অনেক দিন আগের কথা। লুসি হ্যাংক্স নামের এক সুন্দরী তরুণী প্রেমে পড়েছিল এক ধনাঢ্য খামার মালিকের। খামার মালিক তাকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন তার বাড়িতে। সেটা এমন এক সময়ের কথা, যখন কাজের লোকেদের পড়াশোনা শেখানোর কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না। কিন্তু কাজ করতে করতে লুসি টের পেল পড়াশোনার প্রতি এক দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। খামার মালিকও সুন্দরী লুসির প্রেম টের পেয়ে তাকে পড়াশোনা করাল গোপনে গোপনে। প্রেমে মজে গেল একসময় লুসি। খামার মালিকের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করে দিলো সে। আর খামার মালিকও তাকে কাছে টেনে নিতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু লুসির সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়ার পর প্রকাশিত হলো খামার মালিকের সত্যিকারের চেহারা। লুসির সন্তানকে সে অস্বীকার করলো। কেননা- লুসি যে তারই বাড়ির পরিচারিকা। তখনকার গোঁড়া খ্রিস্টীয় সমাজের কাছে অপরিসীম লাঞ্ছনার শিকার হতে হলো সুন্দরী লুসিকে। এরকম সময়ে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন এক মহানুভব যুবক, নাম তার হেনরি স্প্যারো। লুসির সেই কন্যা সন্তানের নাম রাখা হলো ন্যান্সি। পরবর্তীতে ন্যান্সি হ্যাংক্স ভালোবেসে বিয়ে করেন টমাস লিংকন নামের কেন্টাকির এক ভবঘুরেকে। তাদের ঘর আলো করে যে ছেলে জন্মালো, তারই নাম রাখা হলো আব্রাহাম।
দাসপ্রথার অন্ধকার সময়ে লিংকনের জন্ম
সত্যিকার অর্থেই এমন এক অন্ধকার সময়েই লিংকনের জন্ম, যখন এক মানুষের কাছে অপর মানুষের মূল্যায়ন মানুষ হিসেবে হত না। পদ-পদবী-শ্রেণী বৈষম্য, আরও সুপষ্ট করে বললে মর্মান্তিক দাসপ্রথা আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল আমেরিকান সমাজকে।
দিদার মতোই তেমন কোনো শিক্ষার সুযোগ পাননি লিংকনের মা ন্যান্সি। আমেরিকার প্রত্যন্ত প্রদেশের গভীর বনাঞ্চল ঘেরা গাঁয়ে শিক্ষার আলোবিহীন কেটে গিয়েছিল তার জীবনটা। আব্রাহামের পিতা টমাস লিংকনও খুব একটা কাজের মানুষ ছিলেন না। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো আর হরিণ শিকার করাতেই ছিল তার আনন্দ। লোকে তাকে নিতান্ত একটা অপদার্থ হিসেবেই জানত। ঠিক এরকম এক অশিক্ষিত, মজুর পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে আব্রাহাম লিংকন বনে গিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, শুনতে রূপকথার মতো মনে হলেও বহু চড়াই-উতরাই আর যন্ত্রনার দাহ রয়েছে তাঁর জীবনের গল্পে।

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠা
১৮১৬ সাল। আব্রাহামের বয়স তখন সাত। নানান ঝামেলায় পড়ে কেন্টাকি অঞ্চলের জমি বিক্রি করে তাদের চলে আসতে হলো ইন্ডিয়ানা রাজ্যে। এখানে প্রায় ১৬০ একরের একটা খামারের মালিকানা লাভ করল টমাস লিংকন। চারদিকে ঘন অঞ্চল। মানুষের জনবসতি নেই, কেবল এক ভালুক শিকারী বাস করে কাছাকাছি কোথাও। সেই সাথে আছে নিষ্ঠুর শীতের থাবা। ভয়ানক প্রাকৃতিক বৈরীতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে লাগল আব্রাহামের জীবন। ভালুকের চামড়া গায়ে চাপিয়ে কোনোরকমে জড়াজড়ি করে কাটাতে হত শীতের সময়গুলো। বুনো ফল আর বাদামই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। আব্রাহাম বহু দূরের এক ঝর্ণা থেকে নিজেদের পানীয় জল সংগ্রহ করে আনতেন আর বাবাকে সাহায্য করতেন চারপাশের জঙ্গল সাফ করার কাজে। দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত একটা কাঠের বাড়ি তৈরি হলো। দারিদ্র্য যে কত কঠিন আর কঠোর, তা লিংকন যেসব দাসকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন একদিন, তারাও কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি হয়তো। কিন্তু এখানেই দুর্ভাগ্যের শেষ নয়।
মায়ের মৃত্যু ও দুঃখময় দিনগুলো
১৮১৮ সাল। মিল্ক সিকনেসের শিকার হয়ে মারা গেলেন আব্রাহামের মা ন্যান্সি। নিজেরাই কাঠ থেকে কফিন তৈরি করে কবরে শায়িত করলেন ন্যান্সিকে। প্রচন্ড একা হয়ে গেলেন আব্রাহাম। মায়ের অসহ্য সংগ্রাম আর যন্ত্রণার স্মৃতি আব্রাহামের মনে চির জাগুরুক ছিল।
ন্যান্সিকে সত্যিই বড় ভালোবাসতেন টমাস। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার মধ্যে পুনরায় দেখা দিলো ভবঘুরে স্বভাব। বনে বাদাড়ে ঘুরে, উদাসীন জীবন কেটে যেতে লাগল কোনো একভাবে। এক রকম নিস্পৃহতা ভর করল টমাসের মনে। এ সময় সারা নামে এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় টমাসের। কিছু দেনা শোধের শর্তে পরবর্তীতে টমাসকে বিয়ে করে নেন সারা। আব্রাহাম লিংকন তাকে কখনো নাম ধরে ডাকেননি, সৎ মা পরিচয়ও দেননি, সরাসরি ‘মা’ পরিচয়ই দিতেন। লিংকনের লিংকন হয়ে ওঠার পেছনে ছিল তাঁর দ্বিতীয় মায়ের বড় অবদান।
প্রকৃতিই ছিল লিংকনের সত্যিকারের শিক্ষক
১৮২৪ সালের কোনো এক সময়ে স্কুলে যেতে শুরু করেন লিংকন। প্রায় চার মাইল দূরের স্কুলে বন-জঙ্গল ভেঙে হেঁটেই যাওয়া-আসা করতে হত তাঁকে। তীব্র দারিদ্র্যের কষাঘাতে খুব বেশি একটা শিক্ষাগ্রহণ করা হয়নি লিংকনের। কিছুদিন এখানে, কিছুদিন ওখানে, সাকুল্যে হয়তো ১০-১২ মাস হবে তা। কিন্তু জীবনের কঠিন পথচলা আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৃতি থেকে যে শিক্ষা তিনি নিতে পেরেছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান আজ অব্দি মানুষকে তা দিতে পারেনি। লিংকন ছিলেন একজন সেলফ লার্নার। পড়তে তিনি শিখেছিলেন, যখন যে গ্রন্থগত বিদ্যের দরকার হয়েছে, নিজেই পড়াশোনা করে অর্জন করে নিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি একজন আইনজীবীও হয়েছিলেন।

বহুমুখী পেশাগত জীবন ও চড়াই উৎরাইয়ের রাজনীতি
পেশাগত জীবনে কী করেননি লিংকন? ফ্ল্যাটবোটের চালক, ভাঁড়ারঘরের দারোয়ান, ডাকপিয়ন, ছুতার, আইনজীবী, সৈনিক, এরকম অনেক পেশাই তিনি গ্রহণ করেছিলেন জীবনের নানান পর্যায়ে।
পেশাগত জীবনের মতো লিংকনের রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে অনেক রঙের খেলা। ২৫ বছর বয়সের তিনি ইলিনয়েসের স্প্রিংফিল্ডের আঞ্চলিক সরকার পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হন। এই সময়ে তিনি নিজে বইপত্র ঘেঁটে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সততার জন্য তাঁর উপাধি হয়েছিল ‘Honest Abe’। একবার যুক্তরাষ্ট্রের হাউস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করলেও দুবার তিনি হেরে যান সিনেট্র পদের জন্য লড়ে। অবশেষে ১৮৫৮ সালের বক্তব্যে দাসপ্রথার বিলুপ্তি বিষয়ে প্রতিদ্বন্দী ডগলাসকে জোর বিতর্কে হারিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল নমিনেশন জিতে নেন লিংকন। টানা চার বার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে লিংকনই যুক্ত করলেন আজকের যুক্তরাষ্ট্রকে
কিন্তু প্রথমবার শাসনক্ষমতা পাওয়ার সময়ে আজকের যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে যুক্ত ছিল না। দাসপ্রথা ইস্যুতে দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়েছিল এই রাষ্ট্র। বেশিরভাগ রাজ্যের লোক মানুষকে দাস বানিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিল। দ্বন্দ এমন চরমে ওঠে যে, উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলে ভাগ হয়ে প্রায় যুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়। এই ইস্যুর নিষ্পত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্র করে তোলেন লিংকন। পাশাপাশি দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্যেও লড়াই করেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁর ‘গেটিসবার্গ ভাষণ’ চিরস্মরণীয়। লিংকনের সেই বাণী আজও গণতন্ত্রকামী মানুষের মুখে মুখে ফেরে-
“গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য জনগণ কর্তৃক জনগণের শাসন।”

জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া এই মানুষটির মৃত্যু কিন্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসিতে এক মঞ্চ নাটক দেখার সময়, সেই নাটকেই অভিনীত এক চরিত্র তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। উপস্থিত দর্শকরা শুরুতে ভেবেছিলো এটা হয়তো নাটকেরই একটি সাজানো দৃশ্য। জন উইকস বুথ নামের ঐ ব্যক্তি ছিলো লিংকনের দাসপ্রথা বিলুপ্তির একজন ঘোর বিরোধী। গুলি করে মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়ে যায় সে এবং পুরো পরিকল্পনাটিই ছিল নিখুঁতভাবে গোছা্নো।
আরও পড়ুন- লতা মঙ্গেশকর , গানের এক রঙীন প্রজাপতি
আব্রাহাম লিংকন সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন যে বইগুলো