করা শুরু হবে এটা সুনিশ্চিত। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়, ‘পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না’। বোঝাই যাচ্ছে প্রায় সব দিক থেকে প্রচন্ড পরিমান মানসিক চাপে ছিলেন তিনি।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ওঠার কথা ছিলো দুপুর দুইটা নাগাদ। লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হতে চলেছে সবাই সেটা জানতো। ইতোমধ্যে কলরেডি মাইক্রোফোন নিয়ে প্রস্তুত আছে এটা তাঁর জানা ছিলো। কিন্তু তাঁর যেটা জানা ছিলো না, তা হলো- ভাষণটি কোনোভাবেই লাইভ সম্প্রচার করা সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে সব বেতার কর্মীরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে বাইরে চলে এসেছেন এটা তার ধারণারও বাইরে ছিলো। কিন্তু আমরা বরং মাইক্রোফোনের দিকে ফিরে তাকাতে পারি। সেই আগুন ঝরা দিনটিতে কিভাবে পুরো ময়দান জুড়ে মাইক্রোফোন লাগানো হয়েছিলো?
তখন রাজনৈতিক যে কোনো সভা-সমাবেশে এ দায়িত্ব পালন করত ‘কলরেডি’। এত বছর পরেও রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘কলরেডি’ শিরোনামের মাইকের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। ভাষণের আগের দিন কলরেডি মাইকের স্বত্বাধিকারী কানাই ঘোষ এবং তাঁর অপর দুই ভাই নিজেরা মিলেই পুরো ময়দান জুড়ে মাইক্রোফোন ও সাউন্ড সিস্টেমগুলো বিন্যাস করেছিলেন। পুরান ঢাকার কলরেডির অফিস থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাইকের জিনিসপত্র রেসকোর্স পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটাই ছিল এক ধরনের অগ্নিপরীক্ষা। কলরেডির পরিচালক সাগর ঘোষ ও তাঁর চাচা কানাই ঘোষের দেওয়া তথ্য মতে, সেদিন ৭০টিরও বেশি মাইক লাগানো হয়েছিলো পুরো রেসকোর্স ময়দান জুড়ে। মাইক্রোফোন ঠিকঠাক লাগানো হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য তাঁরা গিয়েছিলেন রাতের আঁধারে। সময় নিয়ে ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে ও গাছের ওপর মাইক বসিয়েছিলেন তাঁরা। এক রাতে মাত্র কয়েকজন মিলে এমন নিখুঁতভাবে কাজটি করেছিলেন যে, পরদিন ৭ই মার্চের দুপুরে এত মানুষের মধ্যেও কোনো ঝামেলা ছাড়াই সাউন্ড সিস্টেম কাজ করেছিল ঠিকঠাক।
কিন্তু মাইক্রোফোন ঠিক হলে কী হবে, বারোটা নাগাদ সামরিক বাহিনী থেকে বার্তা আসে ঢাকার বেতার কেন্দ্রে এই মর্মে যে, কিছুক্ষণ পর দেয়া ভাষণ কোনোভাবেই সরাসরি প্রচার করা যাবে না। এটিও ছিলো এক ধরণের চোখ রাঙানী। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আসন্ন ভাষণের তাৎপর্য বেশ ভালো ভাবেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তখনকার সাংবাদিকরা। তাই তারা সরাসরি সম্প্রচারে বাধা পেয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এবং অনেকেই চলে যান সভাস্থলে। মুশকিল হলো, সরাসরি সম্প্রচারের পরিকল্পনা থাকায় আগে থেকে সেভাবে রেকর্ড করার প্রস্তুতি ছিলো না। অন্যদিকে সবার অজান্তেই পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের মিলে ভাষণটির ভিডিও রেকর্ড করার পরিকল্পনা গোপনে আগেই করে রেখেছিলেন, যা না হলে হয়তো আজকে আমরা ভিডিও ফুটেজে ভাষণটি দেখতে পারতাম না।
প্রস্তুতিবিহীন ভাষণ
আমরা বরং ভাষণে ফিরে যাই। এটির কোন স্ক্রিপ্ট ছিলো না। এমনকি কেউ জানতোই না কী কথা আসতে চলেছে। সভাস্থলে যাওয়ার সময় গাড়ি যখন সাতরাস্তা এলাকায় তখন গাড়িতে থাকা মোরশেদ কিছুটা কৌতূহলবশতই জিজ্ঞেস করে বসলেন—‘আজ ভাষণে কী বলবেন?
বঙ্গবন্ধুর উত্তর—‘দেখি, আল্লাহ মুখ দিয়ে কী বের করে।’
সুতরাং একদম প্রস্তুতিহীন এই ভাষণের বাক্যের ব্যবচ্ছেদ এবং গলার ওঠানামা আমাদেরকে ভাষণটির শক্তিশালী হওয়ার পেছনের দিকগুলো বুঝতে সহায়তা করবে। আপনি যদি খেয়াল করেন, তিনি ভাষণটি শুরু করছেন দুঃখ প্রকাশ করে। ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’। ভাষণটি এমন সময় দিতে হচ্ছে যে, সব দিকে চেষ্টা করা হচ্ছে সমাধানের জন্য কিন্তু আমাদের অধিকার নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। দিন দিন ঢাকা ও বাইরের অঞ্চলগুলোতে পাক হানাদার বাহিনীরা খুন করে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংলাপ করার একটা তামাশা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুকেই এড়িয়ে যাননি। অপরদিকে বাংলার মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু তিনি যুদ্ধকে এড়িয়ে সমাধান দিতে পারছেন না। সাথে সাথে এটাও জানেন, যুদ্ধের ডাক দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সামরিক বাহিনী। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে নিজেরও অসহায় লাগা স্বাভাবিক। এর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির’ হওয়া।
এছাড়া পুরো ভাষণ জুড়েই রয়েছে বিশেষ বাক্যে কণ্ঠের ওঠানামা। তবে তারচেয়ে বড় বিষয় হলো, ভাষণের বাক্যচয়নে রয়েছে বেশ অদ্ভুত শক্তির উচ্ছ্বাস। তিনি বাঙালীর রক্ত ও অসহায়ত্বের ইতিহাস স্মরণ করাচ্ছেন এবং শেষে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন-
‘দোষ কি আমাদের?’
এত এত মানুষের রক্ত নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় আমাদের দোষের জায়গা কি আদৌ আছে? তিনি বলছেন, ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও তার কথা মেনে নেবো’। এখানে ‘আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও’ বাক্যাংশটি না বললে কী হতো? বাক্যের অর্থ কিন্তু পরিবর্তন হতো না। কিন্তু আমাদের অসহায়ত্ব এবং তোমাদের বর্বরতার মাঝেও যে আমরা কোনোভাবেই দয়া ভিক্ষা করছি না; বরং ন্যায্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে জয়লাভ করেই কথা বলছি, তিনি সেটা উল্লেখ করছেন মাত্র কয়েকটি শব্দকে যোগ করে, যা বাক্যটিকে অনন্য এক শক্তির জায়গায় নিয়ে গেছে। এমনি করে পুরো ভাষণে আমরা বিভিন্ন শব্দচয়নের বৈচিত্র্য দেখতে পাই।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখের এতদিন পেরিয়েও গেলেও আমাদের মধ্যে এখনো বিস্ময় কাজ করে কিভাবে কয়েক মিনিটের ভাষণ পুরো ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছিলো। কিন্তু খেয়াল করলে আমরা বুঝি, মনস্তাত্বিকভাবে ভাষণটির তাৎপর্য ছিলো বেশ প্রাসঙ্গিক। সেই দিনটার মতো, যেদিন ভাষণ শেষে ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। আকাশটা ছিলো রোদে ভরা।
তথ্যসূত্রঃ
১. বিবিসির কাছে তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার
২. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (আবুল মনসুর আহমদ)
৩. নেতা ও পিতা (শারমিন আহমদ)
৪. দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত)
বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জানতে আরও যেসব বই পড়বেন