কেউ যদি বলে, অমুক বইটা ছোটদের বই (শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা), তাহলেই হলো–আমরা প্রাপ্তবয়স্করা বইটির প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে বসে থাকি। এই করে করে কতো সরেস, মজার আর উত্তেজনাভরা বই যে আমরা পড়তেই পারলাম না, তা হয়তো ভেবেও দেখিনি কখনো। তার চেয়েও বড়ো কথা, এমন কিছু বইয়ে পাওয়া যায় লেখকের এমন সব অভিজ্ঞতা আর অন্তর্দৃষ্টির বয়ান, যা যে কোনো বয়সের মানুষকে সমৃদ্ধ করতে পারে। নতুন করে ভাবাতে পারে অনেক কিছু। এরকম ৫ টি বই (তোত্তোচান, মাতিল্ডা, পিটার প্যান, দ্য এ্যাডভেঞ্জারস অব হাকলবেরি ফিন, হোয়াইট ফ্যাং)-এর কথা বলেছিলাম ১ম পর্বে। তেমন আরও ৫ টি বইয়ের তালিকা দিয়ে সাজানো হলো এই পর্বটিও।
৬। দ্য জাংগল বুক
গহীন জঙ্গলে এক শিশুকে খুঁজে পেল এক নেকড়ে পরিবার। শিশুটিকে দেখে তাদের বড্ড মায়া হলো। তারা তাকে নিজের সন্তানের মতোই বড়ো করতে লাগলো। শিশুটির নাম দিলো মোগলী। মোগলীও জঙ্গলের পশু-পাখীদের ভাষা আয়ত্ত্ব করে, হাসি-খুশিতে আর বন্ধুত্বে হয়ে উঠলো জঙ্গলেরই একজন। কিন্তু তা হলে কী হবে, মোগলীর জীবন সহজ নয় তবুও।

জঙ্গলেও আছে বিপদ, আছে শত্রু। বিশেষ করে মোগলীর চিরশত্রু শের খাঁ তো পিছুই ছাড়ছে না। নানাভাবে মোগলীকে কাবু করার চিন্তা শের খাঁর। তার ওপর আছে জঙ্গলের ওপর মানুষের আধিপত্যবাদ। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মোগলী কিন্তু ছিনিয়ে নেয় জীবনের জয়, প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যে, সে জঙ্গলেরই একজন। অসাধারণ এই বইটি ভালো লাগবে যে কারোরই, যদিও জনপ্রিয় এই বইটি নিয়ে যুগে যুগে তৈরি হয়েছে অনেক কার্টুন, ড্রামা, এমনকি মুভিও, আর সেসব অনেকেই দেখে ফেলেছেন। কিন্তু এমন একটি ক্লাসিক সংগ্রহে থাকাও আবশিক। তাছাড়া মুভিতে দেখা আর বইয়ে পড়ার মধ্যে তফাৎও আকাশ-পাতাল।
৭। উইলো বনের ধারে
এই বইয়ের চরিত্ররা কেউ মানুষ, কেউ পশু-পাখী। এখানে আছে এক বোকাসোকা ছুঁচো, উপকারী মূষিক, ঘুমকাতুরে অতিথিবৎসল উদবিড়াল, সহৃদয় আর উপকারী ভোঁদড়, আছে নেউলের দল। মানুষের সঙ্গেই তাদের সহাবস্থান। কেনেথ গ্রাহামের জাদুময় লেখা আপনার চোখের সামনে প্রতিটি চরিত্রকে মূর্ত করে তুলবে।

এই বইটিই ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য উইন্ড ইন দ্য উইলোজ’ নামে। প্রকাশের পর ছোট-বড় সবার কাছেই বইটি অনেক সমাদৃত হয়। কেনেথ গ্রাহামকে তারকা খ্যাতি দেয়ার পেছনেও এই বইয়ের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক চলে যায় ইংল্যান্ডের গ্রামের ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশে। এখানে সবাই সবার বন্ধু। শুধু ব্যাঙ একটু অন্যরকম। হঠাৎ তার মনে এসে যায় কী এক অহংকার কে জানে, সে নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। আর এর মধ্যেই পড়ে যায় এক ভীষণ বিপদে। কিন্তু এবার কী হবে তার? কে তাকে বাঁচাবে?
এই গল্পটি স্বার্থহীন এক বন্ধুত্বের গল্প, প্রকৃতি ও পশু-পাখির সাথে মানুষের মিতালির গল্প। এমন একটি বই সংগ্রহে কেন থাকতে নেই? আপনার ছোট্ট বন্ধুকে পড়ে শোনাতে শোনাতে নিজেও মজা পেতে শুরু করবেন বইটির মজার আর চাঞ্চল্যকর গল্পপ্রবাহে।
৮। এক নৌকায় তিন যাত্রী
যারা হাস্যরসাত্মক বই পড়তে পছন্দ করেন, এই বই তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। বইটি পড়ার পর হয়তো আপনার পড়া ‘সেরা রম্য রচনা’র তালিকায় এটা এক নম্বরেও থাকতে পারে। জর্জ, হ্যারিস আর জো দৈনন্দিন একঘেঁয়ে জীবনের বিরক্তি থেকে বাঁচতে নৌ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। বইয়ের পুরো গল্পটি তাদের মাত্র তিন দিনের নৌ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কিন্তু বই পাঠের পর পাঠক তিন দিনের নয়, যেন তিন বছরের আনন্দ-অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পায়। জীবনের সাধারণ ঘটনাবলীকে নির্মম সত্যের আলোকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এমন বুদ্ধিদীপ্ত, সরসভাবে উপস্থাপন খুব কম চোখে পড়ে। এর সঙ্গে বোনাস হিশেবে রয়েছে বিচিত্র সব ঐতিহাসিক তথ্যের সমাহার।

লেখক নিজে বইটি সম্পর্কে বলেছেন এভাবে-
চিন্তার গভীরতা ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের দিক থেকে অন্য বইগুলো শ্রেষ্ঠতর হতে পারে, কিংবা স্বকীয়তা ও আকৃতির দিক থেকে এর প্রতিদ্বন্দী হতে পারে, কিন্তু ডাহা সত্যবাদীতার দিক থেকে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনোকিছু অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়নি। আশা করা যাচ্ছে, অন্যান্য আকর্ষণের চেয়ে এই গুণেই বইটি পাঠকের কাছে আদরণীয় হবে এবং এই কাহিনীর শিক্ষণীয় বিষয়টি এই গুণেই আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবে বইটির মজা সবচে বেশি পাওয়া যাবে এর মূল সংস্করণ পড়লে। আগ্রহী পাঠকের জন্য মূল ইংরেজি সংস্করণের লিংক দেয়া হলো – Three Men In a Boat । এছাড়াও, সেবা প্রকাশনী থেকে অনূদিত ‘ত্রি-রত্নের নৌবিহার’ও পাঠক সংগ্রহ করে নিতে পারেন নিজেদের উদ্যোগে।
৯। তাড়িখোর
‘দশ বছর বয়স থেকে মানুষটির তাড়ি খাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। তার জন্য প্রতিদিন তাড়ি জোগাড় করে দেয় এক তাড়িগাছি। হঠাৎ একদিন সে পরপারে পাড়ি জমালে মৃতদের দেশ থেকে তাকে উদ্ধার করে আনতে যাওয়া ছাড়া সেই তাড়িখোরের আর উপায় কী? এই মৃত্যুঞ্জয়ী প্রচেষ্টার অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার সৃষ্টিছাড়া আলেখ্য তাড়িখোর। ইওরুবা বা নাইজেরীয় লোকগাথার বাচনিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পৌরাণিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক অভিনব ইংরেজিতে লেখা এই উপন্যাস এমোস তুতুওলাকে আফ্রিকার একজন সেরা ও প্রভাবশালী লেখকের সম্মান এনে দেয়। অনূদিত হয়েছে এক ডজনেরও বেশি ভাষায়। উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদের রজতজয়ন্তী সংস্করণ…

১০। টাক এভারলাস্টিং
উইনফ্রেড ফস্টার। বয়স তার মাত্র ১০ বছর। ১০ বছরের ছোট্ট এই মিষ্টি মেয়েটিি একদিন মা আর দাদীর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল একদিন। চলে গেলো গ্রামের পাশের ছোট্ট জঙ্গলটিতে। ভাবলো, মুক্ত বাতাসে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো যাক কিছুক্ষণ। এই করতে গিয়েই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অদ্ভুত টাক পরিবারের সঙ্গে, যাদের কিনা বয়স বাড়ে না!
কিন্তু টাক পরিবার অমরত্ব লাভ করলো কী প্রকারে? মানুষ যদি অমরত্ব পেয়ে যায়, আসলে কি তারা সুখী হবে? এই সবেরই উত্তর মিলবে উপন্যাসটিতে।

অল্প পরিসরে জীবনের গভীর কোনো দর্শনকে তুলে ধরা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু সেই কাজটিই নাটালি ব্যাবিট করে দেখিয়েছেন এই ছোট্ট কিশোর উপন্যাসটিতে। যারা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন, তারা এই বইয়েও খুঁজে পেতে পারেন মনের খোরাক। ছোটদের বই হলেও, পড়তে পড়তে যে কোনো পাঠকই এক চরম সত্য, গভির এক দর্শনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবেন। ‘টাক এভারলাস্টিং’ উপন্যাসকে তাই ‘বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু’ বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না।
জীবনের যে কোনো পর্যায়েই মানুষের উৎকৃষ্ট সঙ্গী হতে পারে বই। কিন্তু কোনো ক্যাটাগরি-বিভাজনের পাল্লায় পড়ে চমৎকার কোনো বই যেন আমাদের পাঠতালিকার বাইরে না থেকে যায়। সবার বই পড়া হোক আনন্দময়।
শিশু-কিশোরদের মজার বইগুলো দেখতে ক্লিক করুন
চিরায়ত সাহিত্যের বইগুলো দেখুন