প্রায় সব দিক থেকেই আহমদ ছফা ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। চিন্তায়, চেতনায়, জীবন-যাপনে, রচনায় তাঁর স্বাতত্রিক বিশিষ্টতা সুস্পষ্ট। অত্যন্ত সাদামাটা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাই-তো সাধারণ মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন সহজেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, জাতির শিক্ষক ও জাতির দর্পণ হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা হয়। শোষিত মানুষের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন আহমদ ছফা। মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলির জন্যও ছিলেন অনন্য। অনেকেই তাঁকে প্রাবন্ধিক হিসেবে দেখলেও আহমদ ছফা ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। একাধারে রাজনীতিক, কবি, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট কলামিস্ট।
অনেকের জীবনের নানান সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন আহমদ ছফা, বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের পক্ষে যতটুক সম্ভব সহায়তার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বাংলার নামকরা চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। তাঁরা দুজনেই বোহেমিয়ান বা ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং খ্যাতি, ধন-সম্পদ বা অন্যান্য বৈষয়িক মোহবর্জিত ছিলেন। ১০০ বছরেও এমন ব্যক্তিত্ব আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন আহমদ ছফা নিজেই।
প্রথম দিকে তরুণ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের তেমন পরিচিতি ছিল না। শিল্পীমহলের অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। এ সময় ছফাই তাঁর পাশে দাঁড়ান। ছফার চোখে সুলতানও ছিলেন একজন দার্শনিক। বাংলার মাটির প্রতীক তিনি, বাংলার মাটির যোগ্য সন্তান। আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা খুঁটিনাটি সমস্যাগুলোই ছিল যাঁর শিল্পের খোরাক। আহমদ ছফা মনে করতেন এই বাংলায় সুলতানকে আরও বেশি দরকার। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানরাও বড় শিল্পী, ভদ্রলোক। তবে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে শিল্পের জায়গা করে দিতে হলে সুলতানদের কোনো বিকল্প নেই বলেই বিশ্বাস করতেন তিনি। দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন আহমদ ছফা। সুলতানের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাশক্তি ও চিত্রকর্মের উচ্চ প্রশংসা করে ৫০ পৃষ্ঠার গোটা একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। প্রবন্ধটির নাম ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্যঃ সুলতানের সাধনা’। প্রবন্ধটি সবার নজরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই সুলতান সবার দৃষ্টিতে চলে আসেন, সুলতানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলায়। এর পরের ইতিহাসটা আমাদের সবারই জানা আছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের বাবা শহীদ হন। সে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে অসহায় এই পরিবারকে থাকার জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই হুমায়ূন আহমেদদের সেই বাড়ি সরকার নিয়ে নেয়। এ ঘটনা শুনে আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ান। হুমায়ূন আহমেদদের বাড়ি সরকার নিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিতে চেয়েছিলেন আহমদ ছফা। এছাড়াও লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে আহমদ ছফার অবদান অনস্বীকার্য। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তাদের পরিবারে অর্থকষ্ট ছিল। সে সময় মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা অফিসে কার্টুনিস্টের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন আহমদ ছফা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তরুণ কবি আবুল হাসানের পুনঃভর্তি হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আবুল হাসানের হাতে তখন কোনো টাকা ছিল না। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পেরে নিজের বই প্রকাশের ‘রয়্যালিটির’ টাকা তুলে দিয়েছিলেন আবুল হাসানের হাতে যাতে তিনি পুনঃভর্তি হতে পারেন।
স্বাধীনতার পর কোনো কারণে কবি ফররুখ আহমেদের সরকারি টাকা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি অসুস্থও ছিলেন। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পেরে খুব ক্ষেপে যান। একজন সাহিত্যিক অসুস্থ, অথচ কোনো এক অজানা অজুহাতে সরকারের তরফ থেকে টাকা প্রদান বন্ধ থাকবে ! — এটা মেনে নেওয়ার মতো মানুষ আহমদ ছফা ছিলেন না। তিনি বিষয়টি নিয়ে হইচই তুললেন। প্রতিবাদ করলেন। অবশেষে সরকারের তরফ থেকে ফররুখ আহমেদকে টাকা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
১৯৭৫ সালে তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণকে অজ্ঞাত কারণে আর্মি গ্রেপ্তার করে রমনা থানা হাজতে কাস্টোডিয়ান হিসেবে জমা দিয়েছিল। এই খবর পাওয়া মাত্র নির্মলেন্দু গুণকে ছাড়াতে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন ছফা। নির্মলেন্দু গুণকে ছেড়ে দিতে তিনি থানার ওসির সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা পর্যন্ত করেন। সাত দিনের মধ্যেই গুণ ছাড়া পান।
আরেক প্রতিবাদী তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে খুব স্নেহ করতেন আহমদ ছফা। তিনি যখন পাকস্থলীর আলসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, ছফা তখন তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। ফিরে আসার সময় টাকা ভর্তি একটি খাম রেখে আসতেন রুদ্রের বালিশের নিচে।
কবি অসীম সাহা এমএ প্রথম পর্ব পরীক্ষার ফরম ফিলাপের আগে অর্থ সংকটে ছিলেন। বিষয়টি অসীম সাহা আহমদ ছফাকে জানান। কিন্তু ছফা নিজেও তখন আর্থিক সংকটে। তাই তিনি অসীম সাহাকে সহায়তা করতে ভিন্ন পদ্ধতি নিলেন। অসীম সাহাকে ‘ডিরোজিও’র ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বললেন। এ জন্য কিছু বইও দিলেন তাঁকে। অসীম সাহা পাণ্ডুলিপিটি দ্রুত তৈরি করে দিলে, ছফা তা ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’ নামক প্রকাশনীতে জমা দেন। প্রকাশকের কাছ থেকে ওই বই বাবদ অগ্রিম ২০০ টাকা এনে অসীম সাহার হাতে তুলে দেন। অসীম সাহা বলেছিলেন, “বস্তুত ছফা ভাইয়ের চেষ্টা এবং উদ্যোগে-ই আমার এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. নাজমা শাহীনের বিয়ের সময় তাঁর বাবা অর্থসংকটে পড়েন। নাজমা শাহীনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য আহমদ ছফা নিজের সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি বাংলাবাজারে কোনো এক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে টাকাটা নাজমা শাহীনের বাবার হাতে ধার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন।
কবি ও লেখক শিহাব সরকার ও মোরশেদ শফিউল আর্থিক সংকটে পড়ে আহমদ ছফার কাছে এলে তিনি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। এমন অনেক মানবিক ঘটনাই আছে, যা আহমদ ছফাকে বিরলপ্রজ মানবিক মূল্যবোধের লেখকের মর্যাদা দিয়েছে। সবার কথা বলতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে।
তাঁর সমকালে আহমদ ছফা ছিলেন মেধায়, মননে, সৃজনে অনন্য একজন। ষাট, সত্তর, আশি দশকের সাহিত্যধারায় তাঁর উজ্জ্বলতম উপস্থিতি সে প্রমাণবহ। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান তিনি। বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্রও সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। সাহসী উচ্চারণে ও বুদ্ধির দীপ্তিতে তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ।
আহমদ ছফার লিখিত প্রবন্ধগুলোকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে রয়েছে রাজনীতি, আরেকভাগ হচ্ছে অরাজনৈতিক। অরাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোতে তিনি দর্শন, সামাজিক বিভিন্ন বিষয় ও বিভিন্ন শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন।

আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজ। এ সমাজের গঠন, বিকাশ, জাগরণ, প্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যা নিয়ে তিনি শুধু চিন্তাই করেন নি, এক অসামান্য কৃতিত্বপূর্ণ বিশ্লেষণও উপস্থাপন করেছেন। ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩)’ ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৬)’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের পাতায় পাতায় সে স্বাক্ষর বিদ্যমান।
আহমদ ছফা মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলোর জন্যই অধিক আলেচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যকে অন্যমাত্রায় নিয়ে আসেন। তাঁর সাহসী কলমের কালিতে উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নির্মম সত্য। জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠে’ লিখতেন আহমদ ছফা। গণকণ্ঠেই মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি এখনও বাংলাদেশে রাজনীতি সাহিত্যে অনবদ্য এক সৃষ্টি হিসেবে রয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ প্রবন্ধে তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সত্তরের দশকে ছফার সেই খুঁজে পাওয়া সমস্যাগুলোর সাথে আজকের সমস্যা ও প্রাসঙ্গিকতা যে কেউ খুব সহজেই মিলিয়ে নিতে পারেন। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি ১৯৯৬ সালে যখন ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’ গ্রন্থে সংযোজন সহ পুনর্মুদ্রিত হয় তখন তিনি দেখিয়ে দেন কিভাবে তাঁর করা রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সত্য হয়েছে।
সমাজ ও রাজনীতির পাশাপাশি ইতিহাসের প্রতিও আহমদ ছফা সমান আগ্রহী ছিলেন। ‘সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস’ তেমনই একটি রচনা। তিনি সাহিত্যের নির্যাস নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। আর জ্ঞানের নির্যাস নিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক থেকে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছফার জীবনে বড় ভূমিকা রাখেন। যা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থটি পাঠ করলে স্পষ্টই বোঝা যায়। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আলাপচারিতায় রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপান্তরকে চিত্রিত করেছে।

বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আহমদ ছফা বিভিন্ন আর্থ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যুতে লড়েছেন। সংগঠন করেছেন। লেখকের দায় ও দায়িত্বকে তিনি রাজপথ পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজে সম্প্রসারিত করেছেন। কলমকে অস্ত্রে পরিণত করা আহমদ ছফা সম্পর্কে বলা হতো, তাঁর মসি ছিল অসির চেয়েও ধারালো। যে সত্য প্রকাশ করতে তাঁর সমকালীন লেখকেরা হিমশিম খেতেন, তিনি তা অসংকোচে অবলীলায় প্রকাশ করতেন। বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে আলাদা এবং স্বতন্ত্র অবস্থানের মতো ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও তাঁর উপমা তিনি নিজেই।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই তাঁর মৃত্যুর দিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট ও তুলনা-রহিত লেখকের চিরপ্রস্থানের বেদনাময় স্মৃতিতে। সারা জীবন নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের না বলা কথাগুলো বলে যাওয়া এই মানুষটি আজও মিশে আছেন তরুণ সমাজের চেতনায় ও প্রেরণায়।
– ফারহানা ইয়াসমিন